মৌরি হক দোলার গল্প ‘সুখ, তুমি কোথায়?’

নিজের সম্পকের্ মৌরি হক দোলা বলেছেন :

সবে কলেজ পাস করলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি করতে আর ব‌ই পড়তে খুব ভালোবাসি। কয়েক বছর আগে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় লেখালেখিতে আমার হাতেখড়ি। সপ্তম শ্রেণিতেই বাবার পত্রিকার সুবাদে নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।‌ বাবার নিজের ব্যবসা সম্পর্কিত পত্রিকা। সেখানে এক কোণায় আমার জন্য সর্বদা এক পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকতো। কারণ আর কিছুই না। শুধু আমাকে উৎসাহ দেয়া। অনেক বছর আগে আমার মা লিখতেন। গদ্য‌ও লিখতেন, তবে পদ্যে তার টান বেশি ছিল। সংসার জীবনে ঢুকে সব যেন অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। সংসার, চাকরি, মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়ন… সেই ডুবে যাওয়া স্বপ্ন আবার ভেসে উঠেছিল আমার লেখনী দেখে। মাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কখনো ভেবেছিলে তোমার মেয়ে লিখবে? ব‌ই বের হবে তার? মায়ের উত্তর ছিল, আগে কখনো ভাবিনি। কিন্তু যেদিন পুরোনো ডায়েরিটায় তোর লেখা পড়েছিলাম, সেদিন একবার মন বলেছিল। ছোটগল্প লিখতাম নিজের খাতায়। নিয়ম করে বাবার পত্রিকায় তা ছাপা হতো। ক্লাস টেনে পড়ার সময় বাসায় প্রথম নেট কানেকশন আসে। তখন খোঁজ পেয়েছিলাম “গল্প কবিতা ডট কম” নামক লেখালেখির এক প্ল্যাটফর্মের। প্রতি মাসে সেখানে একটি করে গল্প পাঠাতাম। অন্যান্য শ্রদ্ধেয় লেখক আপু-ভাইয়ারা তা পড়ে আমাকে উৎসাহ-পরামর্শ দিতেন। এরপরে ব্লগ নিক খুললাম। পরিকল্পনা না থাকলেও ঘটনাক্রমে ২০১৯ একুশে ব‌ইমেলায় আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ আনলাম। ছোট্ট কলেজ জীবনের দুই বছর নানা কারণে লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম কিংবা দূরে থাকতে হয়েছিল। এরপর করোনা কালটা অমানিশার মাঝেও আমার লেখালেখির জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। ছোট ছোট দুটো উপন্যাস লিখে ফেললাম। তার একটি সময়ের স্পন্দন- মৌরি হক দোলা এলো সেপ্টেম্বর মাসে জনতা প্রকাশ থেকে ব‌ই আকারে। আরেকটি উপন্যাস “পরিবেদন” পান্ডুলিপি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে কুহক – Kuhok কমিক্স এন্ড পাবলিকেশন থেকে ব‌ই আকারে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। ইনশাআল্লাহ এ বছরই আসবে সে। আশা করি, খুব ভালো লাগবে আপনাদের ব‌ইটা। সামনে ভর্তি পরীক্ষা। তবুও না লিখে থাকতে পারি না। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে গল্প সাজিয়ে যাই। কারণ সত্যি বলতে, লেখালেখিটাই আমার প্রাণ! ব‌ইয়ের পরে কলম আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এ দুটি যদি কখনো হারিয়ে যায়, তবে আমিও হারিয়ে যাবো চিরতরে…

সুখ, তুমি কোথায়/মৌরি হক দোলা

এক.
মফস্বল শহরের সাথে এই ব্যস্ত রাজধানী নগরীর যে পার্থক্য তা তোমার চোখ এড়িয়ে যায়নি। যেদিন মেঘনা নদীর বুকে স্রোত কেটে এপারে এসে উঠলে সেদিনই বুঝতে পারলে যে, তোমার আগের ঠিকানা আর এই ঠিকানার মধ্যে বিস্তর তফাত রয়েছে। দুটো ঠিকানা কোনোভাবেই এক নয়। হতে পারে তোমার বয়স কম, সবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছো, সাথে শৈশব কাটিয়ে কৈশোরের দিনগুলোতে এক পা রেখেছো মাত্র, তবে তোমার এই ছোট্ট জীবনে যে অভিজ্ঞতার ঝুলি তা তোমাকে অনেক বেশি পরিণত করে তুলেছে। সেই পরিণত মন এই অদ্ভুত নগরে প্রথমবারের মতো পা দিয়েই বুঝতে পেরেছে নতুন করে তোমার জীবন শুরু হলো আবার। বিগত দশ বছরের সাথে এই জীবনের কোনো মিল নেই। শুধু অমিলের খেলা সেখানে চুপিচুপি তোমার ছোট্ট হৃদয়কে বেদনার্ত করে যায়।
একা বাসায় যখন তুমি বারান্দায় এসে দাঁড়াও, তখন তোমার চোখের সামনে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দেয়াল ছাড়িয়ে আরো একটি দেয়াল। সেই দেয়ালের অপরপাশে কি আছে তা তোমাকে প্রভাবিত করে না। কারণ তখন তোমার মানসপটে ভেসে ওঠে সেই ফেলা আসা দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি। খোলা আকাশ, উন্মুক্ত মাঠ, উপজেলা চত্বরে ঘাটলা বাঁধানো বিশাল পুকুরের এপাশ-ওপাশ, স্কুলের চমৎকার দিনের গল্প আর বিকেলবেলা ফুটবল নামক বস্তুটি নিয়ে যে একে অপরের সাথে খেলার ছলে আনন্দলাভ, সেইসব স্মৃতি। আর কি মনে পড়ে তোমার? মায়ের কথা মনে পড়ে? যার কোলে মাথা রেখে অজস্র রাত কেটেছে, যার রক্তিম চোখের দিকে তাকাতে তোমার কখনো সাহস হয়নি, আর তোমার অসুস্থতার দিনগুলোতে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে শুধু তোমাকে সুস্থ দেখবে সেই অপেক্ষায়।
মায়ের কথা মনে পড়তেই তোমার বুক চেপে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! কেন এমন হলো? ছোট্ট এ জীবনে কেন এমন বেদনা বিধুর ঘটনা ঘটে মানুষের সাথে? কোনো উত্তর নেই। শুধু তোমার মনের মাঝে প্রশ্নেরা খেলা করে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। সেই ঝাপসা চোখে তুমি দেয়ালে টাঙানো বড় ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে সময় দেখে নাও। চারটে বাজে মাত্র। বাবার অফিস থেকে ফিরতে এখনো ঢের দেরী। আচ্ছা, গত কয়েকদিন যাবত তোমার মনের মাঝে যে ইচ্ছেটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, তাকে একবার পাত্তা দিয়ে দেখবে কি?

দুই.
চলতে চলতে তুমি এক বিশাল মাঠের কাছাকাছি চলে এলে। এই মাঠে অনেক গাছপালা আছে। দেখে মনে হচ্ছে সবুজের মেলা বসেছে যেন। দৈত্যসম বাড়িঘরের এই শহরে যে এমন প্রাণের খোঁজ পা্ওয়া সম্ভব তা তোমার ধারণার বাইরে। তোমার মনের মাঝে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। একটু একটু করে তুমি বাগানের ফটকের দিকে এগিয়ে যাও। এই যে এতো সবুজের ছোঁয়া, তবুও যেন এখানে তোমার ফেলে আসা সেই ছোট্ট শহরের সাথে যে দূরত্ব তা লেপ্টে আছে প্রকটভাবে। এখানে বিশাল এক মাঠ আছে ঠিক, কিন্তু তা উন্মুক্ত নয়। চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া তাকে বেঁধে রেখেছে।
তবুও তোমার মন ভালো হয়ে যায়। কত মানুষ, কত আনন্দ! তোমার বয়সীও অনেকে আছে দেখা যাচ্ছে। তারা কোথাও দল বেঁধে খেলছে। কোথাও একা একা দৌড়ঝাঁপ করছে। কয়েকজনকে দোলনায়ও দেখা গেল। হ্যাঁ, বড়রাও আছে। তবে তারা নিজেদের মতো করে। যেন সন্তানদেরকে এক করে দিয়ে তারাও খুঁজে নিয়েছে তাদের অবসর কাটানোর সঙ্গীদের। একে অপরের সাথে গল্পে মেতে উঠেছে তারা।
তুমি এই মুহুর্তে একটি বেঞ্চিতে বসে আছো। চুপচাপ দেখছো সবাইকে। এতদিন বন্দি ঘরে তোমার দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা হয়েছিলো। যে তুমি এক বিন্দু ঘরে থাকতে চাইতে না কখনো, সেই তুমি গত এক সপ্তাহ যাবত সম্পূর্ণ আলো-বাতাসের বাইরে একা একা ছিলে! কিভাবে পারলে সেটা তোমার মনেও প্রশ্ন তুলে।তবে যাই হোক, এতদিন পরে যে সেই আলো-হাওয়ার সংস্পর্শ খুঁজে পেয়েছো, এতেই তুমি খুশি। এই খুশিতে তোমার আানন্দিত মন একখানা বুদ্ধি এঁটে ফেলে। এখন থেকে রোজ বিকেলে সে তোমাকে এখানে নিয়ে আসবে। তুমি তোমার মনের কথায় ঘুরে যাবে এই আনন্দের কোলাহল থেকে। বাবা ভুল করেও কিচ্ছুটি জানতে পারবে না।
তোমাকে একা বসে থাকতে দেখে একটি ছেলে এগিয়ে এলো। ছেলেটার বয়স তোমার মতোই হবে। পরনে মলিন পোশাক, উষ্কখুষ্ক চুল আর চেহারার রুক্ষতা তার অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে যেন। তার গলায় একটুকরো লম্বা কাপড় দিয়ে বাঁধা একটি স্টিলের তৈরি পাত্র। পাত্রটিকে ছেলেটির শরীরের তুলনায় বড় দেখায়। তবুও বেশ স্বচ্ছন্দ্যে সে সেটি বহন করছে। পাত্রটির উপরে একটি লাল-সবুজ রঙের গামছা ছড়ানো। গামছার আড়ালে কি আছে তা বোঝা মুশকিল। ছেলেটি তোমার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার প্রথম প্রশ্নেই তুমি বুঝে নিলে ছেলেটি একজন বাদাম বিক্রেতা।

  • বাদাম খাইবেন, ভাই?
  • – বাদাম..? কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নাই।
  • নেন না ভাই, পাঁচ টাকার নেন অন্তত।
  • – আমার কাছে সত্যি টাকা নাই ভাই। থাকলে নিতাম।
  • ও…
  • ছেলেটি আবারো এগিয়ে যায়। তুমি একা একা বসে থাকো আগেরই মতো। হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ যায় তোমার। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে দলবেঁধে। কোথায় যাচ্ছে তারা? ঘরে ফিরে যাচ্ছে কি? তোমাকেও তো যেতে হবে! কিন্তু তোমার যে মন টানছে না। পার্কের নানাবিধ মানুষের রঙবেরঙের জীবনের কার্যকলাপ উপভোগ করছো তুমি। কি জানি কি ভাবতে ভাবতে বেশ আনমনা হয়ে পড়লে তুমি। ইদানিং এই ব্যাপারটা তোমার সাথে প্রায়ই ঘটে। উদাসীনতা তোমাকে জড়িয়ে বিমূঢ় করে দেয়। ‍তুমি জানো না তখন তোমার মনের মাঝে আসলে কি চলে। কোন চিন্তা খেলা করে তোমার ছোট্ট মনের আঙিনায়। শুধু বুকের একপাশে চিনচিন করে। তোমার হৃদপিন্ড থেকে শুধু একটি শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হয়, মা…
  • তোমার আনমনা ভাব কেটে যায়, যখন তুমি বুঝতে পারো তোমার পাশে কেউ এসে বসেছে। সেদিকে চোখ ফিরিয়ে নাও। বাদামওয়ালা সেই ছেলেটি। দুজনের মাঝে তার বাদামের পাত্রটি রেখে গামছায় ভেজা নাক-মুখ মুছে নিচ্ছে। বেশ গরম পড়েছে আজ। বেশ আফসোসের সুর নিয়ে সে বলে উঠে-
  • – আইজ শ টাকার বাদামও বেচতে পারলাম না! হুদাই বেগার খাটনি। বাদাম খাইবেন ভাই? খান? টাকা দেয়া লাগবো না। আহেন দুইজনে বইসা বাদাম চিবাই। ভাললাগবো।
  • তোমার নাম কি?
  • – আমার নাম? আমার নাম পটলা। আফনের নাম?
  • আমার নাম বাদল। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো পটলা?
  • – কেলাস? হিহি.. আমি পড়ালেখা করি না ভাইজান। সারাদিন এই পার্কে ঘুইরা ঘুইরা বাদাম বেচি। পড়ালেখা করনের টাইম কই আমার?.. লন, লন, বাদাম খান। আরেকদিন বাসার তন টাকা আইনা দিয়া দিয়েন।
    তুমি বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে পটলার সাথে কথা এগিয়ে নিচ্ছো। খুব কৌতূহল হচ্ছে তোমার। তোমার বয়সী একটা ছেলে পড়াশোনা করে না, পার্কে বাদাম বিক্রি করে বেড়ায়। খুব অদ্ভুত!
  • তুমি থাকো কোথায়?
  • – বেশি দূরে না, ওই যে বড় রাস্তার ওইধারে। যাইবেন? লন, আপনেরে দেখায় আনি আমার থাকনের জায়গা।

তিন.
এই নিয়ে আজ চতুর্খ দিন তুমি পটলাদের বাসায় এলে। ঠিক বাসা নয়, বড় রাস্তার পাশে ফুটপাতের উপরে পলিথিনের ছাউনি দেয়া। তিনপাশেও বেশ মোটা করে পলিথিনের আস্তরণ। বেশ অদ্ভুত ধরণের বাসা। তুমি এর আগে কখনো এরকম বাসা দেখোনি। এই প্রথমবার দেখলে। তবে এরকম অদ্ভুত বাসায় শুধু পটলারা থাকে না। তাদের সাথে আরো দুটি পরিবার থাকে। প্রতিটা ঘর খানিকটা দূরত্ব রেখে পাশাপাশি। এই ঘর দেখে তোমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়, তখন তোমার বয়স পাঁচ-ছয় বছরের বেশি নয়। মাঝেমাঝে যখন দাদুবাড়িতে যেতে, তখন সব চাচাতো ফুফাতো ভাইবোনেরা নানাধরণের খেলায় সময় পার করতে একসাথে। সেইসব খেলার মধ্যে অন্যতম ছিলো কলাপাতার ঘর বানানো। বাড়ির পেছনদিকের কলা গাছের পাতা আর খড়ি-সরকি দিয়ে বেশ ছোট আকারের ঘর বানাতে তোমরা। সেই ঘরে অবশ্য সবাই একসাথে থাকতে পারতে না। একজন একজন করে ঢুকে পড়তে, কিছুক্ষণ বসে থেকে ভুবনজয়ী হাসি মুখে নিয়ে আবার অপরজনকে সেই ঘরে মিনিট কয়েকের জন্য বাস করার সুযোগ দিতে। কিন্তু প্রতিবারই কেউ না কেউ চারপায়ে ঘরে ঢোকার সময় কিংবা বের হওয়ার সময় অসচেতনভাবে শরীরী আঘাতে ঘরকে দুর্বল করে দিতো। তখন আচমকা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তো কলাপাতার ঘর।
কিন্তু কি আশ্চর্য! ঠিক সেইরকম ছোট্ট ঘরে গোটা পরিবার বসবাস করছে! তুমি যতবার পটলাদের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়াও, ততবার তোমার আশ্চর্য লাগে। মনে হয় এ যেন ছোট্ট এক স্বর্ণপুরী। এই ছোট্ট স্বর্ণপুরীতে পটলারা সাত-আটজন কষ্ট করে থাকে। কিন্তু তবুও যেন তারা খুব আনন্দে আছে। খোলা রাস্তার পাশে ফুটপাতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করার কোনো দুঃখ তাদের মনে ঠাঁই পায়নি। দিন আনে দিন খায়, রাতে সবাই ছোট্ট কুটিরে একে অপরের গাঁ ঘেষে ঘুমায়- সকালে ঘুম ভাঙার পরে তাদের চোখেমুখে তৃপ্তির ছোঁয়া লেগে থাকে।
পটলার মা আস্তানার পাশেই চুলো পেতে পিঠে বানাচ্ছে। লোকজন তার সামনে দিয়ে আসছে-যাচ্ছে, কেউ কেউ পয়সা দিয়ে পটলার মায়ের থেকে পিঠে কিনে নিচ্ছে। চিতেই পিঠা। এক খাঁজে পাঁচটি করে পিঠা হয়। তোমাকে দেখে পটলার মায়ের মুখে স্নেহমাখা হাসি ফুটে উঠে। এই হাসিখানা তুমি যতবার দেখো, তোমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। তোমার মাও ঠিক এইভাবে হাসতেন। শীতের সন্ধ্যায় মাটির চুলোতে চিতই পিঠা বানাতেন তোমার জন্য। কেমন আছেন মা? তিনি কি এই শীতেও পিঠে বানাচ্ছেন?
পটলা তোমাকে নিয়ে চুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে পটলার মায়ের পাশে বসা অল্পবয়সী মেয়ের চোখে জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে। এই মেয়েটিকে তুমি গত তিনদিন দেখোনি। পটলার বড় বোন, সপ্তাহখানেক আগে এসেছে এখানে। এতদিন স্বামীর সাথে ঢাকা শহরের অন্য কোনো রাজপথে তার বাস ছি্লো। কিন্তু সেই অস্থায়ী আবাস তার জন্য হারিয়ে গেছে চিরতরে। এই হারিয়ে যাওয়া-যাওয়ির পায়তারা অনেকদিন যাবতই হচ্ছিল। কিন্তু সে দাঁতে দাঁত চেপে পড়েছিলো এতোদিন। স্বামীর ঘর! বললেই কি চলে আসা যায়? কিন্তু এবার আর কোনো উপায় হলো না। পটলার দুলাভাই নতুন বউ ঘরে তুলে পটলার আপাকে ঘাড় ধরে তাদের অস্থায়ী নিবাস থেকে বের করে দিল। ছোট্ট একটা কাপড়ের পোটলা বুকের মাঝে নিয়ে সেও কাঁদতে কাঁদতে এসে পুরোনো ঠিকানায় উঠেছে সপ্তাহখানেক আগে। আর কখনো ফিরে যাবে না সে। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে পারলেও, সতীনের সংসার করা তার পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব। সংসার! রাস্তার ধারে এক টুকুরো পলিথিনের আড়ালে ছোট্ট একটা সংসার। তবুও তা একজন নারীর নিতান্তই আপন। কারো সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া যেকোনো মেয়ের পক্ষেই কষ্টসাধ্য।

  • এইডা কেডা, মা?
  • – ওই যে তোরে কইলাম না, আমাগো পটলার লগে মাঝেমাঝে একটা বড় সাহেবের পোলা আহে। ওই।
  • ওহ। তোমার নাম কি বাবু?
  • – আমার নাম বাদল।
  • ও। তোমার বাসা কই?
  • – এইতো বেশি দূরে না। পার্কের ওইপাশেই। এখান থেকে যেতে ঠিক ঠিক পনের মিনিট লাগে।
  • তুমি যে এখানে আইছো, তোমার বাপ-মা জানে? হেরা চিন্তা করবো না তো?
  • তুমি মাথা নিচু করে নিরুত্তর বসে থাকো। কিছুক্ষণ পরে পটলার মা মেয়ের কথায় উত্তর দেয়, আর কইস না, মা। বড় বড় মানুষের বড় বড় কারবার। ওর মায়ের লগে তো ওগো কোনো যোগাযোগ নাই। ওরা থাকে এইহানে, ওর মায় থাকে আরেকহানে। হেই জায়গায় নিকা বইছে আবারো। এই পোলা না কি এতোদিন ওর মার লগেই আছিল। এহন এই মাসখানেক অইছে ওর বাপে নিজের কাছে নিয়া আইছে ওরে।
  • ওর বাপেও কি বিয়া করছে?
  • না। ওর বাপে এখনো করে নাই। তয় ব্যাডা মানুষ, করতে কতক্ষণ? তহন এই চান্দের লাহান পোলাডার কি অবস্থা অইবো ক দেহি। কোনো মা নি পারে নিজের প্যাটের পোলারে দূরে সরায় রাখতে?
  • হুমম। কপাল কপাল! সবই কপাল! কারো ঘর ভাঙে চাঁন না পাওয়ার কারণে, আর কারো ঘর ভাঙার কারণে চাঁনের মনে দাগ লাগে!
    তুমি পটলার মা বোনের কথা শুনো ঠিকই, কিন্তু অনেক কিছু যেন তোমার বোঝাবোঝির সীমানার বাইরে রয়ে যায়। তবে মায়ের কথা হচ্ছে আর তা যে সুখকর কিছু না, এইটুকু বিষয় তোমার বুকের মধ্যে হাহাকার তৈরি করে। পটলার মায়ের কাছে এলে তুমি যেন কি সুখ খুঁজে পাও। তাই বাবাকে না জানিয়ে বারবার ছুটে আসো এই পথে। তবে আজ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর এক মুহুর্তও এখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ পরপর মায়ের মুখখানা মনের আয়নায় ভেসে উঠছে।
  • আন্টি আমি আজকে যাই।
    — এখনি যাইবা গিয়া? আহারে তোমারে দি আইজ পিডা দিলাম না। বহো, একখান খাইয়া যাও।
  • না, আন্টি, আরেকদিন খাবো। আজ যাই।
    রাস্তার একপাশ ধরে তুমি হাঁটতে থাকো। পটলা পেছনে ওর মা-বোনের সাথে বসে আছে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরে এক এক করে পটলার বাকি সব ভাইবোন ঘরে ফিরবে। কেউ কেউ গোলাপ ফুল বিক্রি করে, কেউ বা লাল-নীল বেলুন। সন্ধ্যা রাতের শেষে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসবে পটলার বাবা। সবাই একসাথে এক পাতে ভাত খাবে। সাথে থাকবে হয়তো কাঁচা মরিচ আর ঠান্ডা পানি। কি সুন্দর সুখী পরিবার!
    সূর্যটা রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে আশেপাশে। কিন্তু তোমার কোনো তাড়া নেই। আজও বাবার ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হবে। হঠাৎ তোমার মনে প্র্শ্ন খেলে যায়। আচ্ছা, সুখ কি একাকীত্বের দালানকোঠায় আছে না রাজপথের ছোট্ট কোলাহলমুখর কুটিরে?
    মৌরি ফুলের গল্প

মন্তব্য করুন