ভাসমান নৌকায় বসে ভাত খাওয়ার আনন্দ কি ভোলা যায়!/মোহাম্মদ মইনুদ্দিন মিয়া

মন-মননে আর কল্পনায় ফেলে আসা দিনের স্মৃতির রাজ্যে আমাকে অহর্নিশি ভাসিয়ে বেড়াতো ছোটোবেলার নৌকা। নৌকা চালানো, বর্ষায় নৌকায় ঘুরে বেড়ানো ছিলো আমার কাছে দর্দমনীয় নেশা। তখনকার দিনে গ্রামের স্বচ্ছল পরিবারে বর্ষাকালে নৌকার কোন বিকল্প ছিলো না। আমাদের ছিলো একটা বড় নৌকা আর একটা ছিলো ছোটো ডিংগি নৌকা (এখন বড়ো লোকদের পাঁজেরোর সাথে একটা এক্স করলা গাড়ির মতো)।১৮/২০ হাতের বড়ো নৌকাট আমাদের বাড়ীর উঠোনে সুয়াপুরের সূতার আজু মিস্ত্রী ছয় মাসে তৈরী করে দিয়েছিলেন। নৌকাকে তার কাটা, পেরেক, পাতাম, পিতলের সৌকর্যে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হতো। ডিংগি ও কোষা নৌকা ছোটো ছোটো কাজের জন্য ব্যবহৃত হতো। এই নৌকার লগি-বৈঠা ছিলো আমার হাতে। মোল্লাপাড়ার মোজামের (বীর মুক্তিযোদ্ধা) নৌকার সাথে আমি নৌকা বাইচ খেলতাম। নৌকার গলুই (আগার, পিছনের অংশ) ঠিক রেখে পাল্লা চলতো। নেশায়-নেশায় দিন পাড় হতো। কী- যে আনন্দ পেতাম -এখন গাড়িতে হাজার মাইল ঘুরেও সে আনন্দ পাই না।
বড়ো নৌকায় চলতো পাকা ধান ঘরে তোলা, পাট কাটা -জাগ দেয়া, বেঁচা -কেনার জন্য দূরের হাট-বাজারে যাওয়া, আত্বীয়-স্বজনদের বাড়িতে বাড়ির সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া ছাড়াও- আরও কত কি!
হাটে যাওয়ার বিষয়টি ছিলো- ছোটো বেলায় এক অতৃপ্ত বাসনাকে তৃপ্ত করার শামিল। ১০/১২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নৌকায় সাভার হাটে যেতে পারাটা ছিলো আমাদের ঐ বয়সে সৌভাগ্যের সোনার হরিণ আর অনাবিল আনন্দের। কারণ ঐ বয়সে বাবা-মায়েরা ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। হাটে যাওয়ার সুযোগ মিললেই পেতাম ভাসমান নৌকায় রুপোলী ইলিশ আর মিষ্টি কুমড়ার মিশানো তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার আস্বাদ। উহ্ মাঝ রাস্তায় ভাসমান নৌকায় ভাত খাওয়া- কী যে আনন্দের! কী যে মজার! জীবনেও এ স্মৃতি ভোলার না।
সাভার হাটে পৌঁছানোর আগেই বংশী নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য- নৌকার গলুই’র উপর পানি দিয়ে আল্লাহ-রসুলের নাম নিয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে নদী পাড় হতাম।
নদী পাড়ি দেওয়ার পর নৌকা ঘাটে বেঁধে আমাদেরকেই বসিয়ে রাখা হতো- নৌকা পাহাড়া দিতে। বিনিময়ে পেতাম চিড়া, দই, মিষ্টি, জিলাপী ও গজা।
বাজার সদাই শেষ হলে এবার যাত্রা বাড়ির দিকে। পাল তোলা হলো নৌকায়। পালে বাতাস-সামনে বংশী নদীর সুউচ্চ ঢেউ আর ¯্রােত আবার পাড়ি দিতে হবে। বড়োদের সাথে যৌথভাবে নৌকার হাল ধরেছি আমি-ভাবা যায়! এ এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস! শৌর্যে-বীর্যে এ এক এভারেস্ট বিজয়!

পালে হাওয়া,
চিত্ত অস্থির,
মনে শংকা,
নৌকা চলছে-
চলছে জীবন,
হায়রে জীবন —-!!

(চলবে)

মন্তব্য করুন