ছবি- লেখক

সন্তানের শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে সকলকে //গোপাল অধিকারী

নেপোলিয়নের প্রখ্যাত উক্তি তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব। দিগ্বিজয়ী এ মহাবীরের এরকম আরো বহু কথা ইতিহাস বরাবরই আলাদা করে স্মরণ করে। স্মরণ করে তার বীরত্ব, প্রজ্ঞা ও বাহাদুরি। তবে তার মাকে নিয়ে কথাটার তাৎপর্য বর্তমান সময়েও অপরিসীম। একটি সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে মায়ের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আর করোনাকালে এই কথা যেন শতভাগই কার্যকর। কারণ এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।
করোনার থাবায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরিই লন্ডভন্ড হয়েছে। করোনা মহামারিতে প্রায় ১৭ মাস ধরে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান। করোনাকালে শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি কয়েকদফা বৃদ্ধি করে তা এখনও বলবৎ আছে।
বন্ধ আছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। থেমে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম। স্কুল-কলেজে অভ্যন্তরীণ কিছু পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে অনলাইনে। কিন্তু তাতে শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। ক্লাস বন্ধ থাকায় সরকার সংসদ টেলিভিশন, বেতার ও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার উদ্যোগ নেয়। তবে সব শিক্ষার্থী এ সুবিধা পাচ্ছেন না। শহুরে কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করতে পারলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যার কারণে মোটেও অনলাইন ক্লাস করতে পারেননি। মফস্বলের শিক্ষকরাও অনলাইন ক্লাস নেন না। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এই বন্ধের ফলে চরম ক্ষতির শিকার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০ লাখ শিক্ষক।
করোনার প্রভাবে ব্যাপক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে, বেড়েছে বাল্যবিয়েও। শহুরে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে দেখা দিয়েছে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যাও। করোনায় শিক্ষা খাতের ব্যাপক ক্ষতির চিত্রও উঠে এসেছে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন জরিপে। গণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ বা বেতার, টেলিভিশন, অনলাইনের বিভিন্ন প্লাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেয়া পাঠদানের আওতায় এসেছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৯২ শতাংশ আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের পাঠদানের আওতায় এসেছে।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এ সময় বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, টিভি দেখে সময় ব্যয় করছে। করোনার সময়ে বেশ কয়েকজন অভিভাবক একটি বিষয়ে তাঁদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তা হচ্ছে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও শিক্ষার্থীদের বাসায় অবস্থানের কারণে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ব্যবহার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সামগ্রী হাতের কাছে পেয়ে তার অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আমাদের ছাত্রসমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস’ হতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন বা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকায় চোখের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে অল্প বয়সী বাচ্চাদের আজকাল ভারী চশমা ব্যবহার করতে দেখা যায়। ইন্টারনেট আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য, হজমে সমস্যা, ঘাড় ও কোমর ব্যথা, মোটা হয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই আসক্তি তাদের খিটখিটে মেজাজ, অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি, টেনশন বোধ, বিষন্নতা, পারিবারিক সৌজন্যবোধের অভাবজনিত বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। এছাড়া মোবাইল ব্যবহার করে করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহারজনিত আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে যা তাদের পড়ালেখা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এই আসক্তি থেকে বের হতে না পরলে শিক্ষার পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।
এমন সমস্যার কথা আমরা শুনছি বা জানি। তবে শতভাগ সত্য কথা এই যে, একজন দায়িত্বশীল পিতা-মাতা কখনও সন্তানকে বিপদে যেতে দেয় না। পিতা-মাতার দায়িত্বশীলতায় একটি সন্তান দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। তাই মহামারি করোনার এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে পিতা-মাতাকে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার চাপ থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানের চাপে শিক্ষার্থীরা পড়ে কিন্তু যেহেতু এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সেহেতু শিক্ষার প্রয়োজনে অভিভাবকদের বাড়িকে বিদ্যালয়ে পরিণত করে সন্তানদের যত্ন নেওয়া উচিত। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করাও কঠিন হবে।
প্রতিটি শ্রেণির পাঠ্যক্রম বয়স ও মেধা আঙ্গিকে করা। তাই দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা যদি পড়ালেখা বা পরীক্ষায় না বসে তবে পরবর্তী বছরের পাঠ্যক্রমে সে তাল মেলাতে পারবে না। তাছাড়া ধাপে ধাপে যে শেখা তা থেকে বিচ্যুত হবে। ফলে নিজ নিজ সন্তানকে এই ধারাবাহিক ক্ষতি থেকে পোষাতে বাড়িতে বই শেষ করা বা ধারাবাহিকতা রক্ষার বিকল্প নেই।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভয়াবহ এই বাস্তবতা সকলেরই অবগত। শিক্ষামন্ত্রী দিপুমণি বলেছিলেন, সনাক্ত ৫% নিচে নামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ২২ জুলাই বৃহস্পতিবারে মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমিত হয়ে দেশে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার হিসাবে শনাক্তের হার ৩২ শতাংশের বেশি। এই দিন সরকারি ও বেসরকারি ৬৩৯টি ল্যাবরেটরিতে ১০ হাজার ৮৯৯টি নমুনা সংগ্রহ ও ১১ হাজার ৪৮৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় নতুন রোগী শনাক্ত ৩ হাজার ৬৯৭ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১১ লাখ ৪০ হাজার ২০০ জন। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ১৯ শতাংশ।
গত বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় এ ভাইরাসে সারাদেশে ১৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৮ হাজার ৬৮৫ জনে। তবে শিশু মৃত্যুর কোন ঘটনা ঘটেনি। বয়সভিত্তিক বিশেস্নষণে দেখা গেছে, মৃত ১৮৭ জনের মধ্যে দশোর্ধ্ব একজন, বিশোর্ধ্ব ৪ জন, ত্রিশোর্ধ্ব ২০ জন, চল্লিশোর্ধ্ব ১২ জন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ৪৯ জন, ষাটোর্ধ্ব ৬৪ জন, সত্তোরোর্ধ্ব ২৭ জন, আশির্ধ্ব ৮ জন এবং নব্বই বছরের বেশি বয়সী ২ জন মারা যান।
সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলতে পারে তা কিন্তু সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে না। তাই এখনও যদি সন্তানকে পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনা যায় ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর সন্তানের শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে অবশ্যই অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরূরী দরকার।
সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ উভয় গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ শিক্ষা ছাড়া সঠিক পথ উপলব্ধি করা যায় না, আবার সুস্থতা ছাড়াও সঠিক পথ গন্তব্যে পৌছানো সম্ভব না। সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা একটি। আমার কাছে শিক্ষাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার বলে মনে হয় কারণ “শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড ”। শিক্ষার কারণেই ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বৃদ্ধি পায়। এই মহান কাজে পিতা-মাতার ভুমিকা কিন্তু কম নয়। আমরা বলে থাকি ব্যবহারে বংশের পরিচয়। শিক্ষাও কিন্তু পরিচয়ের কম বাহক নয়। একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক অবশ্যই সন্তানের শিক্ষার ক্ষতি কখনই কামনা করে না। কারণ ভষিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ। তাই শিক্ষা নিয়ে ভাববার সময় মনে হয় জরুরী হয়ে পরেছে। অবশ্যই সন্তানের শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে আপনি, আমাকেসহ সকলকে। কারণ শিক্ষার সাথে সন্তানের শারিরীক সুস্থতা ও মানসিক সুস্থতা সবকিছুই জড়িত। সন্তানকে শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে পারলেই বিভিন্ন আসক্তি থেকে ফেরানো সম্ভব। সম্ভব পড়ালেখায় এগিয়ে নেওয়াও। মেয়েরা বাড়িতে থাকলেও অনেক ছেলে শিক্ষার্থী এই অবসরে নেশার জগতে প্রবেশ করছে যা ভয়াবহ বিপর্যয় ঢেকে আনতে পারে পরিবারে। তাই বাবা-মাকেই সচেতন হতে হবে।
আমরা যে শিক্ষিত জাতি চাই, আমরা যে মানুষের মত মানুষ করতে চাই সকল কিছুতেই শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই নিজ পরিবার, সমাজ তথা দেশ সকলের জন্যই শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে। তাই আসুন আজ থেকেই বাড়িকে করি বিদ্যালয়, সন্তানের পড়ালেখায় করি আশ্রয়-প্রশ্রয়। বাবা-মার হোক আদেশ, পড়ালেখায় করো মনোনিবেশ।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য