মার্টিন লুথার কিং-এর সঙ্গে চকিতে দেখা হওয়ার গল্প : লুৎফর রহমান রিটন

আটলান্টায় ‘বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হলো দু’দিন ব্যাপি। আয়োজক উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ। স্থানীয় হোস্ট ছিলো আটলান্টার ‘সেবা বাংলা লাইব্রেরি’। আমেরিকা এবং কানাডার কয়েকটি শহরের কয়েকজন লেখক এবং কলকাতার দু’জন অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে গড়ে উঠেছিলো এই ‘বিশ্ব বাংলা’। প্রশ্ন উঠতেই পারে–মাত্র তিনটি দেশ কী করে বিশ্ব বাংলা হয়? প্রথম আয়োজন হিশেবে সেই প্রশ্নটি বরং শিকেয় তোলা থাক। আগামীতে বাংলাদেশ-ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়া-জাপান-মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাঙালিদের সম্পৃক্ত করে এর বিস্তার বা পরিধি বাড়ালে ‘বিশ্ব বাংলা’ তার নামের পূর্ণতা পাবে।

অটোয়া থেকে আটলান্টায় গিয়েছিলাম ৩০ আগস্ট। ফিরেছি ৩ সেপ্টেম্বর। কয়েকটা দিন কেটে গেলো হুলুস্থুল আড্ডায় আর তুমুল তর্কে। ধুন্দুমার গল্পে আর লাগামহীন ছোটাছুটিতে।

৩১ আগস্ট সকালে স্থানীয় একটি স্কুলের বড়সড় অডিটোরিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আহবায়ক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত স্বাগত ভাষণ দিলেন। সমাবেশ উপলক্ষ্যে ‘হৃদ বাংলা’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিলো হুমায়ূন কবিরের সম্পাদনায়। যার প্রচ্ছদ এঁকেছেন মন্ট্রিয়ল নিবাসী শিল্পী রাকীব হাসান। সম্পাদক এবং পূরবী বসুকে সঙ্গেনিয়ে স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে এসে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে দু’দিন ব্যাপি সাহিত্য সমাবেশের উদ্বোধনও করলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত।

লোকাল হোস্ট বা স্থানীয় আয়োজক সেবা বাংলা লাইব্রেরির পক্ষে কাউকে ডাকাই হলো না মঞ্চে, উদ্বোধনী পর্বে। অথচ কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করেছেন হারুণ রশীদ তাঁর দলবলসহ টানা কয়েকটা দিন!

বাংলাদেশে মৌলবাদী ধর্মান্ধদের হাতে খুন হওয়া আটলান্টা নিবাসী লেখক অভিজিৎ রায় স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়েছিলো কাজী রহমানের একটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে। এটি ছিলো এই সমাবেশের উদ্বোধন পর্বের একটি উজ্জ্বল অংশ।
উদ্বোধনী সঙ্গীত ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি পরিবেশন করেছেন উৎপল কান্তি। তাঁর হিরন্ময় কণ্ঠ মোহিত করেছে আমাদের।


এ ধরণের সাহিত্য সমাবেশে লেখকদের বাইরে উৎসাহী মানুষের উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে। যে কারণে দর্শক-শ্রোতার ব্যাপক উপস্থিতি প্রত্যাশা করাটা নেহায়েত বোকামী। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচ গানের ব্যবস্থা থাকলে ভিন্ন চিত্র।

প্রবাসে এ ধরনের লেখক সমাবেশে সীমিত সংখ্যক লেখক নিয়েও একাধিক ভ্যেনুতে(আসলে কক্ষ) সেমিনারের নামে চলে ধুন্দুমার কান্ড, বরাবরই। আটলান্টাতেও ব্যতিক্রম ছিলো না তার। মূল মঞ্চ ছাড়াও বিশাল লবি এবং পাঠ কক্ষ মিলিয়ে তিন তিনটি ভ্যেনু। লবি আর পাঠ কক্ষের নাম ‘রবীন্দ্র কক্ষ’ এবং ‘নজরুল কক্ষ’। এই দুই কক্ষে একই সময়ে চলেছে দু’টি সেমিনার। ফলে দর্শকের আসন ছিলো খরায় আক্রান্ত। আমন্ত্রিত সকলকেই মাইক্রোফোনে বক্তৃতার সুযোগ দিতে বা একোমোডেড করতে আয়োজকরা এই উদ্ভট কান্ডটা করেন। হাতে সময় থাকে অল্প কিন্তু বিষয় এবং আলোচকের সংখ্যা থাকে বিপুল। সুতরাং যাবতীয় পান্ডিত্য প্রদর্শনের সময়সীমা পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। আলোচক তাঁর জ্ঞানের ঝাঁপি উন্মুক্ত করতে না করতেই সঞ্চালক সমাপ্তির লাল বাতি জ্বালিয়ে দেন। এরপর পরবর্তী আলোচক হাপুস হুপুস করে গুটিকয় দর্শক-শ্রোতাকে বাংলা সাহিত্যে দাসক্যাপিটাল কিংবা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিগুঢ় প্রভাব কিংবা একবিংশ শতাব্দীর জাদুবাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতোটা অপ্রাসঙ্গিক সেটা বোঝাতে গলদঘর্ম হন। হান্ড্রেড মাইল স্পীডের এই আলোচনা না কার্ল মার্ক্সকে না রবি ঠাকুরকে না পাঠককে, কাউকেই স্পর্শ করতে সক্ষম হয় না। ফলাফল, বাংলা সাহিত্য তার পূর্বের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে অটল অনঢ় পাহাড়ের মতো। একটুও নড়ে না!

আটলান্টার সাহিত্য সমাবেশের আলোচ্যসূচিতে দৃষ্টি ফেরানো যাক। বিষয়সমূহ ছিলো–বাংলা কবিতায় আধুনিকতার বিবর্তন ও ব্যক্তিগত কবিতা। পরবাসে বাংলা কবিতা। ক্রিয়াপদহীন কবিতা। সমকালে রবীন্দ্রনাথ। বাংলা সাহিত্যে বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ এবং বিশ্ব সাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের তর্জমা। অনাবাসী বাঙালির সাহিত্যে স্বদেশ, পরবাস ও মুক্তিযুদ্ধ। কল্পবিজ্ঞানঃ বিশ্ব তথা বাংলা সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় ধারা। বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে নারীর অবস্থান–সেকালে ও একালে। ইতিহাস ঐতিহ্য ও বাংলা সাহিত্যঃ বিচলিত সময়ের প্রেক্ষিতে সতের শতকে বাংলা সমাজের চালচিত্র। আধুনিক বাংলা কবিতায় ভাষার ব্যঞ্জনা। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ। পঞ্চাশ/ষাটের দশকে নতুন ধারার সাহিত্যচর্চা ও লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন। কবিতার ছন্দ ও বিভিন্নরকম ব্যবহৃত ছন্দ। কবিতার ছন্দতত্ত্বঃ সখ্য না সংঘাত। বাংলা সাহিত্যে ছড়া। বাংলা গানের ছন্দ। সাম্প্রতিক সাহিত্যে ভাষা, নির্মাণ কৌশল, ধারা ও বিবর্তন। সাম্প্রতিক ধারার গল্পঃ শৈলী, ভাষা, গতি ও বিস্তার। সাহিত্যের প্রকরণ সংযোজন ও সংমিশ্রনঃ গদ্য কবিতা, গল্পপ্রবন্ধ,পত্রপ্রবন্ধ, ছোট উপন্যাস,উপন্যাসিকা, আখ্যানকবিতা, অনুগল্প। বাস্তবতার ব্যাপ্তিঃ কল্পগদ্য থেকে জাদুবাস্তবতা। প্রবাসে বাংলা সাহিত্যচর্চা, প্রকাশও প্রচারে সুবিধা অসুবিধা। বাংলা ভাষার বাঁক পরিবর্তনঃ অতীত, বর্তমান ধারা ও ভবিষ্যৎ। বাংলা ভূখণ্ডের বাইরে বসবাসরত বাঙালি লেখকদের মধ্যে স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে সাহিত্যের সাহিত্যের আদানপ্রদানসহ সম্ভাব্য অন্যান্য পদক্ষেপ।
বাপ রে বাপ! কীয়েক্টাবস্থা!

এর বাইরে ছিলো কবি ও গল্পকারদের স্বরচিত কবিতা এবং গল্প পাঠের আসর। কারা এসেছিলেন দু’দিনের এই সাহিত্য সমাবেশে অংশ নিতে?
মুদ্রিত পুস্তিকার ক্রম অনুসারে অংশগ্রহণকারী লেখকদের নাম–
কাজী রহমান, কুন্তল রুদ্র, কাজী জহিরুল ইসলাম, লালন নূর, আনোয়ার ইকবাল, মঈনুদ্দীন মুন্সী, জাহানারা খান বীণা, মোহাম্মদ ইরফান, সাদ কামালী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আশফাক স্বপন, আনিসুজ্জামান, আনিস আহমেদ, তাজুল ইমাম, আশরাফ আহমেদ, খায়রুল আনাম, দীপেন ভট্টাচার্য, সেজান মাহমুদ, মল্লিকা ধর, সুপ্রিয় দাশ, অমিতাভ রক্ষিত, অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধায়ায়, মতলুব আলী, পারভীন বানু, মৌ মধুবন্তী, পূরবী বসু, মাহবুব হাসান সালেহ, জেসমিনা ভট্টাচার্য, শামীম আল আমিন, সাবিনা হাই উর্বি, শাহাব আহমেদ, হাসান মাহমুদ, লুৎফর রহমান রিটন, রুদ্র শংকর, শুভ নাথ, ধনঞ্জয় সাহা, সুজয় দত্ত, এবং হুমায়ুন কবীর।
স্বরচিত কবিতাপাঠে অংশগ্রহণকারীদের নাম পুস্তিকায় নেই।

সময়ের ঘাটতির কারণে সন্তুষ্ট থাকছিলেন না লেখক কবিবৃন্দ। সন্তুষ্ট থাকছিলেন না সঞ্চালকও। সময়সীমা নির্ধারিত ছিলো কবিদের জন্যে। মন্ট্রিয়ল থেকে অংশ নেয়া কবি আবদুল হাসিব নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই তাঁর দ্বিতীয় কবিতাটি পাঠ করতে গেলে সঞ্চালক রাশ টেনে ধরেন। এতে অপমানিত বোধ করেন কবি। ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তাঁর ক্ষোভ খুবই যৌক্তিক ছিলো। দু’টি কবিতা পড়বেন বলেই তো তিনি মন্ট্রিয়ল থেকে ছুটি নিয়ে নিজের টাকায় বিমান টিকিট কিনে ছুটে গিয়েছিলেন আটলান্টায়।
প্রবাসী লেখক কবিদের সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণই প্রবাসে এ ধরনের অনুষ্ঠানকে সাফল্যের মুকুট পরায়। কথাটা ভুলে গেলে আখেরে ক্ষতিটা কিন্তু আয়োজকদেরই।


এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের সবচে বড় বা মূল্যবান যে কাজটা হয় সেটা ইন্টারএকশন। পরস্পরকে চেনার জানার এবং মত বিনিময়ের চমৎকার প্রেক্ষাপট নির্মিত হয় এরকম আয়োজনে। লেখক কবিরা এমনিতেই দলছুট প্রজাতি। দলছুট তিনি পরিবারে। দলছুট তিনি সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্র। কেউ তাঁকে বোঝে না, মূল্য দেয় না। মোটা দাগে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সর্বত্রই তিনি উপেক্ষিত, অবহেলিত। নিজের কম্যুনিটির কাছে অন্তত সম্মানটা মর্যাদাটা তিনি ডিজার্ভ করেন। এ ধরনের সাহিত্য সমাবেশে সেই মর্যাদা ও সম্মানের ক্ষেত্রটি নির্মিত হয় অলক্ষ্যে।

আমি প্রবাসে এরকম আয়োজনে শামিল হই হৃদয়ের গভীর গোপন ভালোবাসার তাগিদ থেকে। সম্পর্কের দায় থেকে। শিল্পের কমিটমেন্ট থেকে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কটা ঝালিয়ে নিতে। এবং নতুন বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হতে। কতো কতো প্রিয় মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয় এইসব অনুষ্ঠানে! বিচিত্র সব মানুষ, তাঁদের মেধার দীপ্তি, তাঁদের আলো-অন্ধকার, তাঁদের উদারতা-সীমাবদ্ধতায় ঋদ্ধ হয় আমার মেধা ও মনন।

দলবেঁধে সাহিত্য রচনা করা যায় না। শিল্প-সাহিত্য কোনো দলীয় কর্ম নয়। দিন শেষে ওটা একক সাধনার বিষয়।

বাংলা ভাষা থেকে বহু দূরের একটা দেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সাংস্কৃতিক আবহে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এই সম্মেলন আর কিছু না দিক, অন্তহীন প্রেরণার একটা দীপশিখা কিন্তু প্রজ্জ্বলিত হয়, নিরবে। দিন শেষে প্রাপ্তি সেটাই।


আটলান্টা-জর্জিরার সাহিত্য সমাবেশে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব মিস করেছি মনিকা আর রাকীবকে। ওদেরও আসবার কথা ছিলো। কিন্তু অনিবার্য কারণে ওরা ছিলো অনুপস্থিত। মন্ট্রিয়লে শিল্পী রাকীব হাসান আর কথাশিল্পী নাহার মনিকার উদ্যোগে গত দশ বছরে এরকম সাত আটটি আয়োজন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে কিছুটা ছোট্ট পরিসরে। সেখানেও কানাডা-আমেরিকার বিভিন্ন শহর এবং বাংলাদেশ থেকে বিশিষ্ট অতিথিরা শামিল হয়েছেন। সেখানেই আমার সঙ্গে দীর্ঘ ২৫ বছর পর দেখা হয়েছিলো ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী বন্ধু শাহাব আহমেদের সঙ্গে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বন্ধুটি চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন করতে চলে গিয়েছিলো রাশিয়া। চিকিৎসক-লেখক শাহাব আহমেদ ছিলো আটলান্টা সাহিত্য সমাবেশের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। অফিসিয়াল পদ–সমন্বয়ক। বেশ ক’টা বই প্রকাশিত হয়েছে তার।

আটলান্টায় গিয়ে দেখা পেলাম মেধাবী কল্পবিজ্ঞানলেখক দীপেন ভট্টাচার্যের। দীপেন আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ওয়ারিতে একই মহল্লায় আমাদের বেড়ে ওঠা। একসঙ্গে খেলাধুলো করেছি। র‍্যাংকিন স্ট্রিটে ওদের বাড়ির মাঠে আমরা খেলতাম। একটা টেনিস বল দিয়ে ‘চোর দীপেন-চোর মুকুল’ নামে অদ্ভুদ একটা খেলা আমরা খেলতাম। দোতলার বেলকনিতে ওর বড় ভাই এসে দাঁড়াতেন মাঝে মধ্যে। তাঁর হাতে সব সময় কোনো না কোনো বই থাকতোই। দীপেনের সেই বড় ভাইটিও খুবই বিখ্যাত হয়েছেন পরবর্তীতে। নাম তাঁর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ওঁদের বাবা ছিলেন মহাবিখ্যাত বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য।
আটলান্টায় গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে দীপেন বললো–তোমার সঙ্গে প্রায় আশি বছর পর দেখা হলো! আসলেই। আশি বছর না হলেও ক্যালেন্ডারের হিশেবে প্রায় পাঁচ দশক অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর আমাদের দেখা হলো। আমাদের এই দেখা হওয়ার প্রেক্ষপটটি নির্মাণ করে দিয়েছে আটলান্টার সাহিত্য সমাবেশ।

দেখা হলো আনিসুজ্জামান নামের এক অতি বিনয়ী অনুবাদকের সঙ্গে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সরাসরি স্প্যানিস থেকে। দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছেন আমেরিকার সান্ডিয়াগো শহরে। বিপুল পরিশ্রম করেছেন তিনি মার্কেজের বিশাল পটভূমির লেখাটাকে মূলের কাছাকাছি রাখতে। একটি বাক্য বা শব্দকে পাল্টেছেন বারবার, স্থান-কাল-পাত্রের সৌরভ-সুষমা অক্ষুণ্ণ রাখতে।

টেনেসি থেকে এসেছেন চিকিৎসক-লেখক হুমায়ুন কবীর। ‘ঘুম’ নামে দারুণ একটা বই আছে তাঁর। সাহিত্য সমাবেশের সমন্বয় পরিষদের সদস্য তিনি। ‘ঘুংঘুর’ নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন। ঘুংঘুরের ব্যানার ঝোলানো একটা স্টলে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছি তাঁর সঙ্গে। প্রবলভাবে সাহিত্যপ্রেমী মানুষটা। মুক্তধারার বইমেলাতেও ঘুঘুরের স্টলে থাকেন তিনি।

দেখা হলো শাওনের সঙ্গে। মেহের আফরোজ শাওন। বিটিভির নতুন কুঁড়ির চ্যাম্পিয়ন। নাচের মেয়ে হিশেবে ওর বিপুল খ্যাতি ছিলো শিশুকালে। শৈশবেই মেধার দীপ্তিতে উজ্জ্বল ছিলো মেয়েটা। বিটিভির নতুন কুঁড়ি নামের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সক্রিয়ভাবে। টেলপে আমার নাম যেতো কখনো গ্রন্থনা কখনো গবেষণা কিংবা নির্দেশনার ক্রেডিট লাইনে। সেই কারণেই শাওনের কাছে আমি ‘রিটন আংকেল’। শাওন পরবর্তীতে হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী হবার পরেও আমাদের দু’জনার সম্পর্ক এবং সম্বোধন পাল্টায়নি। প্রচুর আড্ডা এবং গল্প হলো ওর সঙ্গে। দ্বিতীয় দিনের রাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিশেষ আকর্ষণ ছিলো শাওনের গান।

দেখা হলো চারুকলা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শিল্পী মতলুব আলীর সঙ্গে। তিনি এসেছেন নিউইয়র্ক থেকে, সেমিনারে বক্তা হিশেবে অংশ নিতে। তাঁর স্ত্রী রেহানা মতলুব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গীটার পরিবেশন করবেন।

এই প্রথমবার দেখা হলো আমার ছড়াবন্ধু এবং ফেসবুক বন্ধু প্রীতিভাজন মোস্তফা তানিমের সঙ্গে। সায়েন্স ফিকশন লেখক হিশেবেও পরিচিত সে।
ছড়াবন্ধু সাজ্জাদ বিপ্লবকে অনুষ্ঠানস্থলে দেখে আমি তো খানিকটা অবাকই হলাম–আরে মিয়া তুমি? বললো, এইটা তো আমার শহর রিটন ভাই!
–তাইলে তুমি অনুষ্ঠানে নাই ক্যান্‌?
–উদ্যোক্তারা না ডাকলে থাকি ক্যাম্নে!
স্থানীয় আয়োজক প্রতিষ্ঠানটির সদস্য হৃদয় পাশেই ছিলো। হৃদয় বললো, ফেসবুকে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি তো!
–একটা ফোন তো করা যেতো!
–কাউকেই ফোন করিনি। যাদের আসবার তারা আসবে ফেসবুকের আমন্ত্রণ দেখেই।
সাজ্জাদ তাকালো আমার দিকে। বুঝতে আমার কষ্ট হলো না। প্রবাসে এটা আকছার ঘটে। আয়োজকরা ধারণা করে বসে থাকেন যে তারা অনুষ্ঠান করছেন। রিলেটেড লোকজন পঙ্গপালের মতো ছুটে আসবেন। কিন্তু আসেন না। টরন্টো বইমেলায় গিয়ে দেখেছি। টরন্টোর লেখকদের বড় অংশই থাকেন গরহাজির।

ক্যাফেটেরিয়া-লবিতে রবীন্দ্র মঞ্চে আলোচনা চলছে। দূরের একটি টেবিলে বসে আমি আড্ডা মারছি। একটি মেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। কলকাতার মেয়ে। ওকে মঞ্চে একটা আলোচনা পর্বে আরো দু’জন আলোচকের সঙ্গে দেখেছিলাম। বললো, আমার নাম মল্লিকা ধর। কিন্তু আপনি আমাকে হয়তো অন্য নামে চেনেন।
–তাই নাকি? আরেকটা নাম কী আপনার?
–সচলায়তন ব্লগে আপনি বেশ কিছুদিন লিখেছিলেন। তখন আমিও সেখানে ছিলাম। আমার নাম ছিলো তুলি রেখা।
–আরে তাই! চিনি তো তুলি রেখাকে! খবর কি আপনার?
দু’টো বই এগিয়ে ধরলো মেয়েটা। কলকাতার আনন্দবাজার পাবলিকেশন্স থেকে বেরিয়েছে। অনেক কথা হলো ওর সঙ্গে। বেশিরভাগই সচলায়তন কেন্দ্রিক।

ভিডিও ক্যামেরায় দু’দিনের অনুষ্ঠান দৃশ্যবন্দি করছিলো চশমা চোখের হাস্যোজ্জ্বল এক তরুণ। এগিয়ে এসে করমর্দন করতে করতে বললো–আমার নামও রিটন। রিটন খান।

আমি বললাম, আমার চেয়ে বয়েসে বড় একটা রিটনের দেখাও পাইনি এক জীবনে। বয়েস কতো তোমার? অর্থাৎ আমি জানতে চাইছি তুমি আমার বড় না ছোট।
খুবই চটপটে ছেলেটা মজার একটা গল্প বললো। অধিকাংশ লোকে ওকে লিটন ডাকতেই অভ্যস্ত ছিলো এক সময়। এমন কি স্কুলে ক্লাশ টিচারও ওকে লিটন বলাতে সে সংশোধন করে দিয়েছিলো–স্যার আমি লিটন না, রিটন। অই যে লুৎফর রহমান রিটন আছে না? আমি সেই রিটনের রিটন! লিটন না।

সন্ধ্যায় রিটন নাম্বার টু ওর স্ত্রী এবং ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। তাহান নামের চটপটে টিঙটিঙে পিচ্চিটাও দেখলাম ওর বাবার মতোই চশমাধারী। ওর বাবার নামে আরেকটা মানুষ পৃথিবীতে আছে সেইটা দেখে ওর তো চক্ষু ছানাবড়া। খুবই খাতির হয়ে গেলো ওর সঙ্গে। একটু পর পর এই রিটন এই রিটন বলে আমাকে খোঁচাতে খোঁচাতে প্রায় পাগল করে তুললো তাহান। আমি ওকে দৌড়ানি দিই। সে পালিয়ে যায়। কিন্তু খানিক বাদেই আবার এসে খোঁচাখুঁচি আরম্ভ করে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর সঙ্গে যুক্ত হলো ওর সমান উচ্চতা বিশিষ্ট একটা গাপ্পু টাইপের পিচ্চি। নাদুস নুদুস নতুন পিচ্চিটার নাম কথন। একবার তাহান খোঁচা মারে তো একবার কথন। রিপা নূর আর লালন নূর দম্পতির সন্তান এই কথন। কথন আর তাহানের যৌথ আক্রমনে আমি দিশেহারার ভান করি যতো, ততোই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপুল বিক্রমে। বুঝি না পিচ্চিগুলো বোঝে কেমন করে যে আমিও ঠিক ওদেরই সমানবয়েসী!

দু’দিনের অনুষ্ঠানে দু’জন আলোকচিত্রিকে দেখা গেছে মনোযোগের সঙ্গে প্রতিটি ইভেন্টের প্রতিটি মানুষের ছবি তুলতে। একজন মন্ট্রিয়লের আফাজউদ্দিন তোতন। অন্যজন সুমন। দীর্ঘশ্মশ্রুমন্ডিত সুমনের ক্যামেরায় লাগানো থাকতো বিশাল লেন্স। আমি যার নাম দিয়েছিলাম ইঞ্জিনওয়ালা ক্যামেরা। খুব মজা পেয়েছিলো সুমন এবং অন্যরা।

দেখা হলো ল্যান্ডিপট-এর সঙ্গে। ল্যান্ডিপট মানে সেজান মাহমুদ। আমার বিশেষ প্রীতিভাজন ছড়াবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধে নৌবাহিনির বিখ্যাত একটি অভিযানের নাম ছিলো ‘অপারেশন জ্যাকপট’। পরে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে ওর একটা বই বেরিয়েছিলো। সেই থেকে আমি ওকে ল্যান্ডিপট নামেই ডাকি। অনেকদিন পর দেখা হলো ল্যান্ডিপট আর ওর স্ত্রী তৃষ্ণার সঙ্গে। আরও ছিলো ওদের কনিষ্ঠপুত্র প্রেম। আমাকে দেখেই হইহই করে উঠলো তৃষ্ণা আর ল্যান্ডিপট। কতোদিন পর দেখা!
তুমুল আড্ডায় সেজান জানালো–আমাদের খুব মন খারাপ থাকলে তৃষ্ণা বলে রিটন ভাইকে ফোন দাও। তারপর আমরা কনফারেন্স কলে কথা বলি তিনজন। শুরু হয় তুমুল হাসির ফোয়ারা। রিটন ভাই আমাদের মন ভালো করে দেন অনায়াসে।

সেজান বারবার অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে বাইরে একটু কফি পান করতে যেতে তাগাদা দিতে থাকে। আমিও সেরকম কিছুর অপেক্ষাতেই ছিলাম। এতো সাহিত্য প্রাণে সহে না। আমাদের সঙ্গী হলেন আবদুল হাসিবও। পার্কিং লটে গিয়েই টের পেলাম আমার জন্যে অপেক্ষা করছে নতুন একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা। সেজানের টুকটুকে লাল গাড়িটা আমাদের নেবে বলে দরোজা মেলে ধরলো আকাশ পানে। হাসিব খানিকটা চমকালেও আমি চমকালাম না। কারণ আমি বুঝে গেছি সেজানের এই গাড়িটা খুবই দামি এবং আধুনিক বিজ্ঞানপ্রযুক্তির অনবদ্য এক উপহার। গাড়ির নাম তেসলা। দামটা কল্পনারও অনেক দূরের। গাড়িতে বসার পর মহা উৎসাহে সেজান তার নতুন গাড়িটার কেরামতি দেখাতে লাগলো একের পর এক। গুগল মামার সুবাদে এই গাড়ির অনেক কেরামতি আমার জানা থাকলেও আমি না জানার ভান করে অভিনয় করে গেলাম। আমি চাইছিলাম আমার ভীষণ প্রীতিভাজন অনুজপ্রতীম ছড়াকার ছোটভাইটি খুশি হোক। ছড়াকারদের যে কোনো প্রাপ্তিতে অর্জনে আমি খুশি হই। এটা সেজানের জানা বহু আগে থেকেই। চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভাডে পড়াশুনা আর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার ক্ষেত্রে সেজানের বিপুল সাফল্য অর্জনে এমনিতেই মহা আনন্দিত আমি। ওর তেসলা গাড়ি অর্জনটিও তাই আমার কাছে বিশেষ কিছু। সেজান তার গাড়ির ম্যাজিক দেখায় আর আমি উল্লসিত হই। এক পর্যায়ে মহা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সেজান বললো–সরি রিটন ভাই আমি কিছুটা শোঅফ করছি। আপনি শোঅফ ভাবলেও আমি করবোই। আমি বললাম, করো। আমি মজা পাচ্ছি।

একটা লেনে গাড়িকে নির্দিষ্ট স্পিড দিয়ে ক্রুজে থাকার নির্দেশ দিলো সেজান। সমুখবর্তী গাড়িটার কাছাকাছি গিয়ে গাড়িটা অটো সিস্টেমেই স্লো হয়ে গেলো। কোনো কলিসন হলো না। সেজান ব্রেকও চাপেনি। কিছুক্ষণ চলার পর গাড়িটা নিজের থেকেই লেন বদল করলো নিরাপদে। কী তামশা!
তেসলা গাড়িতে কোনো তেল খরচ নেই। ইলেক্ট্রিকে চলে। নির্দিষ্ট পেট্রোল পাম্পে নিয়ে চার্জ দিতে হয় ব্যাটারি। গাড়ির দামটা এতোই আকাশ ছোঁয়া যে প্যাকেজে সেজান আজীবন বিনামূল্যে ব্যাটারি চার্জ করাতে পারবে।
খুবই আনন্দময় ছিলো আমাদের সেই বিকেলের তেসলা ভ্রমণ।

প্রথম দিন রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের টাইম ম্যানেজমেন্ট খুবই খারাপ ছিলো। অনুষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে জড়িতরা বুঝতেই পারেননি কাকে কতোটা সময় দিতে হবে। যে কারণে ব্যাপক অপচয় হয়েছে সময়ের। নিউইয়র্ক থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছড়াকার-অঙ্কন ও সঙ্গীতশিল্পী তাজুল ইমাম। আসর জমানো গায়ক হিশেবে তুলনাহীন তিনি। কিন্তু তাজুল ইমামের আগে তাল-লয়-সুরের ধার না ধারা শিল্পীকে টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে দর্শকদের শ্রুতিকে নিপীড়নের সুযোগ করে দেয়াতে বিখ্যাত তাজুল ইমাম দু’টির বেশী গান গাইতে পারেন নি। মন্ট্রিয়ল থেকে মনিকা মুনা আমন্ত্রিত হয়েছিলো সঙ্গীত পরিবেশনের জন্যে। মনিকা মুনার সঙ্গীত প্রতিভা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু মাত্র দু’টো গানের বেশি সময় তাকে দেয়া হয়নি। সময় দেয়া হয়নি সেজান মাহমুদকেও। মাত্র তিনটি গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিলো সে। বেহালা শিল্পী বিপ্লব সমাদ্দার আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ভিন্ন এক শহর থেকে। বিপ্লব ছিলেন অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পারফর্মার। তার জন্যে সময় বরাদ্দ ছিলো দশ মিনিটেরও কম। নিরাপত্তা রক্ষীরা হলের আলো নেভানোর জন্যে তৎপরতা চালাচ্ছিলেন। অডিটোরিয়ামও ছিলো প্রায় দর্শকশূন্য। ওই অল্প সময়েই বিপ্লব বেহালার সুরের অপরূপ ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেছিলেন। আর সবার মতো মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ছিলাম আমিও।

প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে উইঙ্গেট হোটেলে ফিরে এসে দেখি এলাহী কান্ড! লবি-ক্যাফেটেরিয়ার একটা টেবিলে বিশাল দু’টো কেক অপেক্ষা করছে। ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর অতিক্রম করলেই জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের জন্মদিন। একই দিনে জন্মেছেন মোহাম্মদ ইরফান এবং সেজান মাহমুদও। শ্যাম্পেইনের ফেনায়িত উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে উদযাপন হলো তিনজনের হ্যাপি বার্থ ডে পার্টি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম, একটু পরেই শুরু হবে আরেকটি পর্ব। পাকিস্তানের এক শায়ের এসেছেন। তার শের-শায়েরি শুরু হবে। সারাদিন বাংলা সাহিত্য আর বাংলা সংস্কৃতির জয়গান গেয়ে রাতেই পাকিস্তানি শের-শায়েরির অনুষ্ঠানে শামিল থাকতে মন মোর নহে রাজি। কেটে পড়লাম দ্রুত। রুমে ফিরে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
পরদিন সকালে জানলাম, হাসান মাহমুদের পরিচালনায় সেই অনুষ্ঠান ভোর পাঁচটা পর্যন্ত বহাল ছিলো। উৎসাহী কবিদের স্বরচিত কবিতা, পাকিস্তানি শের-শায়েরি আর শাওন-মুনা-সেজানদের গানের মাধ্যমে উদযাপিত হয়েছে লেখকত্রয়ীর জন্মজয়ন্তী।


দু’দিনের সাহিত্য সমাবেশ শেষে ২ সেপ্টেম্বর সকালে ঝটিতি সফরে সাদ কামালী আমাকে আটলান্টার কয়েকটা দর্শনীয় বা দ্রষ্টব্য স্থানে নিয়ে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত হলো। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী লাজুল এবং লেখক এক্টিভিস্ট হাসান মাহমুদ। এই তিনজনার নিবাস টরন্টোয়। সাদ কামালী বললেন, সময় খুব কম। কম সময়েই যাওয়া যেতে পারে এখানকার বিখ্যাত এক্যুরিয়ামে। যেতে পারেন কোকা কোলা ভবন, সিএনএন ভবন এবং মার্টিন লুথার কিং-এর বাড়িতে এবং মিউজিয়ামে।
আমি ফার্স্ট চয়েস হিশেবে মার্টিন লুথার কিং-এর বাড়ি এবং মিউজিয়ামের কথা জানালাম। এক্যুরিয়ামের ব্যাপারে অনাগ্রহের বিষয়টিও বললাম।
মার্টিন লুথার কিং-এর বাড়ি যাবার আগে বুড়ি ছোঁয়ার মতো করে সিএনএন ভবন, ওয়ার্ল্ড অব কোকাকোলা, মার্সিডিসবেঞ্জ স্টেডিয়াম দেখা হলো।

মার্টিন লুথার কিং-এর জন্মবাড়িতে গিয়ে অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করলাম। নেইবারহুডের খুবই মামুলি ধরণের ছোট্ট একটা বাড়িতেই পৃথিবীকে পালটে দেয়ার অনন্য সাধারণ আলোর দ্যুতি নিয়ে জন্মেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র নামের কালো মানুষটা! কিন্তু আমেরিকার বর্ণবাদ তাঁকে খুন করেছিলো। কারণ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে খুন না করলে সেই সময় একজন কালো মানুষকেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে হতো আমেরিকাকে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের রক্তের সিঁড়িপথ পেরিয়েই পরবর্তীতে বারাক ওবামা নামের একজন কালো মানুষ হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন।

২ সেপ্টেম্বরের রৌোদ্রকরোজ্জ্বল সেই সকালটা ছিলো কেমন একটা আনন্দ আর বিষাদ মাখা। বারবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলাম। মার্টিন লুথার কিং ন্যাশনাল হিস্টরিক্যাল পার্কের কাছেই, রাস্তার উল্টোদিকে ‘দ্য কিং সেন্টারে’ গিয়ে দেখি বিশাল চৌবাচ্চা ধরণের একটা স্থাপনার নীল জলের বিস্তার পেরিয়ে দেয়ালজুড়ে মার্টিন লুথার কিং-এর অনেকগুলো ছবি। জলে তার ছায়া পড়েছে। চোখে বিভ্রম জাগে। জ্বলজ্বলে চোখের শানিত সম্মোহনী দৃষ্টির স্নিগ্ধ কিন্তু বলিষ্ঠ অবয়বের কালো স্যুট পরা মার্টিন লুথার কিং আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন! মাদকতা মাখা একটা সৌরভ ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। আমি তাঁর জুতোর শব্দও স্পষ্ট শুনতে পেলাম যেনো। আর আমার কানে অবিরাম বেজে চলেছে মার্টিন লুথার কিং-এর সেই অবিস্মরণীয় কণ্ঠস্বর–আই হ্যাভ এ ড্রিম……!

অটোয়া ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

[ আলোকচিত্র/ আফাজউদ্দিন তোতন, আরশাদ সুমন এবং লাজুল।]

মন্তব্য করুন