রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ; একজন শব্দ শ্রমিক এর কথা// রহিম ইবনে বাহাজ


রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলাদেশের কবিতায় একাধিক বার উচ্চারিত একটি নাম। তারুণ্য যদি জীবনের গতিময়তার প্রতিক হয় আর কবিতা যদি হয় সেই প্রতীকের শিল্পিত প্রকাশ, তা হলে সেই ভূমিকায় রুদ্র’র পরিচয় নিজে। রুদ্র’র কবিতা যাঁরা মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছেন কিংবা করবেন, তারা এটা অবশ্যই লক্ষ্য করবেন, যে কেন্দ্র হতে তাঁর অভিযাত্রা সূচনা বহুপথ ঘুরে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জীবনের স্বপ্ন ও সংগ্রাম, প্রেম ও বিরহ বন্ধন ও বিচ্ছেদ সব কিছুর মধ্যে ও কেন্দ্রাতি সংলগ্নতা হতে সে বিন্দু মাত্রও বিচ্যুত হয়নি। পথ চলতে বার বার হোচট খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে অসুন্দরের প্রলোভনে সমর্পিত হয়ে ও সে কখনো আত্ম বিক্রিত ক্রীতদাসে পরিণত হয়নি।
রুদ্র’র কবিতার প্রধান প্রবনতা দ্রোহ। বাংলা কবিতার এক অন্যতম ধারার প্রতিনিধি হিসেবে এর উওরাধিকার বহন করতে গিয়ে রুদ্র কখনো কখনো উচ্চকিত রূঢ় কন্ঠের ধারক হওয়া সত্বেও কবিতার শৈল্পিক অঙ্গিকার সে অস্বীকার করেননি। আমাদের দূভাগ্য যে কাজ সমাজ কর্মী র যে কাজ রাজনীতিকদের এদেশের সেই কাক টি র সাহসী সূচনা সব সময়ই করতে হয়েছে কবিদের। স্বাধীনত্তোর বাংলাদেশে এই দাবি তীব্র হওয়ায় কবিদের ওপর সে গুরুভার অর্পিত হয়েছে তার বোঝা কাঁধে নিতে যে কজন কবি সামনের কাতারে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার মধ্যে অন্যতম সে কারণেই রুদ্র’র কবিতা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে শুধু মাত্র কণ্ঠ স্বর,শুধু মাত্র শ্লোগান। রুদ্র নিজেও এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন ছিলেন। তাই ধীরে ধীরে সে নিজেকে সংযত ও সংযমী করে তোলার কাজে নিয়োজিত হয়ে ছিল কিন্তু পরিণত হওয়ার আগেই অকাল মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে যাওয়াতে সেই কর্মোদ্যোগ সফল করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না আমরা বঞ্চিত হলাম সম্ভাবনাময় এক তরুণ কবির পরিণত প্রয়াসে শিল্পিত ফসলের আস্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ থেকে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কবিতা রচনার সূচনা স্কুল জীবন থেকে শুরু হলেও মূলত পঁচাত্তর সালের পরেই তার সরব উপস্থিতি বাংলাদেশের কবিতার ভুবন উচ্চকিত করে তোলে,কবি কন্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতা কে শ্রোতাপ্রিয় করে তোলে রুদ্র তাদের অন্যতম। রুদ্র’র অনেক কবিতাই এই শ্রোতাদের লক্ষ্য করে লেখা। তাই তাঁর কবিতার অনেক গুলোই মঞ্চ সফল কবিতা। রুদ্র আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল সে কারণে সে কখনো পরাজিত হতে চায়নি জীবন মানে সংগ্রাম, জীবন মানে দু’পা পিছিয়ে আবার চা’র পা এগিয়ে যাওয়া এই বিশ্বাসের জোরই সে এগিয়ে যেতে পেরেছে। রুদ্র সব চাইতে বড় বৈশিষ্ট্য সম্ভবত এইযে সে এদেশের আত্মাকে ভালোবেসে ছিলো একে শুধু দেশ প্রেম বলা যায়না একে বলা যেতে পারে মাতৃ প্রেম। সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সদস্য না হওয়া সত্বেও সে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বস্ত কবিদের অন্যতম। “আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই” কিংবা ‘ জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছ সেই পুরনো শূকন’ এই দুই বিখ্যাত কবিতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির প্রতি তার যে ঘৃণা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাতে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলাদেশের এক ব্যাপক জনগোষ্ঠীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছে। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ গণ আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসা¤প্রদায়িক, স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে রুদ্র’র কন্ঠ ছিল উচ্চকিত। এই উচ্চকিত কন্ঠের কবিতা সমূহের অধিকাংশই সফল কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু সমাজের দাবি মিটিয়েছে। এবং সময়ের দাবী মিটিয়েছ । বাংলা কবিতার বিচারে এমন কি বাংলাদেশের কবিতার বিচারে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অবস্থান কোথায়, তা বিচার করবে সময়। সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নিজেকে সবসময় দাবি করেছেন আমি শব্দ শ্রমিক কবি দাবি করেন নি।
শব্দ – শ্রমিক
আমি কবি নই – শব্দ শ্রমিক।
শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়
হৃদয়ের কালো বেদনায়।
রুদ্র’ র গান এর সংখ্যা হয়তো বেশি নেই।
কিন্তু যে গান টি বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় শীর্ষে রয়েছে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এর সুরে গান স¤্রাট এন্ড্রু কিশোর দরাজ ভরা কন্ঠে”ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানা চিঠি লিখো” প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ ঠোঁট মিলিয়েছেন “তোমাকে চাই” সিনেমা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বেঁচে থাকতে তার ৭ টি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার্হ জন্ম ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে। শৈশব কেটেছে মিঠেখালি গ্রামে ও মোংলা ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে এস এস সি ১৯৭৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮০ ও ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় সম্মান ও এম এ পাশ করেন। প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ ৭ টি উপদ্রæত উপকূল (১৯৭৯), ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১),মানুষের মানচিত্র (১৯৮৪) ছোবল (১৯৮৬) গল্প (১৯৮৭) দিয়ে ছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮) ও মৌলিক মুখোশ। ২৯ জানুয়ারি ১৯৮১ তে বিয়ে করেন নির্বাসিতা লেখিকা তসলিমা নাসরিন কে, এবং ১৯৮৮’ সালে সাত বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টানেন। ১৯৯১ সালে ২১ জুন এই শব্দ শ্রমিক ও প্রতিভাবান তরুণ কবি অকালে মৃত্যু স্বাদ গ্রহণ করেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুগের পর যুগ বাঙালী জাতি স্বরণ করবে শব্দ শ্রমিক রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে।
অ:আ প্রকাশকাল: 12:30



কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য