জীবনের পাঁচটি বর /মার্ক টোয়েন

জীবনের প্রভাতকালে একটি ভালো পরী তার ঝুড়ি নিয়ে এসে বলল, ‘এতে কতগুলো উপহার আছে। একটি নাও, বাকিগুলো রেখে দাও। সাবধান, খুব বুদ্ধি করে পছন্দ করোÑআহা; খুব বুদ্ধি করে পছন্দ করো! কারণ এদের মধ্যে শুধু একটিই মূল্যবান।’

উপহার ছিল পাঁচটিÑযশ, ভালোবাসা, অর্থ, সুখ, মৃত্যু।

এক যুবক সাগ্রহে বলল : ‘চিন্তা করার কোনো দরকার নেই’! সে সুখ পছন্দ করল। 

সে পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়ল আর যৌবনে উপভোগ করার মতো সমস্ত সুখ খুঁজে নিল। কিন্তু সময় এলে দেখা গেল সমস্ত সুখই স্বল্পস্থায়ী ও হতাশাব্যঞ্জক, ব্যর্থ এবং শূন্য; এবং তারা প্রত্যেকেই চলে যাওয়ার সময় তাকে অবজ্ঞা করে যায়। অবশেষে যুবক বলল, ‘এতগুলো বছর আমি নষ্ট করলাম! যদি আর একবার পছন্দ করার সুযোগ পেতাম, তাহলে বুদ্ধিমানের মতো পছন্দ করতাম।’

পরী এসে বলল, ‘চারটি উপহার বাকি আছে। আর একবার পছন্দ করো। আর মনে রেখÑসময় চলে যাচ্ছে, আর এদের মধ্যে কেবল একটিই হলো মূল্যবান।’

লোকটি অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করল, তারপর ‘ভালোবাসা’ বেছে নিল। পরীর চোখে যে জল দেখা দিল, তা সে লক্ষ্য করল না। 

অনেক অনেক বছর পরে লোকটিকে একটা শূন্য বাড়িতে একটি মৃতদেহের পাশে বসে থাকতে দেখা গেল। সে আপনমনে বলছে, ‘একের পর এক তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে; আর এখন এখানে শুয়ে আছে সে, আমার শেষ প্রিয়তমা। নিঃসঙ্গতার পর নিঃসঙ্গতা এসে আমাকে বিধ্বস্ত করেছে; কারণ সেই বিশ্বাসঘাতক বণিক ‘ভালোবাসা’ আমাকে যে সুখের মুহূর্তগুলো বিক্রি করেছে তার প্রতিটির বিনিময়ে আমি তাকে দিয়েছি হাজার হাজার দুঃখময় মুহূর্ত। তাই আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাকে অভিশাপ দিচ্ছি।’

৩ 

‘আবার পছন্দ করো।’Ñসেই পরী আবার বলল। ‘এতগুলো বছর নিশ্চয়ই তোমার শিক্ষা হয়েছে। তিনটি উপহার বাকি আছে। মনে রেখো এর মধ্যে একটিই হলো মুল্যবান; তাই বুদ্ধি করে পছন্দ করো।’

লোকটি অনেকক্ষণ ভাবল, তারপর বেছে নিল ‘যশ’। আর পরীটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চলে গেল।’

অনেক বছর পার হয়ে গেলে সে আবার এলো এবং লোকটি যখন দিনের শেষে এক নির্জন জায়গায় বসে চিন্তা করছিল তখন তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। সে জানত লোকটির মনের কথা : ‘আমার নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল, আমার প্রশংসা ছিল সকলের মুখে মুখে। কিছু সময়ের জন্য সেটা আমার ভালোও লেগেছিল। কিন্তু সে কত অল্প সময়ের জন্য! তারপর এলো ঈর্ষা; তারপর কুৎসা; তারপর ঘৃণা; তারপর লাঞ্ছনা। তারপর এলো বিদ্রুপ, যাতে আছে শ্লেষের ইঙ্গিত। এবং সবশেষে এলো করুণা, সব খ্যাতির অন্তিম শয্যা। হায়, খ্যাতির পরিণাম কী তিক্ত ও দুঃখবহ! প্রথমে লোকে কাদা ছোড়ে, আর পরিণতিতে দেয় অবজ্ঞা আর অনুকম্পা।’

‘তবু আবার পছন্দ কর।’ পরীর কণ্ঠস্বর। ‘দুটি উপহার বাকি আছে। হতাশ হয়ো না। শুরুতে এদের মধ্যে কেবল একটিই ছিল মূল্যবান, এবং সেটি এখনো এখানে আছে।’

অর্থÑসেই তো শক্তি। আমি কী অন্ধই ছিলাম!’ লোকটি বলল। ‘এতদিন বেঁচে থেকে সুখ পাব। খরচ করব, উড়িয়ে দেব, সকলকে চমকে দেব। যারা আমাকে বিদ্রƒপ করেছে, অবজ্ঞা করেছে, তারা আমার সামনে ধুলোয় গড়াগড়ি যাবে, আর আমি আমার ক্ষুধার্ত হৃদয় তাদের ঈর্ষায় পূর্ণ করব। মনের সমস্ত বিলাস, আনন্দ ও মনোহারি বস্তু এবং দেহের যত সন্তুষ্টি মানুষের কাছে প্রিয়Ñসব আমি পাব। একের পর এক সব আমি কিনব! সমাদর, সম্মান, শ্রদ্ধা, পূজাÑএই অতি সাধারণ পৃথিবীÑজীবনের নকল রসের যে সমস্ত পসরা সাজিয়েছে তার সব আমি কিনব, কিনব, কিনব। অনেক সময় নষ্ট করেছি, আর এতদিন বোকার মতো পছন্দ করেছি; কিন্তু যা হওয়ার তা হয়েছে; তখন মূর্খ ছিলাম, তাই যা ভালো মনে হয়েছে তাই করেছি।’ 

তিনটি বছর পার হয়ে গেল; এমন একদিন এলো যেদিন লোকটি একটি ছোট্ট চিলেকোঠা ঘরে বসে কাঁপছিল। শরীর শুকিয়ে গেছে, চোখ বসে গেছে, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে, পোশাক ছিঁড়ে গেছে; শুকনো রুটির ছিলকা চিবোতে-চিবোতে বিড়বিড় করে বলছে, ‘ধিক জীবনের সব উপহারকে, কারণ তারা শুধু ঠাট্টা আর গিলটি করা মিথ্যাই। মিথ্যাই তাদের বলা হয়, উপহার। তারা উপহার নয় ঋণমাত্র। সুখ, প্রেম, যশ, অর্থ : এরা হলো ব্যথা, শোক, লজ্জা ও দারিদ্র্যÑপৃথিবীর এই সমস্ত স্থায়ী সত্যের সাময়িক ছদ্মবেশ মাত্র। পরী ঠিকই বলেছিল, তার ভাঁড়ারে কেবল একটি উপহারই ছিল দামি, কেবল একটি উপহারই মূল্যহীন নয়। সে উপহার অপরিমেয়; যা মধুর ও প্রিয়, যা স্বপ্নহীন অনন্ত নিদ্রায় ডুবিয়ে দেয় সে ব্যথাকে, যা দেহকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ, আর সেই লজ্জা ও শোককে যা মনকে কুরে-কুরে খায়Ñতার সঙ্গে তুলনায় অন্য উপহারগুলো যে কত সস্তা ও তুচ্ছ, তা আমি আজ বুঝতে পারছি। সেই উপহার আমাকে এনে দাও! আমি ক্লান্ত, আমি বিশ্রাম করব।’

পরী এলো আবার সঙ্গে নিয়ে এলো চারটি উপহার। তার মধ্যে ছিল না ‘মৃত্যু’। সে বলল :

‘আমি এক মায়ের আদরের ছোট্ট শিশুকে সেটা দিয়ে দিয়েছি। সে অজ্ঞান ছিল, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করত, আমাকে বলেছিল পছন্দ করে দিতে। কিন্তু তুমি তো আমাকে পছন্দ করে দিতে বলনি।’

‘ওঃ, কি দুর্ভাগা আমি! আমার জন্য কী বাকি আছে?’

‘যা তোমারও প্রাপ্য নয় : বৃদ্ধ বয়সের অসংযত অপমান।’


অনুবাদ : মণীন্দ্র দত্ত

গল্পটি অডিওতে শুনুন :

লিংক : জীবনের পাঁচটি বর-মার্ক টোয়েন


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ