শিশুতোষ ছড়া-কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম//অলোক আচার্য



শিশুমন বৈচিত্র্যময়। তাদের চিন্তা-চেতনা, তাদের মনের উৎসুক প্রশ্ন, তাদের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা তাদের বয়সেরই বৈশিষ্ট্য। শিশুদের উপযোগী লেখা ছড়া,কবিতা,গল্প,উপন্যাস,সিনেমা,নাটক শিশু মনের আনন্দের খোরাক যোগায়। শিশু-কিশোর মন উপলদ্ধি করে কোনো স্বার্থক রচনা সত্যিই কঠিন কাজ। খুব ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় ’আমি হব সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি/সূয্যিমামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে/’হয়নি সকাল,ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে।”- আমাদের জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলামের শিশুদের জন্য লেখা খুব জনপ্রিয় লেখার একটি। ছোটোবেলা থেকেই সকাল বেলার পাখি হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে লেখা মিষ্টি এই কবিতাখানি পড়তে পড়তে নিজেকে কতবার যে পাখির মতো উড়তে চেয়েছি, খুব ভোরে উঠতে চেয়েছি তার হিসাব নেই। শিশু-কিশোরদের জন্য বিদ্রোহী কবির এইসব লেখা ছড়া-কবিতা কেবল শিশু কিশোরদের মাঝেই নয় বড়দেরও সমান আনন্দ দেয় । কবির ’সংকল্প’ কবিতায় তিনি অজানা মহাবিশ্বকে হাজির করেছেন চোখের সামনে। জানার ইচ্ছা যে কত তীব্র হতে পারে, নতুনকে আবিষ্কার করতে গিয়ে মানুষ যুগের পর যুগ ধরে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে তা কেবল মানব মনের অন্তর্নিহিত ইচ্ছাকে অবদমিত করে রাখতে না পেরে। কবি তাই বদ্ধ খাঁচায় নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি। তিনি মুক্ত মহাবিশ্বের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রহস্যের খোঁজে ছুটতে চেয়েছেন। এমন বাধভাঙা ইচ্ছে যার মনে তিনি তো সব কালের বাধা পারি দিয়েছেন এমন সব কালজয়ী লেখার মাধ্যমে। এই কবিতায় স্পষ্টই বলেছেন, ’থাকবো নাকে বদ্ধ ঘরে/দেখবো এবার জগৎটাকে/কেমন করে ঘুরছে মানুষ/যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে’। বিদ্রোহী কবি বলেই আমরা যাকে সমধিক চিনি সেই কবিই শিশু কিশোর মনের দরজা খুলে বিশ্বকে খুঁজতে উৎসাহ দিয়েছেন এভাবেই। এমন সব কবিতা তৈরি যিনি করেছেন তিনি আমাদের জাতীয় কবি। কবি কাজী নজরম্নল ইসলাম ছিলেন ছিলেন একজন সব্যসাচী লেখক। গল্প,উপন্যাস,কবিতা,নাটক,প্রবন্ধ সাহিত্যের যে শাখাতেই তিনি হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে আজও তা অলংকার হয়ে চূড়ায় অবস্থান করছে। মুক্তার মতো উজ্জল সেই সাহিত্য নিয়ে আমরা হৃদয়ের খোড়াক মিটিয়ে চলেছি। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছেন। তাকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।
কাজী নজল ইসলাম মানে একটি সাহিত্য যুগ, একটি কাল। তার শিশু কিশোর উপযোগী লেখা শিশু মনের উদ্দীপনার জন্ম দেয়। যা কাল থেকে কালে প্রবাহমান। একটি,দুটি লেখায় লিখে যার গুরুত্ব প্রকাশ করার চেষ্টা বোকামী মাত্র। বাংলা সাহিত্যে শিশুদের জন্য যে সাহিত্য রয়েছে মানে শিশু উপযোগী গল্প,ছড়া বা কবিতা এসব বিদ্রোহী কবির যুগেও হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। শিশুসাহিত্য সৃষ্টি সহজ কথা নয়। এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো লেখাটি কতটা শিশু উপযুক্ত হয়েছে তা বিবেচনা করা। শিশুমনকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম সফল সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি তাই চ্যালেঞ্জের। শিশুদের জন্য লিখতে হলে নিজেকেও শিশুমনের হতে হয়। শিশুদের মন, চাওয়া-পাওয়া,আনন্দ বেদনা, হাসি-কান্নার উৎস বুঝতে হয়। এগুলো বুঝতে পারলেই স্বার্থক শিশুতোষ রচনা সম্ভব। না হলে তা স্বার্থকতা পায় না। যুগের পাতায় তার ঠাঁই হয় না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিশুদের জন্য লিখতে গিয়ে নিজেকে সেই সময়ে নিয়ে গেছেন। এমনিতেই সারল্য ছিল তার বৈশিষ্ট্য। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য হলো শিশুকালে যা পাঠ করি তার অনেকটা আবার আমরা কৈশর-যৌবন-বার্ধক্যেও মনের কোণে ঠাঁই নেয়। এটাই সৃষ্টির স্বার্থকতা। ছোটোবেলার কিছু ছেলেমানুষি যা ছড়ায় কবিতায় প্রকাশ পায় তখন যে বয়সেই তা পাঠ করা হোক না কেন স্মৃতিময়তার যোগান দেয়। ’লিচু চোর’ কবিতার লিচু চুরি করতে গিয়ে পালাতে গিয়ে সরাসরি মালির ঘাড়ে পরা এরপর আর যা যা কান্ডকারখানা ঘটেছে তা যেন প্রত্যেকের শৈশবকেই সামনে হাজির করে। কবির নিজের শৈশবও কেটেছে দুরন্তপনায়। বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বন্ধুদের সাথে স্নান করেছেন তালপুকুরের জলে। কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টির বিশালতা আমাদের সাহিত্য ভান্ডারকে পূর্ণতা দিয়েছে। আজও আমরা সেই কবিতা,ছড়া আবৃত্তি করি। তিনি শিশুদের জন্য কবিতা,ছড়া,গল্প,ভ্রমণকাহিনী বা জীবনীও লিখেছেন। তার প্রভাতী কবিতায় ’ভোর হলো দোর খোলো/খুকুমণি ওঠ রে/ঐ ডাকে জুঁই শাখে/ফুল খুকি ছোটোরে। এরকম অসংখ্য জনপ্রিয়, মুখে মুখে ঘুরে ফেরা শিশু সাহিত্যের জন্ম হয়েছে তার হাত ধরে।
মাকে নিয়ে আবেগ সবার। মা’র প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা সবার। বহু কবিতা, গল্প না আজ পর্যন্ত লেখা হয়েছে মাকে নিয়ে এবং আজও হচ্ছে। তবু যেন লেখার শেষ নেই। কবির লেখাতেও এসেছে মা’র কথা। তিনি লিখেছেন, যেখানেতে দেখি যাহা/মা-এর মতো আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই/মায়ের মতন এত/আদর সোহাগ সে তো/আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই/- মায়ের মতো এমন আদর সত্যি আর কোথায় পাবো! তাই তো এখানেই কবি বলেছেন, হেরিলে মায়ের মুখ/ দূরে যায় সব দুখ। খুব ছোটো বেলায় পড়া ছড়ার কথা মনে পড়ে? যখন মা-বাবার মুখে মুখে ছড়া আবৃত্তি করতে শিখেছি। আজও শিশুদের মুখে মুখে শেখাই। সেই বিখ্যাত ছড়া? ” কাঠবেড়ালি!কাঠবেড়ালি!/পেয়ারা তুমি খাও?/গুড়-মুড়ি খাও?/দুধ-ভাত খাও?/বাতাবি নেবু লাউ?/। কবির শিশু জাদুকর কবিতায় কবি বলেছেন, পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর/এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর/কোন রুপ-লোকে ছিলি রুপকথা তুই/রুপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই/। কবিতার শেষে এই শিশু জাদুকরের মাঝেই কবি নিজে জেগে রয়েছেন। শিশু সাহিত্য নিয়ে আজও প্রচুর কাজ হচ্ছে। কিন’ সেটাও যথেষ্ট নয়। যতটা বড়দের জন্য কাজ হয় ততটা শিশুদের জন্য হয় না। যারা শিশুদের জন্য দুহাতে লিখে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের জাতীয় কবি। তার কথায় তিনি নিজেই চির শিশু, চির কিশোর। তিনি বলেছেন, আমি চির শিশু, চির কিশোর। তার হাত ধরে বাংলা শিশু সাহিত্য পেয়েছে পূর্ণতা। শিশুদের প্রতি মমতা না থাকলে এ কাজ সম্ভব হয় না। শিশু সাহিত্যে আরও অনেক সাহিত্যকর্ম রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের যা কোনো একটি নির্দিষ্ট লেখায় তুলে আনা কষ্টসাধ্য। যা যুগ যুগ ধরে আমাদের শিশুসাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছেন।

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য