মানুষ ও জীবন-জীবীকার শিল্পী সোহাগ পারভেজ/হামিম-উল-জিহাদ (সজল)

চিত্রকর-চিত্রশিল্পী-শিল্পী এদের মধ্যে সম্পর্কটা গ্রহ-নক্ষত্র আর গ্যালাক্সির মতো । মানুষের বিচিত্রতা ঠিক যেন সুপার ক্লাস্টার। প্রতিনিয়ত নিজের সীমানা অতিক্রম করে যাওয়াই যার ধর্ম ।  আমার বোধের বয়সই শিল্পশিক্ষার বয়স । কর্মজীবনের এ যাত্রায় কয়েকশত চিত্রকর-চিত্রশিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েছি, কিন্তু শিল্পের প্রতি সম্মান, শ্রম, সততা ছিল সামান্য কিছু  চিত্রকরের মধ্যেই । ছবি আঁকা আর শিল্প তৈরী করার মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক গ্রহ থেকে ক্লাস্টারের যেমন । শিল্পযাত্রার এ পথে শিল্পী হয়ত নিজের অজান্তেই অতিক্রম করেন নিজেকে ।  
অনেক শিল্প শিক্ষার্থীরাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, শিল্পী হতে কতদিন লাগে? তাদের বলি-“যেদিন মনে হবে আমার শিল্পশিক্ষা শেষ হবার না, সেদিন থেকেই এ শিল্প যাত্রা শুরু।’’ প্রায় এক দশক ধরে এমনই একজনকে খুব কাছ থেকে দেখে জেনে মনে হয়েছে এইত শিল্পের একনিষ্ঠকর্মী । গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে, পাহাড়-সুমুদ্রে  ছুটে বেড়ানো যার দৈনিক জীবনের চলার মধ্যে ছবিআঁকা অবিচ্ছেদ্য অংশ । ছবি আঁকাটা যেখানে কোনো ছবি তৈরি করা নয়, একটা গল্প তৈরি করা ।  একাডেমিক দক্ষতা, রঙের ব্যবহার, লাইনের গতি, সাবজেক্টের এলিমেন্ট, কম্পোজিশন, সবকিছুই এখানে জীবনের গল্প । প্রত্যক্ষদর্শী-সঙ্গী হয়ে দেখেছি জীবনের জন্যে জীবনের সংগ্রাম । ঋতুর পালাবদলে রং, আকাশ, প্রকৃতির বদলেযাওয়ার সাথে বদলায় জীবন জীবিকার ঢং । 

বান্দরবানের পাহাড়, নদী, টং ঘর থেকে শুরু করে নওগাঁর সাঁওতাল, চট্টগ্রামের চাক্তাই বা কক্সবাজারের উত্তাল সুমুদ্র, সুনামগঞ্জের হাওর, নদী, সুন্দরবন,বা ইট কাঠের পুরান শহর বাদ পড়েনি বাংলার রুপ সন্ধানের কোনো প্রান্ত । রুপের সন্ধানে যেন ছুটে চলেছে জেলে, মাঝিমাল্লা, বেঁদে, মারমা, মুরং, খাসিয়া, খেটেখাওয়া প্রতিটি জীব । প্রতিটি পাতায় ক্যানভাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাদের গল্প । একটি পেইন্টিং (চিত্রকর্ম) একটি ফটোগ্রাফ এর অনুরূপ নয়, শিল্পীর চলা, দৃষ্টিভঙ্গি, ভালোবাসা, উপলব্ধির এক সম্মেলন।  যেখানে রেখা, একাডেমিক দক্ষতা এনে দেয় এক নান্দনিক মাত্রা । প্রতিটি রেখায়, প্রতিটি কম্পোনেন্টে কতটুকু ধরতে হয় বা ছাড়তে হয় সুখ-দুঃখ তারই এক মাত্রা ।

শিল্পীর ছবি তার রক্তের মতো, ছুটে চলা পথ-ঘাট তার ধমনী বিশেষ । দিনের পর দিন চাটাইয়ের ঘড়, মাটির ঘরের স্যাঁতস্যাতে হাওয়া , জেলে পল্লীর আঁশটে গন্ধ বা তীব্র শীতের কাপুনিধরা কোনো ভোর থেকে এসেছে গল্পগুলোর রং-রূপ । বছরের পর বছর এ যাত্রায় তৈরী হয় নানা একাডেমিক দক্ষতা আর স্প্রিচুয়াল মনোবৃত্তি । বলিষ্ঠ রেখার ভাষা, রং, আলোছায়া বা কম্পোজিশনের বিন্যাস শিল্পীর সেই অভিজ্ঞতারই জানান দেয় । শিল্পীর চেয়ে তার জীবন বড়, জীবনের চেয়ে তার কর্ম বড় । এমনইভাবে কখনো কখনো শিল্পীর জীবনই হয়ে ওঠে একটা শিল্প । শিল্পী তার চেতনায় ভাবনায় আক্ষরিক রেখা ছাপিয়ে গভীরতার অতলে ডুবে যান তার সমাজের সভ্যতার ছাপ তুলে আনতে।

কত শিল্পী জীবন বিসর্জন হয়েছে অন্য জীবনের সন্ধানে, তুলে এনেছেন অপার্থিক সৌন্দর্য । গল্প বলতে গেলে গল্প শুনতে হয়, জানতে হয়, গল্পে ঢুকে যেতে হয়, শিল্পী তো সেই গল্পের বা সমাজের প্রধান সেবক । রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রতিটি ভাবনা শিল্প মনে রেখা কাটে, তারই ছাপ পরে তার কর্মে ।  নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মতো মহৎ আর কীইবা হতে পারে! ইতিহাস, সভ্যতা, বর্তমানকে এর থেকে নিখুঁতভাবে কোনো কিছুতেই তুলে ধরা যায় না । কতটা পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর সততা থাকলে জাতি, বর্ণ, গোত্রের মায়া ত্যাগ করে শুধু প্রকৃতি, মানুষ আর জীবনের জন্য কাজ করা যায় ।  বারবার এই পথেই যাকে পেয়েছি বা দেখেছি সে আমার-আমাদেরই এ প্রজন্মের সোহাগ পারভেজ। মানুষের জন্য প্রকৃতির জন্যে যার বেঁচে থাকা আর সেই শিল্প তৈরীতে যার জীবনের উদার সমর্পণ।  আমার জীবনে ছবির মতো মিশে গেছেন যিনি । যার কাজ আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, দেখেছি তার মেধা-মননের বিন্যাস, সুখ-দুঃখের সাথে মিশে যাওয়া তুলির আচর । জীবনটাই যেন হয়ে উঠেছে এক শিল্পীর স্বরূপ সন্ধানের অভিযাত্রী হয়ে । প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে আরো অনেকটা পথ হাঁটতে চাই এভাবেই । 


গ্যালারি কায়ায় “মাই কান্ট্রি” শিরোনামে অষ্টম একক প্রদর্শনী চলছে শিল্পী সোহাগ পারভেজের । দর্শনার্থীর প্রতি বিশেষ অনুরোধ ছবির সাথে গল্পটাও একটু মিলিয়ে নিলে হয়ত ছবির প্রতি, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা-ভালোলাগার এক নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে ।প্রদর্শনী শেষ হবে ২৪ সেপ্টেম্বর।

আজ আগাম/নাআ/১৮২০