লিপস-দুর্নীতির মহাকাব্য-১/হিফজুর রহমান

[মূল ঘটনায় যাবার আগে একটু বলে নেয়া দরকার আমার নিয়মিত পাঠকদের জন্যে। একটু বেশিই লিখতে হবে, নইলে অন্যায় হয়ে যাবে। এই লেখাটি দেশ (দৈনিক নয়, কারণ এখনও দৈনিক লেখার সুযোগ হয়নি তাদের) অনলাইনে নিয়মিত ছাপা হত। তবে পত্রিকাটি প্রকাশ হয়ে যাবে। সেটা অন্য ঘটনা। এরই মধ্যে আমার মেলবোর্নপ্রবাসী এক অনুজপ্রতীম বন্ধু শরীফ আস সাবের-এর ক্রমাগত উৎসাহ ও উষ্কানীতে ফেসবুকে লিখে ফেললাম ‘সামরিক শাসন ১৯৮২, সাংবাদিকতা জীবনের কথকতা…..’ শীর্ষক লেখাটি। সেটা ছিল আমার বাংলার বাণীতে কাজ করার সময়ের ঘটনা। ফেসবুকে যাওয়া মাত্রই জনাব সালেহ আহমেদ আমার সাথে যোগাযোগ করলেন মেসেঞ্জারে। তিনি বললেন, এই লেখাটি তিনি দেশ পত্রিকায় বহন করতে চান। আমি এক সালেহ আহমেদকে চিনতাম সেই বাংলার বাণীতে কাজ করবার সময়ে। তিনি সেখানে মাঝেমধ্যেই আসতেন। তিনি তখন সম্ভবত কাষ্টমস এর চাকুরী করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর শহীদ শেখ মনি বাংলার বাণী পত্রিকা প্রকাশনার পর জনাব সালেহ আহমেদ সেখানে সম্ভবত প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছিলেন, ১৯৭৫ সালে চারটি বাদে সব পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবার পর। তখন সালেহ আহমেদদের মত অনেকেই বিভিন্ন রকম , বিশেষ করে কাষ্টমস এর চাকুরী নিয়েছিলেন, আবার অনেকে নেনওনি, আমাদের মীর ভাইদের মত। আমার ধারণা, সেটাই ছিল জনাব সালেহ আহমেদের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা। ১৯ শতকের ৮ এর দশকের প্রথম দিকে আমি বাংলার বাণীতে কাজ করা কালে জনাব সালেহ আহমেদের সাথে দুই কি তিনবার দেখা হয়েছিল। তাঁর নিপাট ভদ্রতা আমাকে সেই যে আকর্ষণ করেছিল সেটা এখনও ভুলতে পারিনি। সালেহ ভাই শর্ত দিলেন, আপনি ফেসবুকে লেখাটা দেন, তবে প্রথমে যাবে দেশ এ তারপর ফেসবুকে। সালেহ ভইএর ¯েœহ মাখা ভদ্রতার কারণে তাতেই তথাস্তু বলতে হল। আর এই লেখাটা আসলে আমাকে অনেকটা স্মৃতিকাতর নেশায় পেয়ে বসেছিল। সালেহ ভাই তাঁদের “দ” প্রকাশনী থেকে এটা বই হিসেবেও ছাপতে চেয়েছিলেন। যাই হোক লেখা চলতে থাকল। সালেহ ভাই যৎকিঞ্চিৎ সম্মানীও দিয়েছিলেন এগারটা লেখার জন্য। সেটা বিষয় নয়। দেশ এ আমার সংযুক্তি ছিল কোন এক “হাকিম” এর সাথে। তার পদবী জানতামনা, পুরো নামটাও জানতামনা। তবে, অল্প সল্প গল্প এর যাত্রা আপাতত বন্ধ করছিনা। এর ত্রয়েদশ পর্ব গেছে শুধুই ফেস বুকে। আর চতুর্দশ পর্ব গেছে সাহিত্য ম্যাগাজিন আজ আগামীতে, বাকি আর যা যাবে সেটা আজ আগামীতেই যাবে।]


এবার মূল ঘটনায় আসি…….
২০০২ সালের ঘটনা। আমি তখন একটি জার্মান বহুজাতিক বিদ্যুৎ কোম্পানী লাহমায়ার ইন্টারন্যাশনাল পল্লী পাওয়ার সার্ভিসের (লিপস) পরিচালক, কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স হিসেবে কাজ করছি। একটু বলে রাখা দরকার, লিপস ছিল জার্মাান পাওয়ার কনসাল্ট্যান্সি কোম্পানির বাংলাদেশ এর একটি বানিজ্যিক শাখা। লিপস আরপিসিএল (রুরাল পাওয়ার কোম্পানী লিমিেিটড) এর মালিকানাধীন ময়মিনসংহ ১৪০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট এর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বে ছিল। জার্মাান লাহমায়ারেরই একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মানফ্রেড লাঙ্গে লিপস এর চেয়ারম্যান ছিলেন। বাকি পরিচালকদের মধ্যে একজনই বাঙালী ছিলেন, এ জেড এম রেজা উল হক। তিনি প্রথমে শুধু পরিচালক থাকলেও যেহেতু বাংলাদেশের পুরো বিষয়টি তিনি দেখতেন, সেজন্যে ২০০২ সালের সালের দিকে তাকে লিপস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়।
এবার কাজের কথায় আসি। ময়মনসিংহ পাওয়ার প্ল্যান্টের তৃতীয় পর্যায় অর্থ্যাৎ একটি ৭০ মেগাওয়াট স্টীম টারবাইন বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কেবলই লাহমায়ার ইন্টারন্যাশনালের সাথে পরামর্শক চুক্তি করার জন্যে একদিন আমরা বসলাম, আরপিসিএল-এর সম্মেলন কক্ষে। তার আগের মধ্য রাতে অবশ্য আমাদের আরইবি এবং আরপিসিএল এর কয়েকজন কর্মকর্তার বাসায় যেতে হয়েছিল, কিছু একটা হস্তান্তর করার জন্যে, যাতে পরের দিনের সভাটা মধুর হয়ে ওঠে।

সম্মেলন কক্ষের টেবিলের একপাশে আমরা, লাহমায়ার বাহিনী এবং উল্টোদিকে আরপিসিএল এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উর্দ্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ। হেড টেবিলে আরইবি’র চেয়ার ম্যন, মেম্বার এবং আরপিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাকসুমুল করিম।
আলোচনা শুরু হল। লাহমায়ার থেকে প্রস্তাব দেয়া হল ৫৮ মানব মাস (ম্যান মান্থ) লাাগবে কাজটার জন্যে। বাংলাদেশ পক্ষ, এমনকি যাদের সাথে গতকাল রাতেও দেখা হয়েছিল, তাঁরাও যেন একটা কৌতুককর প্রস্তাব শুনলেন। তাঁরা প্রস্তাব দিলেন, ৪০ মানব মাস। দশটার আলোচনা গড়িয়ে গেল দুপুর বারোটা পর্যন্ত। এর মধ্যে লাহমায়ার এক মাস নামে তো আপরদিকে বাংলাদেশ পক্ষ ওঠে এক মাস। আমার কোনওই কাজ ছিলনা ওখানে, কেবল দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া। এরই মধ্যে দেখছিলাম, গতকাল রাতে যাদের সাথে আমাদের কিঞ্চিৎ বিনিময় কার্য হয়েছিল, তাদের প্রাণপন অভিনয়। যেন বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে নেমে গেছেন তাঁরা। লাঞ্চ পর্যন্ত কোনও সুরাহা হল না। লাঞ্চের পর আবার শুরু হল কঠিন দর কষাকষি। সে এক প্রাণান্তকর অবস্থা। সন্ধ্যের দিকে এসে গতকাল রাতে ঠিক হওয়া ৫২ মানব মাস (ম্যান মান্থ) ঠিক হল পরামর্শকের কাজের জন্য। সুতরাং, মূল কাাজর চুক্তির আগেই দূর্ণীতি শুরু হয়না, এমন কথা বোধহয় সত্যি নয়। সভার মধুরেন সমাপয়েত হল। শুধু একজনকেই সন্তুষ্ট হতে দেখলাম না একেবারেই। তিনি বলেন জনাব আবদুস সবুর। তখন তিনি বোধহয় ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। অত্যন্ত সৎ মানুষ আবদুস সবুর এখন আরপিসিএল এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং তাঁর নেতৃত্বে আরপিসিএল বোধহয় প্রায় ১,০০০ মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ জেনারেশন (উৎপাদন করে চলেছে)। লিপস এর দূর্ণীতির কাল সাপ যেমন তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে ছাড়েনি, তেমনি ছাড়েনি সবুরকে অবর্ণনীয় কষ্ট দিতে। এসব কথা পরে আসবে।
আমরা সবাই খুশী। সবাই চললাম, হোটেল সোনারগাঁয়ে, ডিনার সারতে।
লিপসের গল্প অনেক। সব বলতে গেলে জীবন একবার বিপন্ন হয়েছিল, আরেকবার হতেও পারে। তবে, রেজা দেশে নেই। তাই এই দূর্নীতির সাতকাহন লিখার সাহস পেয়েই গেলাম। সামনে আরও বলব, হাওয়া ভবনের সাথে রেজার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং হাওয়া ভবনের অতি উচ্চাশার কারণে রেজার পতন এবং আরপিসিএলএর পরিবর্তন। সেই সাথে বলতে হবে, রেজার উচ্চাশার কারণে শেষ পর্যন্ত যে লাহমায়ারকে এই দেশ থেকেই ব্যাসা ঘটিয়ে নিতে হয়েছিল, সেই কথাও।
অথচ, রেজা তার লোভ সামলাতে পারলে নিজেই কয়েকটা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক হতে পারত, সেটা আমি এখনও পরিপূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি। অথচ এখন তার দিন কাটে অস্ট্রেলিয়া, যে ইমিগ্রেশন আমিই করে দিয়েছিলাম, অস্ট্রেলীয় দূতাবাসে কাজ হরার সময়ে।


(চলবে)

মন্তব্য করুন