তিতলি ও তার দুষ্টু পুতুল : জহিরুল ইসলাম


এই মীনা, ওখানে কী করছো?

তিতলির এ কথার কোনো উত্তর দিলো না মীনা। সে নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত রইলো।

তিতলির বিছানার কাছে আলমারির একেবারে ওপরের তাকের বইয়ের নাগাল পেতে মীনাকে অবশ্য বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। চেয়ারের ওপর লম্বা একটা টুল রেখে তার ওপর উঠে বসতে হয়েছে ওকে। সেই টুলের ওপর বসে সে পা নাড়াচ্ছে আর ‘পুতুল পুতুল’ নামের একটি বই বের করে সেই বইয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তিতলি এবার অনেকটা ধমকের সুরেই বললো, এই মীনা, কী করছো ওখানে? বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছো কেন?

পড়ছি। সংক্ষেপে বললো মীনা।

আমার বই নষ্ট হয়ে যাবে তো! এইতো সেদিন বাবা বইটা কিনে দিয়েছেন।

মীনা বললো, বই তো পড়ার জন্যই, নাকি? তোমার কি মনে হয় বই শুধু আলমারিতে সাজিয়ে রাখার জন্য?

এ কথায় একটু লজ্জা পেলো তিতলি। কারণ বইয়ের আলমারির অনেক বইই এখনও ওর পড়া হয়নি। বিভিন্ন জন উপহার দিয়েছে আর সে সাজিয়ে রেখেছে।

তিতলি বললো, না তা নয়, বই তো পড়ার জন্যই। কিন্তু তুমি তো মানুষ নও, পতুল। তোমার আবার কিসের পড়া?

তিতলি বুঝলো এ কোনো যা-তা পুতুল নয়। বড়ো ফাজিল টাইপের পুতুল এটি। আজ স্কুল থেকে ফিরে যখন নতুন পুতুলটি হাতে পেলো তিতলি তখন তো এটি এতো ফাজিল ছিলো না! চেহারায় কী সুন্দর শান্ত শান্ত একটা ভাব। চোখ দুটো মিটমিট করছিলো। তিতলি আদর করে ওর নাম দিয়েছে মীনা। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মীনাকে নিয়ে ঘুমিয়েছে তিতলি। কিন্তু ঘুমানোর পরপরই ঝামেলা শুরু করলো ফাজিল পুতুলটা। তিতলি ঘুমিয়ে আছে। এদিকে কোন ফাঁকে মীনা উঠে ওর বইয়ের আলমারি ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছে!

তিতলি আবার পুতুলটিকে ডাকলো, এই মীনা তুমি কিন্তু ভীষণ দুষ্টুমি করছো। এ রকম করলে তোমাকে কিন্তু আমি একটুও আদর করবো না। তুলির কাছে দিয়ে দেবো। তখন দেখবে উঠতে বসতে কেমন পিট্টি লাগায় তোমাকে। এক দিনেই একদম সোজা হয়ে যাবে।

তিতলির এবারকার কথাগুলো মনে হয় মীনার কানে লাগলো। সে বইটা বন্ধ করে মীনার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, কী বলছো তিতলি আপু! আমি তো পড়ছি, দুষ্টুমি করছি কোথায়? পড়াশোনা কি দুষ্টুমি?

না, পড়াশোনা দুষ্টুমি নয়। এসো তো আমার কাছে, দেখি তুমি কী পড়াশোনা করছো? বললো তিতলি।

মীনা এবার আস্তে আস্তে টুল থেকে নামলো। এগিয়ে এলো তিতলির খাটের কাছে। তার হাতে ‘পুতুল পুতুল’ নামের সেই বইটি। বইটি তিতলির হাতে দিয়ে মীনা বললো, জানো আপু, এই বইটা না আমি আগেই পড়েছি। আমি কী পড়াশোনা করছি দেখবে? তাহলে এই বই থেকে জিজ্ঞেস করো আমি আসলেই পড়শোনা করছি নাকি তোমার প্রিয় বইগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে শুধু শুধুই নষ্ট করছি।

তিতলি বইটি উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বলো তো পুতুল সম্পর্কে তুমি কী জানো?

শুনবে কী জানি? মীনা জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, শুনবো বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।

আচ্ছা তাহলে শোনো।

আজ থেকে চার হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে ব্যাবিলনের লোকেরা বিশ্বাস করতো যে মানুষ মারা যাওয়ার পর কবরের মধ্যে তারা আবার জীবিত হয়। তাই তখনকার দিনে কারও মৃত্যু হলে তার সঙ্গে কবরের ভেতর প্রচুর খাবারদাবার দেওয়া হতো। আর কোনো ছোট্ট শিশু মারা গেলে তার সঙ্গে দেওয়া হতো তার প্রিয় পুতুলগুলো।

তিতলি আশ্চর্য হয়ে বললো, তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। বললো মীনা।

রোমান এবং গ্রিক মেয়েশিশুদের সঙ্গেও তখন তার প্রিয় পুতুলকে দিয়ে দেওয়া হতো। তাদের ধারণা ছিলো, তাদের প্রিয় মেয়েশিশুটি একসময় কবরের মধ্যে জেগে উঠবে। তখন সে তার প্রিয় পুতুলটি নিয়ে খেলবে।

একটু থেমে মীনা আবার বললো, জানো তিতলি আপু, আগেকার দিনের পুতুলদের আমার মতো প্লাস্টিক বা রাবার দিয়ে তৈরি করা হতো না। তখন মাটি, কাঠ, টুকরো কাপড় ইত্যাদি দিয়ে পুতুল বানানো হতো। মোম দিয়েও একসময় পুতুল বানানো হতো। তবে হাত পা নাড়ানো পুতুল প্রথম তৈরি হয় সম্ভবত আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও আগে।

তিতলি বললো, বাহ! তুমি তো অনেক কিছুই জানো!

মীনা বললো, বই পড়ে জেনেছি। আরও কী জেনেছি শুনবে? সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের দিকে মোম দিয়েও পুতুল বানানো হতো। আর উনিশ শতকের শুরুতে পোরসালিনের পুতুল বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

তিতলি বললো, ব্যস, এবার একটু থামো। তুমি দেখছি পুতুল সম্পর্কে আসলেই অনেক কিছু জানো। এবার বলো তো, পোরসালিন জিনিসটা আবার কী?

মীনা বললো, হ্যাঁ তুমি ভালো একটা প্রশ্ন করেছো। এক ধরনের মাটিকে বিশেষ কায়দায় ২৩৭২ ডিগ্রি ফারেনহাইট উষ্ণতায় পুড়িয়ে শক্ত করা হয়। পোড়ানোর পর এতে আকর্ষণীয় রং এবং নকশা করা হয়। তবে সব ধরনের মাটি বা কাদা এতো গরম সহ্য করতে পারে না। তাই এর জন্য দরকার বিশেষ ধরনের মাটি।

তিতলি বললো, পোরসালিন তাহলে চীনামাটির মতোই, তাই তো?

হ্যাঁ তাই।

মীনা যতোই কথা বলছিলো তিতলি ততোই অবাক হচ্ছিলো নানা বিষয়ে ওর জ্ঞান দেখে। একটু দম নিয়ে মীনা আবার বলে চললো, আমাদের দেশের মানে বাংলাদেশের মায়েরা যে কবে থেকে তাদের আদরের মেয়ে শিশুটিকে টুকরো কাপড় দিয়ে পুতুল তৈরি করে দিচ্ছেন তা কিন্তু জানা যায়নি। আজকাল আমাদের দেশেও পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের পুতুল পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের মায়েরা এখনও তার বাচ্চাকে টুকরো কিংবা পুরনো কাপড় দিয়ে নিজ হাতে পুতুল বানিয়ে দিচ্ছেন আর শিশুরাও তা নিয়ে মনের আনন্দে খেলছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম কাপড়ের তৈরি পুতুল বাজারে ছাড়ে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার উৎপাদনকারীরা ১৮৫০ সালের দিকে।

মীনা প্রায় দম না নিয়েই বলে যেতে লাগলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুতুল বানানোর জন্য পরীক্ষামূলকভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু হয়। এতে শক্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হয় ১৯৪০-এর দশক থেকে। পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশক হতে রাবার এবং ফোম পুতুল বানানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে হয় একটু কেঁপে উঠলো মীনা। তিতলি জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে? হঠাৎ অমন করছো কেন?

ওই যে আসছেন। বললো মীনা।

কে আসছেন?

মা।

মীনার এ কথায় তিতলি দরজার দিকে তাকালো। তাকিয়ে দেখলো সত্যিই মা তাদের রুমের দিকে আসছেন। মুহূর্তের মধ্যে চোখ বুজে ফেললো তিতলি। এই ফাঁকে মীনাও এসে শুয়ে পড়লো তিতলির পাশে।

মা এসে তিতলির মথায় আলতো করে হাত বুলাতে লাগলেন। কী ব্যাপার তিতলি, সন্ধ্যা হয়ে এলো, এখনও ঘুমিয়ে আছো যে? চলো, হাত মুখ ধুয়ে বিকেশের নাশতা খাবে।

তিতলি আস্তে আস্তে চোখ খুললো। তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন মা। আর তিতলির পাশেই ছোট্ট একটা খেলনা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছে তার আদরের পুতুল মীনা। ওর চোখ দুটো এখন বন্ধ।

মীনার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো তিতলি। তারপর মীনাকে কোলে নিয়ে মায়ের পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করলো।


 লেখক পরিচিতি :
জহিরুল  ইসলাম
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিশুসাহিত্যিক
জন্ম :  মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর, ১৯৬৯



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ