লেখালিখি নিয়ে দু’চার কথা/নাসির আহমেদ কাবুল

নাসির আহমেদ কাবুল

নিজের নামের প্রতি দুর্বলতা মানুষের সহজাত। আপনাকে যারা নাম ধরে ডাকেন, লক্ষ্য করুন তারাই আপনার সবচেয়ে প্রিয়জন অর্থাৎ কাছের মানুষ। ‘স্যার’ বলুন আর `ভাই’ বলুন-এ জাতীয় সম্বোধনে সম্বোধনকারী কখনও খুব কাছে যেতে পারেন না। সৃষ্টিকর্তাও কিন্তু চান সৃষ্টিকূল তাঁকে তাঁর গুণসমৃদ্ধ নাম ধরেই ডাকুক।

নিজের নামটিই নিজের কাছে প্রিয়, এটি চিরন্তন। একজন  লেখকের কোন কিছু লেখার প্রথম উদ্দেশ্য নিজের নাম প্রচার করা। এই প্রচার ও প্রশংসায়ই তার আত্মতৃপ্তি। তবে এটিই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। অনেক বড় বড় লেখকরা দেশ-জাতি ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা  থেকে লেখেন। তবে নবীনদের জন্য শেষোক্তটি বিবেচন্য নয়।

প্রথমেই নির্বাচন করুন, কোন বিষয়টির ওপর লিখে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন এবং সে বিষয়টির ওপর গভীর জ্ঞান অর্জন করুন। এ জন্য দরকার প্রচুর পড়াশুনা। একজন লেখককে প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে, এটাই মূল কথা। সে পড়াটা শুধু রস আস্বাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। রস আস্বাদন করবেন সাধারণ পাঠকরা। সাধারণ পাঠক ও লেখকপাঠকদের পড়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একজন লেখককে কোন লেখা পড়ার সময় লেখায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের অর্থ ও প্রতিশব্দ জানতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে কীভাবে শব্দচয়ন করা হয়েছে।

সব লেখার সঙ্গে পাঠক লেখকের সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন- এখানেই পাঠকারীর মৌলিকত্ব। যে লেখাটি পড়ছেন  সেইটিই যে চূড়ান্ত তা কিন্তু নয়, ভিন্নমত আপনারও থাকতে পারে, তবে সেটা হতে হবে আরও সমৃদ্ধ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার কথা ধরা যাক, তিনি লিখেছেন- ‘তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি’। একজন পাঠক যদি ‘কাটলো’ শব্দটির জায়গায় ‘কেটে গেলো’ ব্যবহার করতে চান করতে পারেন, যদি ছন্দের কিছু পরিবর্তন করতে চান, করুন; কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন, কোনভাবেই প্রকাশ করা চলবে না। অর্থাৎ একজন পাঠক এমন মৌলিক পার্থক্য নিজের মধ্যে লালন করবেন এবং পরবর্তীতে তিনি শব্দচয়নে, বাক্য বিন্যাসে সচেতন হবেন, এটাই কাম্য।

শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করুন। প্রতিদিন অন্তত দু-চারটি নতুন শব্দ শিখুন। এ জন্য অভিধান ব্যবহার করতে পারেন। হাতের কাছেই রাখুন একজন লেখকের মহামূল্যবান এই গ্রন্থটি। অলস সময় না কাটিয়ে অভিধানের পৃষ্ঠা উল্টান- দেখবেন কী দ্রুত আপনার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। একটি শব্দ জানার পর প্রতিশব্দ ও স্ত্রীবাচক শব্দটিও জেনে নিন। আমরা সাধারণত: ‘মালিক’ শব্দটি  ব্যবহার করি। কিন্তু আমরা কি জানি এর স্ত্রীবাচক শব্দ কোনটি? জানা দরকার, প্রয়োগ করুন নাইবা করুন, অন্তত জেনে রাখুন।

আপনি লেখক- এই সত্যটি মনের মধ্যে বদ্ধমূল করুন। অর্থাৎ কাজের সময় ছাড়া অবসর পেলেই আপনি লেখা নিয়ে ভাবুন। লেখার প্লট নিয়ে ভাবুন। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ কিন্তু অনুষ্ঠান দেখার সময়েও লেখার জগতে থাকতেন। একমাত্র কাজের সময় ও ঘুমানোর সময় ছাড়া তিনি লেখার বাইরে কখনই থাকতেন না। চিন্তায়-চেতনায় আপনি যদি লেখার মধ্যে থাকতে পারেন তাহলে আপনার লেখা গতি পাবে। আপনার  পক্ষে লেখা খুব সহজ হয়ে যাবে।

লেখার সময় অন্য মানুষ হয়ে যান। মনে করুন আপনি এই জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। আপনিও পাগল এই মুহূর্তে। এখন এ মুহূর্ত থেকে লেখার সঙ্গে পাগলামি চলবে আপনার পাগলের যেমন কোন ভাবনা থাকে না, আপনি তেমন একজন পাগল, লেখার জন্য পাগল হয়েছেন আপনি। এখন এই মুহূর্তে কেউ আপনাকে আপনার  সংকল্প থেকে নড়াতে পারবে না, আপনি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যই আজ এই মুহূর্তে সাধনা করে যাচ্ছেন এবং সফলকাম হচ্ছেন। আত্মবিশ্বাস ধরে রাখুন লেখার সময়টিতে।

লেখা শুরু করেই শেষ করার জন্য অস্থির হবেন না। মাঝ পথে লেখা থেমে গেলে কিছুটা বিশ্রাম নিন এবং তা লেখার মধ্যে থেকেই। এ সময়ে ধৈর্য ধরে লেখা নিয়ে ভাবুন এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখুন।

লেখা প্রকাশ করার জন্য অস্থির হওয়া কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। অনলাইন লেখকরা যে ভুলটি সবচেয়ে বেশি করেন তা হচ্ছে লেখাটি লিখেই পোস্ট করে দেন। একটুও সময় নেন না সেটি এডিট করার জন্য। মনে রাখুন, আপনি এখন যা লিখছেন এখনই তার ভুল সংশোধন সম্ভব নয়, কারণ আপনি ওই মুহূর্তে লেখার মধ্যেই রয়েছেন। এ সময়টা অনেকটা পাগলের মতো হতে পারে। অর্থাৎ সুস্থ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এ জন্য এই মুহূর্তে লেখাটি রেখে দিন কিছুদিন, মাঝে মধ্যে লেখাটি সংশোধন করার  চেষ্টা করুন। এইভাবে কেটে যাক ছয় মাস বা এক বছর তাকে ক্ষতি কী? এই দীর্ঘ সময়ের পর পুরানো লেখার মধ্যে ঢুকে সেটি আরও সমৃদ্ধ করতে পারবেন, সন্দেহ নেই। আজই পরীক্ষা করুন।

কোন কিছুতে রাগবেন না। সব সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। রাগলে ওই সময়টা আপনি লেখার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। অর্থাৎ ওই সময়ে আপনি আগের বলার লেখার জগতে থাকার পরামর্শ কাজে লাগাতে পারবেন না।

দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বেশি বেশি লিখুন। এ জন্য সাহিত্য সম্পাদকের কাছে যেতে হবে আপনাকে। প্রথম-প্রথম হয়তো কোনো সাহিত্য সম্পাদকই আপনাকে পাত্তা নাও দিতে পারেন। ঘাবড়ে যাবেন না, লেগে থাকুন। দেখবেন এক সময় সম্পাদক আপনার ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করবেন, আপনার লেখাটি প্রকাশিত হবে।

বই প্রকাশ করতে চান? করুন, তবে খুব সাবধানে। পাঠক যেন প্রথম লেখাতেই আপনাকে চিনতে পারেন, অন্তত সেই  চেষ্টা করুন। মানসম্মত না হওয়া পর্যন্ত বই প্রকাশ না করাই ভালো। ধৈর্য ধরুন, নিরন্তর লিখে যান, দেখবেন একদিন ঠিকই মানসম্মত একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে পেরেছেন।

নিজের কাছে লেখাটি মানোত্তীর্ণ মনে  হলে ভালো কোনো প্রকাশকের কাছে জমা দিন। কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক যদি আপনার পাণ্ডুলিপিটি গ্রহণ করে এবং দুই বছর পরেও সেটা প্রকাশ করে, তো তাকে দায়িত্ব দেওয়াই উত্তম। কোনো প্রকাশক যদি একান্তই তা করতে না চায় তাহলে নিজ খরচে ভালো কোনো প্রকাশকের মাধ্যমে বইটি বের করুন।।

যাদেরকে পাণ্ডুলিপি দেবেন, তারা কি আপনার পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে প্রকাশ করবে, না-কি শুধু বানান ভুল সংশোধন করে বইটি প্রকাশ করে দেবেন-সে ব্যাপারে নিশ্চিত হোন। মনে রাখবেন, আপনার লেখায় প্রচুর ভুল আছে, বড় লেখকদেরও থাকে। এগুলো ঠিক করার জন্য দক্ষ সম্পাদকের দরকার। আজকাল অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেরই সম্পাদনার কাজে কোন লোক নেই।  যাদের নিজস্ব সম্পাদক রয়েছে তাদের হাতে আপনার পান্ডুলিপি দিন  এবং কথা রাখুন তারা যেন আপনার পাণ্ডুলিপিটি সুসম্পদনার পরই প্রকাশ করে, তার আগে নয়। এ জন্য সম্পাদিত পাণ্ডুলিপিটি আপনিও যাচাই করুন এবং সন্তুষ্ট হলেই তা প্রকাশ করুন।

সবশেষে : পড়ুন-পড়ুন এবং পড়ুন। আর অসীম ধৈর্য নিয়ে নিরলস লিখে চলুন। তাহলে কেউ আপনাকে অবহেলা করতে পারবেন না, কিছুতেই না।

মন্তব্য করুন