একজন হোসেন আলী : জহিরুল ইসলামের গল্প


বাইরে থেকে ফিরে নিজের জুতাপলিশের বাক্সটা প্রতিদিনকার মতো দরজার সামনে রাখল হোসেন আলী। তারপর গিন্নিকে বলল বাইরের গোসলখানায় লুঙ্গি-গামছা দিতে। একবারে গোসল সেরে ঘরে ঢুকবে সে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে এটা রুটিন ওয়ার্ক হোসেন আলীর। সারাদিন রাস্তার পাশের ধুলাবালির মধ্যে বসে থাকা আর মানুষের স্যান্ডেল-জুতা, কালি-ব্রাশ নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে পুরো শরীরই নোংরা হয়ে যায় তার। গত তিরিশ বছর ধরে এই নিয়মেই বাঁধা তার জীবন।

আমাদের এই দেশে নানান ধরনের জীবনকাহিনীর মানুষ আছে। কিন্তু হোসেন আলীর জীবনের গল্পটা একটু বেশিই ব্যতিক্রমী। ছোটবেলার বা বাবা-মায়ের কোনো স্মৃতি তার মনে নেই। নিজের জীবনের পেছনের কথা ভাবতে গেলে সবচেয়ে পুরনো যে স্মৃতিটার কথা তার মনে পড়ে সেটা হলো, এই মফস্বল শহরের শহীদ মিনারের বেদিতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানোর কথা। তার বাবা-মা কেমন ছিল, তাদের সাথে কেমন করে বিচ্ছেদ হলো, তারা হিন্দু নাকি মুসলমান, তার কোনো ভাইবোন ছিল কি না, কোনো কিছুই মনে করতে পারে না হোসেন আলী। এমনকি তার নামটা কবে থেকে হোসেন আলী হলো তা-ও তার মনে নেই। তবে শহীদ মিনারে রাত কাটানোর এক সঙ্গী ছিল তার। সেই সঙ্গী পরে বন্ধুতে রূপ নেয়। সেই বন্ধুটির কথা খুব করে মনে পড়ে তার। বাজারের মানুষের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে খাওয়া থেকে ঘুমানো পর্যন্ত দুজন একসঙ্গেই চলত।

হোসেন আলীর বয়স যখন বছর দশেক তখন একজন ভদ্রলোক তাকে জুতাপলিশের একটা বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে দেয়। সেই বাক্স নিয়ে বাজারের জুতাপলিশপট্টিতে বসতে গিয়ে প্রথমেই দেখা দেয় বিপত্তি। রবিদাস সম্প্রদায়ের জুতাপালিশওয়ালারা তাদের পাশে একজন মুসলমান ছেলেকে বসতে দিতে কোনোমতেই রাজি নয়। উপায় না দেখে বাজারের অন্য প্রান্তে একটা তালগাছের নিচে একটা চট বিছিয়ে জুতাপলিশের বাক্স নিয়ে বসে পড়ে হোসেন আলী।

প্রথম প্রথম খুব বেশি কাজ সে পেত না। অবশ্য তার খুব বেশি পয়সার প্রয়োজনও ছিল না। তিনবেলার খাবারের পয়সা জুটলেই খুশি থাকত সে। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই নিজের কিছু গুণের কারণে ব্যবসা বেশ জমিয়ে ফেলে হোসেন আলী। গুণ বলতে, ছোট-বড় সবার সঙ্গেই খুব ভালো ব্যবহার করত সে। সবার সঙ্গে সব সময় হেসে হেসে কথা বলত। টাকাপয়সা নিয়ে কখনও দামাদামি করত না। কাজ করার পর যে যা দিত তা-ই খুশি মনে গ্রহণ করত। ছোট বাচ্চারা বাসা থেকে স্যান্ডেল-জুতা এনে সারাই করে যখন হোসেন আলীর হাতে এক টাকার একটা নোট দিত, তখন সে চার আনা পয়সা ওই বাচ্চাটির হাতে গুঁজে দিত চকলেট খাওয়ার জন্য। এসব কারণে খুব অল্প সময়েই জমে যায় তার জুতাপলিশ ও সারাইয়ের ব্যবসা। একসময় সে তার বসার জায়গাটিকে একটি খুপরি ঘরে রূপ দেয়। সামনে কাঠের দুটো বেঞ্চ পেতে দেয় যাতে কাস্টমারদের এসে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। এদিকে পৌরসভার বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে নিয়মিত যাতায়াত করতে করতে কিছুটা লেখাপড়াও শিখে ফেলে হোসেন আলী। সেই লেখাপড়ার চর্চা চালিয়ে যেতে সে তার দোকানে নিয়মিত একটা দৈনিক পত্রিকা রাখা শুরু করে। একটা এক ব্যান্ডের রেডিয়োও কিনে ফেলে সে। দিনে যখন হাতে কোনো কাজ না থাকে তখন সে বসে বসে পত্রিকা পড়ে। আর সে যখন কাজে ব্যস্ত থাকে তখন কাস্টমারদের কেউ কেউ সে পত্রিকায় চোখ বুলায়। মাঝে মাঝে স্কুলগামী কোনো কোনো ছাত্রও এসে তার দোকানে বসে পত্রিকা পড়ার জন্য। রাতে রেডিয়োতে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিয়ো পিকিংয়ের খবর শোনে হোসেন আলী। কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা যায়, দেশ-বিদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ খবর হোসেন আলীর বলতে গেলে মুখস্থ। আর এই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে সে তার কাস্টমারদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেত সব সময়। কোনো কাস্টমার জুতা নিয়ে এলে তাকে বসতে দিয়ে সে দেশের বা বিশ্বের আলোচিত ঘটনাগুলো নিয়ে তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিত। মুখে গল্প জুড়লেও তার হাত চলতে থাকত কাস্টমারের ময়লা জুতায় ক্রিম-কালি মাখিয়ে ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে ঝকঝকে তকতকে করে তোলার কাজে। যত পুরনো জুতাই হোক, হোসেন আলীর হাতে পড়লে তা অন্য রূপ ধারণ করত। কাজের ফাঁকে তার এই গল্প বলার কারণে কাস্টমাররা একদিকে বসে বসে সময় কাটানোর বিরক্তি থেকে রেহাই পেত, অন্যদিকে তার এসব আলোচনায় বেশ মজাও পেত।

লুঙ্গি আর গামছা এগিয়ে দিতে দিতে হোসেন আলীর গিন্নি বলতে থাকে, তাড়াতাড়ি গোসল করে ঘরে আসো। মেয়ে আর মেয়েজামাই তোমার জন্য বসে আছে। তোমার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে। হোসেন আলীর দুই মেয়ে আর এক ছেলে। সবার ছোট ছেলে। সে পড়ে ক্লাস ফোরে। ছোট মেয়ে স্থানীয় একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। আর বড় মেয়েকে এইচএসসি পাস করার পরেই বিয়ে দিয়েছে একই উপজেলার এক ছেলের সঙ্গে। পেশায় জুতাপলিশওয়ালা হলেও তার সংসারে সচ্ছলতার অভাব ছিল না কোনোদিন। বাজারের যে জায়গাটিতে সে প্রথম দোকান সাজিয়ে বসেছিল, ভালো আচরণের কারণে সেটি তার নামে স্থায়ী লিজ দিয়ে দিয়েছে প্রশাসনের লোকজন। আস্তে আস্তে টাকা জমিয়ে বাজার থেকে মাইলখানেক দূরে কমদামে চার কাঠা জমি কিনে তাতে আধাপাকা বাড়ি বানিয়েছে হোসেন আলী। নিজে বিয়ে করেছে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছে, এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, এরপরেও ব্যাংকে জমানো বেশ কিছু টাকা তার আছে। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় পাত্রপক্ষের কোনো দাবিদাওয়া না থাকলেও আর দশটা মধ্যবিত্ত অভিভাবকের মেয়ের বিয়েতে সামাজিকভাবে যা কিছু দেওয়া হয় তার কোনো কিছুতেই কমতি রাখেনি সে। নিজের কোনো আত্মীয়-স্বজন না থাকলেও মেয়ের বিয়েতে বরপক্ষের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার গণ্যমান্য লোকদের দাওয়াত করে খাইয়েছে। এ অবস্থায় কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য মেয়ে আর মেয়েজামাই এসে বসে রয়েছে চিন্তা করে পায় না হোসেন আলী।

গোসল সেরে ঘরে ঢুকে একটা স্যান্ডোগেঞ্জি পরে সে বারান্দায় মেয়ে আর মেয়েজামাইর সামনে হাজির হয়। মেয়ে আর মেয়েজামাই-ই শুধু নয়, সেখানে উপস্থিত তার গিন্নি এবং ছোট মেয়েও। সবার চেহারার দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে ঘটনা সম্ভবত বেশ গুরুতরই, কিন্তু ব্যাপারটা কী সে আন্দাজ করতে পারে না। মেয়ে আর জামাইর কুশল জিজ্ঞেস করার পর একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে সে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার বলো তো? কী এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলাপের জন্য সবাই বসে আছ?

হোসেন আলী জুতাপলিশওয়ালা হলেও সে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না কখনোই। রেডিয়ো কিংবা পত্রপত্রিকার ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে সে। তার পেশার অন্য লোকদের মতো সেও যে অশিক্ষিত না, এটা প্রমাণ করার জন্যই দীর্ঘদিন সে এই চেষ্টাটা করে আসছে।

প্রথমে আমতা আমতা করে মুখ খুলল বড় মেয়ে। সে বলল, বাবা, তোমার বাজারের কাজটা ছেড়ে দিতে হবে। কারণ তোমার ওই কাজের জন্য আমরা কেউই সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়-স্বজন তোমার কাজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে কোনো জবাব দিতে পারি না।

মেয়ের কথায় যেন আকাশ থেকে পড়ল হোসেন আলী। এতদিন পরে এরা কী বলছে? একটু থেমে সে নিজের গিন্নিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মত? তুমিও কি চাও আমি কাজটা ছেড়ে দিই?

গিন্নি খুব নিচু স্বরে বলল, ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, ওরা যখন চাচ্ছে না…

হোসেন আলী এবার মেয়েজামাইর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তুমি আমার মেয়েকে যখন বিয়ে করেছ তখন তো জানতে যে তোমার হবু শ্বশুর এমন একটা পেশার সঙ্গে জড়িত, যে পরিচয় অন্যদেরকে দেওয়া যাবে না, তাই না? তাহলে তখন কেন আপত্তি করলে না?

এ কথার উত্তরে মেয়েজামাই বলল, বাবা দেখেন, একসময় হয়তো আপনার এই কাজটা করা খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন আর দরকার নেই। আপনার মেয়ের মুখে শুনেছি, ব্যাংকে আপনার বেশ কিছু টাকা জমা আছে। দরকার হলে আমিও আপনাকে কিছু সাহায্য করব। এসব টাকা দিয়ে আপনি অন্য একটা ব্যবসা শুরু করুন। এতে আপনার কামাইও ঠিক থাকবে, আর আমরাও সমাজে মুখ দেখাতে পারব।

এবারে কিছুটা সময় নিল হোসেন আলী। এরপর একমুহূর্তে সবার মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে বলতে লাগল, দেখো, তোমাদের কাছে আমার কাজটা লজ্জাজনক মনে হতে পারে, কিন্তু আমি এর মধ্যে লজ্জার কিছু খুঁজে পাই না। কারণ আমার জীবনে যা কিছু অর্জন, তার সবই আমি এই কাজের মাধ্যমে পেয়েছি। একটা সময় আমি মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে খেতাম। কিন্তু এই কাজ শুরু করার পর আমাকে আর কারও কাছে হাত পাততে হয়নি। বরং মানুষের বিপদে-আপদে যতটা সম্ভব সহযোগিতা আমিই করেছি। তোমাদের কাছে যে কাজটা আজ ঘৃণিত, অপমানজনক, যে কাজের পরিচয় দিতে তোমাদের বাধে, সেই কাজের আয় দিয়েই এ পর্যন্ত তোমাদের সবকিছু চলে এসেছে। এই কাজের আয় দিয়ে তোমরা খেয়েপরে বড় হয়েছ, এই বাড়ি আমি করেছি এই কাজ দিয়ে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছি এই কাজ দিয়ে। হ্যাঁ, তোমরা যেভাবে বলছ, আমার কাছে এখন যে টাকাপয়সা আছে তাতে নিশ্চয় আমি অন্য কোনো কাজ শুরু করতে পারি। কিন্তু তা আমি করব না। তাতে আমার পুরো অতীতটাকে অস্বীকার করা হবে, অবজ্ঞা করা হবে। যে কাজ আমাকে এত কিছু দিয়েছে, তাকে আমি ছোট করতে পারব না। বরং এই কাজ নিয়ে আমি এতকাল যেমন গর্ব করেছি, আগামীতেও গর্বের সঙ্গেই এ কাজ আমি করে যাব। কারণ এই কাজ করে আমি মানুষের প্রশংসা পেয়েছি, ভালো ব্যবহার পেয়েছি। পেশাদার জুতাপলিশওয়ালাদের বাদ দিয়ে মানুষ আমার কাছে ছুটে এসেছে, আমার হাতের কাজের প্রশংসা করেছে। ছোট কাজ করি বলে আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ অসম্মান করে কথা বলেনি। এতদিন পরে আমি সেসব মানুষের ভালোবাসা আর সম্মানকে অস্বীকার করতে পারব না।

একটু থেমে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে হোসেন আলী, সমাজে চলতে গিয়ে অনেকের মুখেই শুনেছি, কোনো কাজকেই ছোট করে দেখতে নেই, যদি সেটা সৎকাজ হয়। তোমরাও হয়তো শুনেছ। নিজেদের বড় মনের পরিচয় দেওয়ার জন্য তোমরাও হয়তো কখনও কখনও এমন কথা বলবে বা বলেছ। কিন্তু আজ আমার সন্দেহ হচ্ছে, যারা এসব কথা বলে বেড়ায় তারা আসলে মন থেকে এসব বলে না। ভাবতে অবাক লাগছে, তোমরা সমাজে অনেক চোর, বাটপাড়, ঘুষখোর, লুটেরা আর অসৎ লোকদের সালাম দিয়ে চলো, তাতে তোমাদের লজ্জা হয় না। কিন্তু আমি সৎকাজ করে জীবন কাটাচ্ছি, সেটা তোমাদের লজ্জার কারণ। এতদিন পরে বুঝতে পারছি, আমার চিন্তার সঙ্গে তোমাদের চিন্তার অনেক অনেক অমিল। তাই আজ স্পষ্ট করে বলছি, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি আমার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করো, একজন জুতাপলিশওয়ালার স্ত্রী, সন্তান বা জামাই বলে যদি সমাজে নিজেদেরকে ছোট ভাবো, তাহলে সে এই মুহূর্তে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো। আমি কিছুই মনে করব না, এবং সামান্য কষ্ট পর্যন্ত পাব না। এটাই আমার শেষ কথা। এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার সামনে থেকে নিজের জুতাপলিশের বাক্সটা ঘরের মধ্যে এনে তার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে রাখে হোসেন আলী।


লেখক পরিচিতি 
জহিরুল ইসলাম
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিশুসাহিত্যিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ