ডোরা আলোন্সো ।।
ভোর ভোর হয় তখন, সমুদ্র তার নাক মুখে ঢুকে গেছিল। সে অবাক হয়ে বলে উঠল-
- কী নোনতা, মাগো! থু!
হাত পা নাড়াতে চেষ্টা করল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সমুদ্রের উপরিতলে মাথাটা তুলে ধরতে পারল। ভাসতে ভাসতে দেখতে পাচ্ছিল সবুজ গাছে ভরা তীর, ফ্যানাভরা ঢেউয়ের দুর্দান্ত শ্বাসরোধী দৃশ্য । তার মনে হচ্ছিল মৃদু আলোয় দূরে কেউ তুলির টানে আঁকছে সেসব দৃশ্য।
জানতে পেরে ছেলেটির অবিশ্বাস্য লাগছিল। কত বছর ধরে সে সমুদ্রে যেতে চেয়েছিল, ছোট শিশুর মত আগ্রহে ঝাঁপাতে চেয়েছিল তার বুকে। সেই গভীর দুনিয়ার বুকে ডুবে যেতে চেয়েছিল। সমুদ্র নাকী কখনো তার ঘোরা থামায় না? অপ্রত্যাশিতভাবে তার স্বপ্ন পূরণ হল।
নরম ঈষদুষ্ণ জলের নিচে নামতে নামতে টের পাচ্ছিল শিরা উপশিরাগুলো সমুদ্রের জলে ভরে উঠেছে। ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো কিভাবে জলের ওঠানামার তালে তালে দুলছে বুঝতে পারছিল। জলের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে বুড়বুড় করে ফেনা কাটছিল।
অসংখ্যবার কল্পনায় জলের সঙ্গে যেভাবে খেলেছিল ছেলেটি, এখন ঠিক সেইভাবে খেলছিল। ফের নতুন করে চাপ দিয়ে চেষ্টা করল ওপরে উঠতে। একাকী সামুদ্রিক পাখির মত অবাক হতে হতে জলের নিচ থেকে নিজের মাথা টেনে তুলছিল।
অ্যালবাট্রস পাখিটাকে দেখে মনে হচ্ছিল মাছ সঞ্চয় করার কাজে ব্যস্ত। সামনে যে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে আবার সে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে জলের তলায় সেদিকে তার খেয়ালই নেই। ডানাদুটো প্রাণপণ শক্তিতে মেলে দিয়েছে সে, তারপর গোটা শরীরের শক্তি জড় করে ঘুরপাক খাচ্ছে আর ঢেউয়ের মধ্যে কিছু একটা খামচে ধরার ব্যগ্রতায় একমনে তাকিয়ে আছে। তারপর সে পাখি গায়ের জোরে দিয়ে অথচ ধীর লয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নীল দিগন্তরেখায় মিশে উড়ে যাচ্ছিল।
ছেলেটির তখন ডুবে যাওয়া চোখদুটোয় প্রাণপণে আঁকড়ে রেখেছিল শান্ত চাউনি। পাখির ওড়ার রাস্তা বরাবর সাঁতরাতে চাইছিল সে। এবং ওটা যে ফের একবার ঝাঁপ দিয়ে ডুবল সেসব দেখতে দেখতে পৌঁছেও গেছিল। কিন্তু যখন ভেসে উঠল বুঝতে পারছিল না কী ঘটে গেছে।
এখন অ্যালবাট্রসটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ঘাড়টা ছোট্ট যেন দুম করে কেটে দেয়া, জীবন্ত চোখ, ছোট্ট হলদে ঠোঁট। মাথার ওপর থাকা ঝুঁটিটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে। লেজের কাছে বাঁকানো অংশটা সবচেয়ে সুন্দর দেখতে । বিকেলের আকাশের প্রেক্ষাপটে ভেজা পাখিটাকে নির্ভুলভাবে চোখে পড়ে।
পাখিটাকে দেখে ছেলেটি কিছু একটা প্রাণপণে মনে করতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু নাহ মনে পড়ছিল না। দেখল পাখিটা অধৈর্যভাবে মাথার ওপরে থাকা ‘সেইবো’ ঝুঁটির নরম পাপড়িগুলো যেন বাতাসের উঠোনে পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছিল। পাখীদের বাসার কাছে পৌঁছচ্ছিল। দেখল জালের ভেতর পাখিটার কচি কচি ছানা, ঠিক যেন সূক্ষ্ম ধারালো ছুরির মত ভঙ্গুর, কচাত করে কেটে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
দিনের আলো আর সামান্যই অবশিষ্ট ছিল। ছেলেটা দেখতে পাচ্ছিল আকাশ জুড়ে অসংখ্য সামুদ্রিক পাখি আসছে আর ঠোঁট বাগিয়ে তাকে ছোঁ মেরে তুলে নেবার চেষ্টা করছে। ওরা গান গাইছিল।
এবার সে ভয় পেল, কিছু একটা অস্বাভাবিক কান্ড না ঘটে যায়। একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাবোধ তাকে ভালভাবে টের পেতে দিচ্ছিল না সত্যিটা। আসলে তখন ও যা ভাবছিল তার ঠিক উল্টোটাই ঘটে যাচ্ছিল। অ্যালবাট্রস পাখিটা একবার পিছন ফিরে দেখল। সমুদ্রের মাঝখানে ওর নিজের পাখিগুলোকে খুঁজছিল।
সবুজ জল খেয়ে খেয়ে ফুলে ওঠা বুক আর মুখ ভর্তি নোনা জল নিয়ে লোকটা সেই বিস্তীর্ণ একাকীত্বের ভেতর সেই একলা অ্যালবাট্রস পাখিটাকে তার ওপরের পাক খেতে দেখে আতংকে সে চেষ্টা করছিল আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে। কিন্তু যতবার পাখিটা পরিকল্পনা করে, উড়ে পাক খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল তার ওপর, ততবার সে দেখছিল ওটা তো আসলে একটা ছোট্ট পাখি। স্রেফ গোড়ালির শক্ত জায়গা দিয়ে ছেলেটিকে ছুঁয়েই সে তার স্পর্শ টের পেতে পারত। ছেলেটির প্রায় মুখের ওপর ঝলকাচ্ছিল।
সেইসঙ্গে অবিশ্যি তার গলার গানও সঙ্গ দিচ্ছিল। ক্রমশ ছেলেটি জলে তলিয়ে যাচ্ছিল। অনেক অনেক অতল তলে, যেখানে সবকিছু কালো। জল যেখানে ভারী। যেখানে জলের ভারে বদ্ধ ঘন্টাধ্বনি কানে আরো দ্বিগুণ হয়ে চেপে বসে। ওখানেই হয়ত সে থেকে যাবে।
শেষবারের মত তাকিয়ে দেখতে চাইল। দেখল ও ভেসে থাকছে, আঁকড়ে ধরতে চাইছে সেইসব কিছু যা সে ফেলে আসতে চাইছিল এতক্ষণ ধরে।
এক মুহূর্তের জন্য ছেলেটি বুঝতে পারল সে এক অর্থহীন মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে।
***
মূল গল্পঃ Los gallos (কিউবা)
লেখক পরিচিতি
১৯১০ সালে কিউবায় জন্মগ্রহণ করেন লেখক কবি সাংবাদিক নাট্যকার ডোরালিনা আলোন্সো ওরফে ডোরা আলোন্সো (Dora Alonso)। কিউবার শিশুসাহিত্যে বিদেশী ভাষায় সর্বাধিক অনূদিত এই সাহিত্যিকের সৃষ্টি। মাত্র ৯ বছর বয়সে প্রথম পুরস্কারটি পান। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ের জন্য লেখা তার উপন্যাস Aventuras de Guille বা গিইয়ের অভিযান অত্যন্ত বিখ্যাত। শিশুদের জন্য লেখা উপন্যাস El cochero Azul বা নীল রঙের কোচোয়ান বহুল অনূদিত। বহু উপন্যাস, কবিতা, নাটকের সৃষ্টিকর্তা এবং অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত এই নারী ২০০১ সালে কিউবায় প্রয়াত হন।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি
0 মন্তব্যসমূহ