লাল মৃত্যুর সৌখিন অভিনয় : এলেন পোর গল্প


‘লাল মৃত্যু’ অনেককাল আগেই দেশকে ছারখার করে দিয়েছিল। অন্য কোনো মহামারিই কোনোদিন এত বেশি মারাত্মক বা বীভৎস হয়ে দেখা দেয়নি। রক্ত-রক্তের লাল রং ও আতঙ্কইÑতার অবতার ও মোহর। প্রথমে তীব্র যন্ত্রণা ও আকস্মিক ঝিমুনি; তারপরেই লোমকূপ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ ও মৃত্যু। আক্রান্ত রোগীর সারা দেহে, বিশেষত মুখে চাকা চাকা লাল দাগই মহামারির অভিশাপের মতো তাকে বঞ্চিত করে রাখে সাহায্য ও সহচরদের সহানুভূতি থেকে। রোগের আক্রমণ, প্রসার ও বিরাম-সবকিছুই মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যাপার। 

কিন্তু যুবরাজ প্রস্পেরো সুখী, অকুতোভয় ও চতুর। রাজ্যের অর্ধেক জনসংখ্যা নিঃশেষ হওয়ার পরে দরবারের পারিষদবর্গ ও সুন্দরীদের ভেতর থেকে এক হাজার হাসি-খুশি ও লঘুচিত্ত বন্ধুদের ডেকে এনে তাদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল প্রাকারবেষ্টিত দুর্গ-সদৃশ একটি নির্জন মঠে। মঠটি যেমন বিস্তীর্ণ তেমনি চমৎকার তার গঠনশৈলী,Ñযুবরাজের খেয়ালি অথচ মহান রুচির এক অনবদ্য সৃষ্টি। একটা দৃঢ় ও সুউচ্চ প্রাচীর তাকে বেষ্টন করে রেখেছে। তাতে লোহার ফটক বসানো। পারিষদরা মঠে ঢুকেই উনুন ও ভারী ভারী হাতুড়ি আনিয়ে হুড়কোগুলোকে পিটিয়ে জুড়ে দিল। মনের আকস্মিক হতাশা বা পাগলামির ধাক্কায় কেউ যাতে সেখানে ঢুকতে বা বের হতে না পারে, তার সবরকম ব্যবস্থা করতে তারা দৃঢ়সংকল্প। মঠের মধ্যে প্রচুর খাদ্যসামগ্রী মজুদ করা হলো। বাইরে থেকে রোগ-সংক্রমণকে বন্ধ করার ব্যবস্থাও এতে হয়ে গেল। যে জগৎটা বাইরে থাকল তার ব্যবস্থা সে নিজেই করতে পারবে। আপাতত তা নিয়ে দুঃখ করা বা চিন্তাভাবনা করা বৃথা। আমোদ-প্রমোদের সব রকম ব্যবস্থা ‘প্রিন্সই’ করেছে। তাদের সঙ্গে ভাঁড় আছে, ব্যালে-নাচিয়ে আছে, গাইয়ে-বাজিয়ে আছে, সুন্দরীর দল আছে, মদও আছে। এসব কিছ্রুই সঙ্গে নিরাপত্তাও আছে প্রাকারের ভেতরে। তার বাইরে আছে ‘লাল মৃত্যু’। 

এই নির্জনবাসের পঞ্চম বা ষষ্ঠ মাসের শেষের দিকের কথা। বাইরে তখন মহামারি প্রচ- রূপ ধারণ করেছে। সেই সময় হাজার পারিষদের মনোরঞ্জনের জন্য যুবরাজ প্রস্পেরো অসাধারণ জাঁকজমকপূর্ণ একটা মুখোশধারী বল-নাচের আয়োজন করল।

সেই মুখোশধারী সমবেত নৃত্যের আসর হই-চইতে ভরা এক বিলাসবহুল দৃশ্য। কিন্তু যেসব ঘরে সে আসর বসেছিল প্রথমে তার কথাই বলি। ঘর ছিল সাতটিÑপ্রতিটি রাজকীয় কেতায় সুসজ্জিত। অনেক রাজপ্রাসাদেই এ ধরনের ঘরগুলো থাকে পর পর দীর্ঘ সারিতে সাজানো; ভাঁজ করার দরজাগুলো খুলে দিলেই দুদিকের দেয়ালের গায়ে প্রায় মিশে যায়; ফলে তাদের পুরো দৃশ্যটা কোনোরকম বাধা পায় না। এখানে কিন্তু ব্যবস্থাটা অন্য রকম; অদ্ভুত কোনো কিছুর প্রতি ডিউকের অনুরাগ থেকে সেটাই তো প্রত্যাশিত। ঘরগুলো এমন অনিয়মিতভাবে সাজানো যে, একসঙ্গে তাদের একটার বেশি দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রতি বিশ বা ত্রিশ গজ দূরে দূরেই একটা করে খাড়া বাঁক তৈরি করা হয়েছে। ফলে প্রতিটি বাঁকেই ফল হয়েছে অদ্ভুত। বাঁয়ে ও ডানে প্রতিটি দেয়ালের মাঝখানে গথিক ধরনের একটা করে লম্বা, সরু জানালা এমনভাবে বসানো হয়েছে যে, তার পেছনে একটা বদ্ধ বারান্দা এঁকেবেঁকে চলে গেছে ঘরগুলোর সঙ্গে তাল রেখে। জানালাগুলোতে রঙিন কাচ লাগানো; যে-ঘরের যে-রং জানলার কাচের রংও তার সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একেবারে পূর্ব প্রান্তের ঘরটার রং নীল; কাজেই তার জানালাও সম্পূর্ণ নীল। দ্বিতীয় ঘরটির সাজগোজ ও পর্দার রং রক্তিম; তাই সেখানে জানালার কাচও রক্তিম বর্ণ। তৃতীয় ঘরটা সবুজে ঢাকা, আর জানালাও তাই। চতুর্থ ঘরের সবকিছু কমলা রঙেরÑপঞ্চম ঘরে সাদাÑষষ্ঠ ঘরে বেগুনি। সপ্তম ঘরটিতে কালো ভেলভেটের পর্দা সিলিং থেকে দেয়াল বরাবর নেমে এসে ভাঁজ হয়ে পড়েছে একই রং ও কাপড়ের কার্পেটের ওপর। কিন্তু কেবল এই ঘরের অন্য সাজসজ্জার রঙের সঙ্গে জানালার রঙের মিল নেই। কাচগুলো রক্তিমÑটকটকে গাঢ় রক্তবর্ণ। এই সাতটা ঘরের কোনোটাতেই কোনো বাতি বা মোমবাতিদানি নেই, যদিও মেঝেময় ছড়িয়ে আছে অথবা ছাদ থেকে ঝুলছে প্রচুর সোনালি রং মাখানো জিনিসপত্র। কোনো ঘরের ভেতরেই বাতি বা মোমবাতি থেকে কণামাত্র আলো ঠিকরে পড়ছে না। কিন্তু প্রতি জানালার পেছনের বারান্দায় রাখা হয়েছে একটি করে ভারী ত্রিপদী; তার ওপরে স্থাপিত অগ্নিপাত্র থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি রঙিন কাচের ভেতর দিয়ে ঢুকে ঘরকে উজ্জ্বল আভায় আলোকিত করে তুলেছে। এভাবে সমস্ত বাড়িটাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটা অদ্ভুত আলোকবৈচিত্র্য। কিন্তু পশ্চিমদিকের অথবা কালো ঘরটিতে অগ্নিপাত্র থেকে বিচ্ছুরিত আলোকপাতের ফল হয়েছে একেবারে অন্যরকম। রক্ত-রঙের কাচের ভেতর দিয়ে অগ্নিপাত্রের আলো এসে কালো কালো ঝুলন্ত আসবাবপত্রের ওপর পড়ে একটা ভৌতিক রং-বৈচিত্র্যের সৃষ্টি করেছে, আর যারাই ঘরে ঢুকছে তাদের মুখের ওপর সেই আলো পড়ে এমন একটা অমানুষিক দৃশ্য রচনা করেছে, তা দেখে অন্য কেউ সে ঘরে পা ফেলতে সাহস করছে না। 

আবার সেই ঘরের পশ্চিম দিকের দেয়ালের গায়েই দাঁড়িয়ে আছে আবলুস কাঠের একটা প্রকা- ঘড়ি। তার পেন্ডুলামটা এদিক-ওদিক দুুলছে একটা একঘেয়ে ভারী টকটক আওয়াজ করে। যখন মিনিটের কাঁটাটা ঘুরে যাচ্ছে, যখন এক ঘণ্টার পরে ঘড়িটা বাজছে, তখনই ঘড়িটার ধাতব ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসছে একটা স্পষ্ট ও জোরালো অথচ গম্ভীর এবং অত্যন্ত সুরেলা ধ্বনি। কিন্তু সে ধ্বনির তাল ও জোর এমনই যে প্রতি একটি ঘণ্টা পার হতেই অর্কেস্ট্রার বাজিয়েরা সে শব্দ শোনার জন্য কিছুক্ষণের জন্য তাদের বাজনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে যারা ওয়াল্জ নাচে তারাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফলে ফুর্তিবাজ পুরো দলটাই কিছুক্ষণের জন্য বেসামাল হয়ে যায়। ঘড়িটা কিন্তু তখনো বাজতেই থাকে, আর তখনই দেখা যায় যারা ছিল চঞ্চল তারা বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ও অবসরপ্রাপ্তরা ভ্রুতে হাত বুলোচ্ছে, যেন কোনো দিবাস্বপ্নে বা ধ্যানে ডুবে গেছে। কিন্তু যেই তার প্রতিধ্বনি সম্পূর্ণ থেমে যাচ্ছে, অমনি একটা হালকা হাসিতে ঘরটা ভরে ওঠে; নিজেদের ¯œায়বিক দুর্বলতা ও বোকামির জন্য বাজিয়েরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে আর ফিসফিস করে একে অন্যের কাছে প্রতিজ্ঞা করে আবার যখন ঘড়িটা বাজবে তখন তারা যেন এ রকম বেহাল হয়ে না পড়ে। কিন্তু ষাটটি মিনিট (যেটা উড়ে-যাওয়া কালের তিন হাজার ছশো সেকেন্ডের সমান) পার হতেই আবার যখন ঘড়িটা বেজে ওঠে, তখনই দেখা দেয় আগের মতো সেই একই বেহাল, কম্পমান ও ধ্যানের পরিস্থিতি। 

কিন্তু এতসব সত্ত্বেও সে হই-হল্লার আসরটা ছিল যেমন আনন্দমুখর তেমনি সূক্ষ্ম। শুধু ফ্যাশনমাফিক সে চলে না। তার পরিকল্পনা দুঃসাহসিক ও অগ্নিময়; তার ধ্যান-ধারণায় বর্বরতার উজ্জ্বল দীপ্তি। হয়তো কেউ কেউ তাকে পাগল মনে করত। কিন্তু তার অনুচররা তা ভাবত না। সে যে পাগল নয়, সেটা নিশ্চিতরূপে বুঝতে হলে তার কথা শোনা দরকার, তাকে দেখা দরকার, তাকে স্পর্শ করা দরকার। 

এই বিরাট উৎসব উপলক্ষে তার নির্দেশক্রমেই এই সাতটি ঘরের অস্থাবর সাজসজ্জাগুলোকে সরানো-নড়ানো হয়েছে। তার রুচিসম্পন্ন পরিচালনাগুণেই মুখোশধারীদের চরিত্রে নতুন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। সত্যি, তারা সবাই ছিল কিম্ভূতকিমাকার। তাদের মধ্যে ছিল দীপ্তি, চাকচিক্য, তীব্রতা ও ভৌতিকতাÑ‘হেরনানি’তে যা কিছু দেখা গিয়েছিল, তার অনেক কিছুই ছিল। অদ্ভুত সব আরবি অলংকরণও ছিল। এমন সব মাথাপাগলা কল্পনার খেলা ছিল, যা কেবল পাগলদেরই মানায়। সেখানে ছিল অনেক কিছু সুন্দর, অনেক কিছু কামপরায়ণ, অনেক কিছু কিম্ভূতকিমাকার, কিছুটা ভয়ংকর, আবার বিরক্তিকর, যা ছিল তাও সামান্য নয়। সাতটি ঘরময় যেন সগর্বে ঘুরে বেড়াচ্ছিল অসংখ্য স্বপ্ন। আর এরা এই স্বপ্নরাÑএঁকেবেঁকে ঘুরছিল এ-ঘর থেকে ও-ঘরে, নানান ঘরের রং মেখে মেখে; মনে হচ্ছিল অর্কেস্ট্রার উন্মত্ত সুরগুলো বুঝিবা তাদেরই পদশব্দের প্রতিধ্বনি। আরে! ওই তো ভেলভেটে ঢাকা হলঘরের আবলুস কাঠের ঘড়িটা বাজছে। তারপরই মুহূর্তের জন্য সবই স্তব্ধ, সবই নিশ্চুপ, একমাত্র ঘড়ির শব্দ ছাড়া। স্বপ্নগুলো দাঁড়িয়ে পড়েছেÑযেন জমাট বরফে তৈরি। কিন্তু ঘড়িটার শব্দের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে গেল এক মুহূর্ত পরেই; আর একটা হালকা, চাপা হাসি যেন সেই প্রতিধ্বনির পেছনে ভেসে চলে গেল। আবার বাজনা বেজে উঠল, স্বপ্নরা বেঁচে উঠল, ত্রিপদীর আলোর বিচিত্র ¯্রােত গায়ে মেখে এঁকেবেঁকে আনন্দিত পদক্ষেপে চলতে লাগল এ-ঘর থেকে ও-ঘরে। কিন্তু পশ্চিম দিকের সাতটা ঘরের একেবারে শেষের ঘরটাতে কোনো মুখোশধারীই সাহস করে ঢুকল না। কারণ রাত শেষ হয়ে আসছে; রক্তরাঙা কাচের ভেতর দিয়ে আসছে অধিকতর লাল আলোর রেখা; কালো পর্দাগুলো ভয়াবহ দেখাচ্ছে; কাছাকাছি থাকা আবলুস কাঠের ঘড়িটা থেকে যে শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেটা দূরের অন্যান্য ঘর অপেক্ষা এই ঘরটাতে যে ঢুকছে, তার কানে বাজছে অনেক বেশি গম্ভীর আওয়াজে। 

কিন্তু অন্য সব ঘর ভিড়ে ঠাসাঠাসি; সেখানে জীবনের স্পন্দন বাজছে তীব্রতর সুরে। হইহুল্লোড় একতালেই চলতে চলতে একসময় ঘড়িতে বেজে উঠল মধ্যরাতের ঘণ্টা। তখন থেমে গেল বাজনা; শান্ত হলো ওয়াল্জ-নাচিয়েদের পায়ের তাল; সবকিছুই অস্বস্তিকরভাবে থেমে গেল। এবার শুরু হলো ঘড়িতে বারোটা বাজার শব্দ; আর হুল্লোড়কারীদের মধ্যে যারা একটু বেশি চিন্তাশীল, তাদের মাথায় ঢুকল আরও বেশি চিন্তা। এভাবে ঘড়ির শেষ শব্দের প্রতিধ্বনিটা সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ভিড়ের ভেতরকার কিছু লোকের নজর পড়ল এমন একটি মুখোশধারী মূর্তির ওপর, যাকে এর আগে কেউই চোখে দেখেনি। ক্রমে এই নতুন উপস্থিতির কথা কানে কানে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই মুখে মুখে উঠল একটা গুঞ্জন, অথবা বলা যায় আপত্তি ও বিস্ময়ের একটা অস্পষ্ট শোরগোলÑআর শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়ে উঠল ভয়, আতঙ্ক ও বিরক্তির উচ্ছ্বাস। 

যে ধরনের ভৌতিক সমাবেশের ছবি আমি এঁকেছি, তাতে সহজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে যেকোনো সাধারণ উপস্থিতি তাদের মধ্যে এত বেশি উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারত না। আসলে সে রাতের মুখোশধারী নৃত্যের আসরে যোগদানের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল ঢালাওভাবে; কিন্তু আলোচ্য মূর্তিটি সবার ওপর টেক্কা দিয়ে স্বয়ং যুবরাজের আরোপিত বিধি-নিষেধকেও ভঙ্গ করছিল। উপস্থিত গোটা দলই অনুভব করল, কি পোশাকে, কি আচরণে নবাগত লোকটি বুদ্ধি বা শালীনতার কোনো স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। মূর্তিটি দীর্ঘদেহ ও ক্ষীণকায়; তার আপাদমস্তক কবরের পোশাকে ঢাকা। যে মুখোশটা সে পরেছে, সেটা দেখতে এত বেশি একটা শক্ত মৃতদেহের মুখের মতো যে, খুব ভালো করে লক্ষ করলেও ফাঁকিটা ধরা বেশ শক্ত। তবু আনন্দে অধীর হল্লাকারীরা এ সবকিছুই হয়তো সহ্য করত। কিন্তু ততক্ষণে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, এই মূর্তিটিই ‘লাল মৃত্যু’। তার পোশাক রক্তে চুবানো,Ñচওড়া ভ্রুসহ চোখ, নাক, মুখ সর্বত্রই ছিঁটানো হয়েছে রক্তিম আতঙ্ক। 

যুবরাজ প্রস্পেরোর চোখ পড়ল ভৌতিক মূর্তিটার ওপর (যেন নিজের ভূমিকাটিকে পুরোপুরি বজায় রাখতেই সে তখন ধীর গম্ভীরভাবে ঘুরছে ওয়াল্জ-নাচিয়েদের সঙ্গে); প্রথমেই সে বিচিলত হয়ে উঠল; ভয়ে হোক বিরক্তিতে হোক, তার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল; কিন্তু পরমুহূর্তেই তার ভ্রু ক্রোধে রাঙা হয়ে উঠল। 

কর্কশ গলায় পাশে দাঁড়ানো পারিষদদের বলে উঠল, ‘কার এত সাহস? এমন অপবিত্র পরিহাসের দ্বারা আমাদের অপমান করার সাহস হলো কার? তাকে পাকড়াও করো; তার মুখোশ খুলে নাওÑতার মুখ আমাদের দেখতে দাও, যাকে কাল সূর্যোদয়ের কালে ফাঁসিতে ঝোলাতে হবে।’ 

পুবদিকের বা নীল ঘরে দাঁড়িয়ে যুবরাজ প্রস্পেরো কথাগুলো বলল। তার সুস্পষ্ট জোরালো প্রতিধ্বনি শোনা গেল সাতটি ঘরেইÑকারণ যুবরাজ সাহসী ও শক্তসমর্থ, আর তার হাতের দোলায় সব বাজনা গেছে বন্ধ হয়ে। 

নীল ঘরে যুবরাজের পাশে তখন ম্লান মুখে দাঁড়িয়েছিল একদল পারিষদ। যুবরাজের হুকুম শুনেই কিছু লোক নবাগতের দিকে এগিয়ে গেল। সে-ও কাছেই ছিল। এবার বড়ো বড়ো পা ফেলে যুবরাজের আরও কাছে এলো। কিন্তু ইতোমধ্যেই যে গুজবটি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার অজানা ভয়েই দলের কোনো লোক তার গায়ে হাত লাগাতে সাহস করল না। ফলে বিনা বাধায় সে যুবরাজের এক গজের মধ্যে পৌঁছে গেল। সমবেত পারিষদবর্গ তখন একসঙ্গে ঘরের মাঝখান থেকে দেয়ালের দিকে সরে গেল, আর নবাগত লোকটি বিনা বাধায় সেই একই গুরুগম্ভীর মাপা পদক্ষেপে নীল ঘর থেকে লাল ঘরে, লাল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে কমলাÑসেখান থেকে সাদা, এমননি বেগুনি ঘর হয়ে এগিয়ে চলতে লাগল। কেউ তাকে বন্দি করতে এগিয়ে গেল না। যাহোক, তখনই যুবরাজ প্রস্পেরো নিজের সাময়িক ভীরুতায় ক্রোধে ও লজ্জায় ছয়টা ঘরের ভেতর দিয়ে ছুটতে লাগল। কিন্তু আতঙ্কবিহ্বল পারিষদবর্গের কেউ তাকে অনুসরণ করল না। উদ্যত ছুরি হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে যুবরাজ পৌঁছে গেল চলমান নবাগতের তিন-চার ফুটের মধ্যে। আর সে লোকটিও ভেলভেট ঘরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে পশ্চাদ্ধাবনকারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। ধ্বনিত হলো একটা তীক্ষè ক্রন্দনÑছুরিটা কালো কার্পেটের ওপর পড়ে চকচক করতে লাগল; আর পরমূহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল যুবরাজ প্রস্পেরোর দেহ। তখন হল্লাকারীদের দলটা হতাশাপ্রণোদিত উন্মাদ সাহসে ভর করে কালো ঘরটাতে ঢুকে পড়ে মুখোশধারীকে চেপে ধরল। দীর্ঘ মূর্তিটা কিন্তু আবলুস কাঠের ঘড়িটার ছায়ায় সোজা হয়ে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আর আক্রমণকারীরা যখন বুঝতে পারল কবরের পোশাকে ঢাকা মৃতের মুখোশ-আঁটা যে মূর্তিটাকে তারা এমন নির্দয়ভাবে চেপে ধরেছে, তার ভেতরে কোনো সত্যিকারের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দেহ নেই, তখন অনুচ্চারিত আতঙ্কে তারা হতবাক হয়ে গেল। 

এতক্ষণে তারা বুঝতে পারল এই মূর্তিই ‘লাল মৃত্যু’। সে এসেছে রাতের অন্ধকারে চোরের মতো। অমনি একের পর এক হুল্লোড়কারীরা ঢলে পড়তে লাগল রক্তছড়ানো মেঝের ওপর। যে যেভাবে পড়ল সেভাবেই মরল। সর্বশেষ পারিষদটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আবলুস কাঠের ঘড়িটার জীবনবায়ুও বেরিয়ে গেল। নিভে গেল ত্রিপদীর অগ্নিশিখা। সকলের ওপর প্রসারিত হলো অন্ধকার, ধ্বংস ও লাল মৃত্যুর সীমাহীন শাসনদ-।

অনুবাদ : মণীন্দ্র দত্ত


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ