মাদাম ক্যাসেল-এর উকিল তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন : ধর্মাবতার এবং জুরিদের সভ্যবৃন্দ, যে-মামলার পক্ষে আমাকে আজ আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে সেই মামলার সমাধান করার জন্যে ন্যায় ও নীতির বিচার অনুপযুক্ত। আসামিকে একমাত্র বাজারের ওষুধ খাওয়াতে পারলেই তার অসুখ সেরে যাবে। মনস্তত্ত্বের চেয়ে তাদের কাছে শরীরতত্ত্বটাই বড়ো বেশি প্রয়োজনীয়। প্রথম দৃষ্টিতে ঘটনাগুলি সবই সহজ বলে মনে হবে আপনাদের।
বয়সে যুবক, উদার হৃদয়, প্রচুর অর্থশালী এবং উচ্ছ্বাসময়; সেইসঙ্গে মনটা তাঁর ছিল বেশ উঁচুমানের। এরকম একটি যুবক প্রেমে পড়লেন যে যুবতীটির সঙ্গে তিনিও রূপে যেমন গরীয়সী, গুণে তেমনি মহীয়সী। দেহের অপরূপ লাবণ্যের সঙ্গে মনের লাবণি মিশে তাঁকে এক অপরূপাতে পরিণত করেছিল। সেই মেয়েটিকে তিনি বিবাহ করলেন। কিছুদিন তিনি প্রেমিক মোহগ্রস্ত স্বামীর মতোই তাঁর সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন; তারপরে তিনি তাঁকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করলেন, কড়া-কড়া কথা বললেন; তাঁর প্রতিটি চলাফেরায় খুঁত ধরতে লাগলেন। তাঁর ওপরে যুবকটির একটা দুর্নিবার বিতৃষ্ণা জেগে উঠল; একটা অজেয় ভালো-না-লাগার ভাবটা গ্রাস করে ফেলল তাঁকে। একদিন তিনি তাঁকে প্রহারও করে ফেললেন। এই রকম কুৎসিত ব্যবহার করার তাঁর যে কেবল অধিকারই ছিল না তা নয়; সত্যিকার কোনও কারণও ঘটেনি তাঁর।
তাঁর এই অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্য ব্যবহার কতটা বিকৃত ছিল তার প্রকৃতি বিশদভাবে আলোচনা করার কোনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি না। এই দুটি প্রাণীর দৈনন্দিন জীবনের ক্লেদাক্ত, অনির্বচনীয় দুঃখ এবং সেই যুবতিটি অপরিমেয় ক্ষোভের বিস্তারিত বিবরণও আমি এখানে পেশ করতে চাই না। অবস্থাটা বোঝানোর জন্যে সেই হতভাগ্য উন্মাদ যুবক প্রতিদিন যে ডায়েরি লিখতেন তারই কিছু-কিছু অংশ আমি আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি। কারণ, ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের আলোচনার বস্তু উন্মাদ ছাড়া আর কে? ব্যাপারটা আরও কৌতূহলোদ্দীপক হয়েছে এই কারণে যে, যে হতভাগ্য প্রিন্স সম্প্রতি মারা গিয়েছেন এবং যিনি ব্যাভেরিয়াতে নিষ্কাম প্রেমের রাজত্ব করেছিলেন তাঁরই চরিত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আপনারা এখানে দেখতে পাবেন। কেসটির অন্য নামকরণ করতে চাই আমিÑ একটি রোমান্টিকের উন্মাদনা।
সেই অদ্ভুত রাজকুমারের অনেক কাহিনিই আপনাদের মনে রয়েছে; তাঁর রাজত্বের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটিকে তিনি তৈরি করেছিলেন রূপকথার দুর্গ। বাস্তব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর কাছে যথেষ্ট ছিল না। সেইসব মনোরম স্থানকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্যে তিনি কৃত্রিম সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করতেন; নতুন ধরনের আলো জ্বালাতেন, সুন্দর করে ক্যানভাসের ওপরে কৃত্রিম পাহাড় অরণ্য নদী আঁকতেনÑগাছ আঁকতেনÑশুধু গাছই নয়, সুন্দর-সুন্দর পল্লব আঁকারও ব্যবস্থা করতেন। বিরাট-বিরাট পাহাড়ের ওপরে কৃত্রিম তুষারস্তূপ দেখতে পেতেন আপনারা। এক কথায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে আনন্দ দিতে পারত নাÑতিনি চাইতেন আরও সৌন্দর্যÑসুন্দরকে সুন্দরতর করে তোলার চেষ্টাই তাঁকে উন্মাদের পর্যায়ে নিয়ে হাজির করেছিল। এই মানুষটি বড়ো পবিত্র ছিলেনÑচরিত্রের দিক থেকে এতটুকু কলঙ্ক তাঁর মধ্যে ছিল না। স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই তিনি ভালোবাসতেন না, কাউকেও মনে ধরতো না তাঁর।
একবার এক সুন্দরী যুবতি গায়িকাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি লেকের ওপরে বিহার করছিলেন। তাঁকে রাজকুমার গান গাইতে অনুরোধ করলেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রমণীটি সুন্দর গান গাইলেন; তারপরে ভাবের উচ্ছ্বাসে তিনি রাজকুমারের বুকের ওপরে ঢলে পড়ে তাঁর ওষ্ঠের সঙ্গে নিজের ওষ্ঠ দুটি মিলিয়ে দিলেন। কিন্তু রাজপুত্র তাঁকে লেকের জলে ফেলে দিলেন; তারপরে দাঁড় বেয়ে ফিরে এলেন তীরে। মেয়েটিকে কেউ উদ্ধার করল কি না, সে সংবাদ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি!
ভদ্র মহোদয়গণ, আজ যে কাহিনিটি আমি বলছি এটিও সেই রাজকুমারের অনেক কাহিনির মতোই। এই ভদ্রলোকের ড্রয়ারের মধ্যে যে ডায়েরিটি আমরা পেয়েছি তা থেকেই কিছু অংশ আমরা পড়ছি :
প্রতিটি জিনিস কী কুৎসিত, কী রকম বিবর্ণ! একই জিনিস, বীভৎস; কোনো পরিবর্তন নেই তার, নেই কোনও সুন্দরতম হওয়ার প্রচেষ্টা। আরও সুন্দর, আরও মহৎ, আরও পরিবর্তনশীল একটি জগতের জন্যে কতই-না স্বপ্ন দেখি আমি! যে-ভগবান বার বার একই জিনিস সৃষ্টি করেন, নতুন-নতুন সৃষ্টির দিকে যাঁর কোনও চেষ্টা নেই, মানুষ তাঁকে ভগবান বলে স্বীকার করে কেমনভাবে জানি না; আমার মনে হয় সেরকম কোনো ভগবানের কল্পনা করাটা মানুষের পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক। বনÑসেই এক; নদী-নালা একইভাবে বয়ে চলেছে চিরকাল, পাহাড় পর্বতÑসব একঘেয়ে! আর মানুষ! কী ধরনের দুষ্টু, গর্বিত, আর বিরক্তিকর এই পশুটি!
মানুুষের ভালোবাসা উচিত; হ্যাঁ পাগলের মতো ভালোবাসা উচিত; কিন্তু যাকে ভালোবাসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় হওয়াটা উচিত নয়। কারণ, দেখার অর্থই হচ্ছে বোঝা; আর বোঝার অর্থই হচ্ছে ঘৃণা করা। মদ খেতে খেতে মানুষ যেমন মাতাল হয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত কী খাচ্ছে তা সে বুঝতে পারে না, তেমনি ভালোবাসতে-বাসতে মানুষকে প্রেমের উন্মাদনায় মেতে উঠতে হবে; কাকে ভালোবাসছে তা জানলে তার চলবে না। ভালোবাসার পেয়ালা পূর্ণ করে তা পান করো, দিন-রাত্রি, রাত্রি-দিন, কোনোরকম বিশ্রাম নিয়ো না, বিরতি দিয়ো না এতটুকু।
মনে হচ্ছে, আমি তাকে খুঁজে পেয়েছি। তার সারা সত্তায় এমন একটি আদর্শ জড়িয়ে রয়েছে যা ইহজগতের নয়; আমার স্বপ্নলোকের। আমার স্বপ্নের জগতে যারা বাস করে তাদের সঙ্গে বাস্তব জগতের মানুষের পার্থক্য কত বেশি। আমার প্রেয়সী সুন্দরী, সত্যিকারের সুন্দরী; তার চুলের গোছায় অনির্বচনীয় চারুত্ব মাখানো। তার চোখ দুটি নীল; এই নীলাঞ্জন ছায়াই আমার আত্মাকে উল্লাসে ভরিয়ে তোলে। নারীর সমস্ত সত্তা, আমার অন্তরের গভীরে যার প্রতিফলন রয়েছেÑতার চমৎকারিত্ব আমার চোখে, কেবল আমার চোখে।
হায়রে! কী রহস্যের খেলা চলেছে। এই দুটো চোখ...সারা বিশ্ব ধরা পড়েছে এদের কাছে; কারণ এই চোখ তাকে দেখতে পায়; এর বুকে বিশ্বের ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে। এই চোখের মধ্যেই তো বিশ্বজিনিসপত্র, জীবিত প্রাণী, অরণ্য, সমুদ্র, মানুষ, পশু, পাখি, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারাÑআরও, আরও অনেক কিছু এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে; মানুষের আত্মা, যে-মানুষ চিন্তা করে সে, যে-মানুষ ভালোবাসে সে, যে-মানুষ হাসে, কাঁদেÑসব ওরই মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। নারীর নীল চোখ দুটির মধ্যে একবার তাকিয়ে দেখো; সেখানে সমুদ্র তার গভীরতা নিয়ে প্রকাশ করেছে নিজেকে; আকাশে রঙের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাগরেরও রং বদলাচ্ছে...তারই মধ্যে দিয়ে আমাকে দেখা যায়Ñযে আত্মা মানুষকে উদ্বোধিত করে, স্বর্গীয় করে তোলে মানুষকে।
হ্যাঁ এই আত্মার মধ্যেই আমার রং ছড়িয়ে পড়েছে; কেবল নীল আত্মাই স্বপ্ন দেখে; সমুদ্র আর আকাশের সব নীল স্বপ্নই এ চুরি করে রেখেছে।
আর চোখ? চোখের কথা একবার ভেবে দেখো। চিন্তার খোরাক যোগানোর জন্যে এ সবসময় বাস্তব জগতের মধ্যে ডুবে থাকে। পৃথিবীর সমস্ত রং, রূপ, গতি, স্থিতি, সৌন্দর্য, কদর্যতাÑসবই এ নির্বিশেষে পান করে; এবং তাদের ভেতর যা সৃষ্টি করে তাকেই আমরা বলি কল্পনা। সে যখন আমার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তখন আমার মন একটি পার্র্থিব আনন্দে ভরে ওঠে। যেসব বিষয়ে আমরা অজ্ঞ, যা আমরা জানি না, বুঝি না তা-ই এ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে বাস্তব চিন্তার মতো ঘৃণ্য জঘন্য জিনিস দুনিয়ায় আর কিছু নেই।
তার চলার ধরনটি বড়ো চমৎকার। সেজন্যে তাকে আমি ভালোবাসি। সে যখন চলে তখন মনে হয় না সে এ জগতের কোনো মহিলা। মনে হয় সে স্বর্গের। আমি তাকে বিয়ে করব...আমার ভয় করছেÑঅনেক কারণে ভয় করছে আমার।
দুটি জানোয়ার, দুটি কুকুর, দুটি নেকড়ে, দুটি শেয়াল বনের মধ্যে শিকারের অন্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে পরস্পরের কাছাকাছি এসে পড়ল। একটি পুরুষ, আর একটি মেয়ে। পরস্পর যৌনাচারে লিপ্ত হলো। তারা যে যৌনাচারে লিপ্ত হলো তার পেছনে নিশ্চয় কোনও কারণ ছিল। সেই কারণটা হলো প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে তারা তাদের বংশটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়; তাদের জাত, তাদের বংশ, তাদের চেহারা, আচার, ব্যবহার, গতি, প্রকৃতি, পৃথিবী থেকে যাতে বিলুপ্ত হয়ে না যায় তারই জন্যে এই চেষ্টা।
প্রতিটি জানোয়ার একই কাজ করে; জানে না কেন তারা করে।
আমরাও করি তাই...
বিয়ে করে আমি সেই কাজ করেছি; নারীর সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ার যে একটা অর্থহীন মোহ, আকর্ষণ পুরুষের মধ্যে রয়েছে তারই পূর্তির উদ্দেশ্যে আমি তাকে বিবাহ করেছি।
সে আমার স্ত্রী। যতক্ষণ তাকে আমি কল্পনায় ভোগ করতে চেয়েছিলাম ততক্ষণই সে আমার কাছে ছিল স্বপ্নÑযে স্বপ্নকে মানুষ পেতে পেতে হারিয়ে ফেলে, ধরার মধ্যে এসেও সে ধরার বাইরে চলে যায়।
যে মুহূর্তে তাকে আমি বাহুর ভেতরে পেলাম, যে মুহূর্তে তার স্থূল দেহটি আমার স্থূল দেহের নিবিড় সান্নিধ্যে এসে পড়ল, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো আমার সমস্ত আশা আর স্বপ্নকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলার জন্যে প্রকৃতি তাকে সৃষ্টি করে আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
সত্যিই কি সে আমার সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে? না; করেনি। তবু মনে হলো আমি হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; তাকে আর আমার ভালো লাগছে না, তার দেহ, তার লাবণ্য, তার সৌন্দর্য আমার কাছে যেন ঘৃণার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে; তার চুম্বন আমার কাছে ন্যক্কারজনক মনে হয়েছে, তার আলিঙ্গন মনে হয়েছে ক্লেদাক্ত, তার সঙ্গে যৌন মিলনের কথা ভাবতে গিয়েই অকারণে কণ্টকিত হয়েছে আমার দেহ। মনে হচ্ছে এসব কাজ আমার লুকিয়ে ফেলা দরকার, কোনও সুচারু মনন শিল্পীর কাছে এই মলিন অশোভনীয়।
আমার স্ত্রী যখন হাসতে-হাসতে আমার কাছে এগিয়ে আসত, আমার দিকে চোখ তুলে তাকাত, আমার হাতে তার হাত রাখত তখন আমি তা সহ্য করতে পারতাম না। একদিন ভাবতাম তার চুম্বন আমাকে স্বর্গের অমৃত মদিরা দান করে তৃপ্তি দেবে; একদিন তার সামান্য একটু জ্বর হলো; তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা পচা দেহের মিহি দুর্গন্ধ তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে আমার নাকে এসে লাগল। একেবারে হতাশ হয়ে পড়লাম আমি।
হায়রে, এই মানুষের দেহ, জীবন্ত বিষ্ঠার মতো, চলন্ত ধ্বংসের মতোÑযে ধ্বংস চলে, কথা বলে, হাসে, সোহাগ জানায়, যে দেহ পচা খাবার খায়, সুন্দর, মিষ্টি খাবার যা শেষ পর্যন্ত পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়, এই তো তার দেহ-সুষমা!...
ফুলের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এইখানেই। তারাও সুন্দর, তারাও আমাদের আকর্ষণ করে, আমাদের আত্মিক আকাক্সক্ষাটাকে মাধুর্যের রঙে ভরিয়ে দেয়; তারাও তাদের বংশবৃদ্ধি করে, প্রজনন নীতিতে তারাও বিশ্বাসী এবং পরম উদ্যোগী; কিন্তু মানুষের দেহের মতো তারা মিহি অথচ প্রাণঘাতী পচা গন্ধ ছড়ায় না।...
ছ-মাস পরের ডায়েরি থেকে...নির্বাচিত অংশবিশেষ।
...আমি ফুল ভালোবাসি। ফুল বলে নয়; তাদের ভালোবাসি সুন্দর জীবন্ত বস্তু হিসাবে। আমি তাদের সবুজ পাতার ছাউনির মধ্যে দিন-রাত্রি কাটাই; মহিলাদের মতো তাদের আমি হারেমের মধ্যে লুকিয়ে রাখি।
আমি ছাড়া কে তাদের চেনে? তাদের মিষ্টতা, লাবণ্য, পার্থিব আর সেই সঙ্গে অপার্থিব স্পর্শের মাদকতা আমি ছাড়া আর কে জানে? লাল গোলাপের ঠোঁটের ওপরে আমি যে চুম্বন করি তার শিহরণ আমি ছাড়া আর কে এমনভাবে উপভোগ করে? আমার সবুজ পাতার বাগানে আমি আর আমার মালি ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না। সেখানে প্রবেশ করার সময় মনে হয় আমি এমন একটি নিভৃত মন্দিরে ঢুকছি যেখানে আমার জন্যে অন্তরের সমস্ত আবেগ নিয়ে একটি সুন্দরী হৃদয়ের দ্বার খুলে বসে রয়েছে। তাদের অর্ধবিকশিত ওষ্ঠগুলি আমাকে চুম্বন দেওয়ার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
এরাই, এইসব ফুলেরাই; যারা আমার পাশের ঘর আলো করে রয়েছে, তারা আমার ভৃত্য; তারা আমার প্রিয় নয়। আমার যাওয়া-আসার পথের ধারে তারা তাদের রঙের পেখম মেলে দাঁড়িয়ে থাকে, অভ্যর্থনা জানায় আমাকে। তাদের দেখে আমার মন আনন্দে নেচে ওঠে; ধমনীতে শিরায় শিরায় গরম রক্ত ছুঁটতে থাকে টগবগিয়ে, আমার আত্মা চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাদের স্পর্শ করার জন্যে আমার হাত ছটফট করে। আমি এগিয়ে যাই। আমার উঁচু গ্যালারির পাশে তিনটি বন্ধ দরজা রয়েছে। তিনটি হারেম আমার। যেকোনো একটিতেই আমি প্রবেশ করার অধিকার রাখি।
কিন্তু অর্কিড ফুলগুলিকেই আমি পছন্দ করি বেশি। তাদের ঘরটি নিচু; হাওয়া-বাতাস বিশেষ খেলে না সেখানে। ভিজে গরম বাতাসে আমার গা চিটচিট করে, বাতাসের অভাবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়; আঙুলগুলি কাঁপতে থাকে। এই বিদেশি মহিলারা ভিজে মাটির দেশ থেকে, জলজঙ্গল থেকে, অস্বাস্থ্যকর দেশ থেকে এসেছে। এরা ডাইনি গায়িকাদের মতোই মনোমুগ্ধকর, বিশেষ মারাত্মক, অদ্ভুত রকমের হাস্যকর, আত্মা বিনাশকারিণী, ভয়ঙ্করী। প্রজাপতির মতো বিরাট বিরাট তাদের পাখা; ছোট ছোট পা, ছোট ছোট চোখ। কারণ এদেরও চোখ রয়েছে; এরা সেই চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকায়। এরা কি উড়তে পারে? এরা কি ডানায় ভর দিয়ে আমার কাছে আসবে?-না। আমার হৃদয়ই উড়ে যাবে তাদের কাছে।
এরা কত শঠ, কত রহস্যময়ী, আকাক্সক্ষার ওষ্ঠ-গোলাপ নির্যাসে সিক্ত করে। আমি তাদের বড়ো ভালোবাসি। মাঝে মাঝে কয়েকটি রাত তাদের ঘরে কাটানোর জন্যে আমার বড়ো ইচ্ছে হয়। আমি থেকেও যাই সেখানে কখনও কখনও। তাকে আমি গ্রাস করে ফেলি, তার সুবাস আমি প্রাণ ভরে গ্রহণ করি, তার নির্যাস পান করি আমি; অবর্ণনীয় আদর করে তার পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলি আমি।
এইসব টুকরো টুকরো অংশগুলি পড়া শেষ করে উকিল বললেন :
ভদ্র মহোদয়গণ, এই লজ্জাহীন আদর্শবাদী উন্মাদ, যেসব কৌতূহলোদ্দীপক স্বীকারোক্তি করেছেন তা থেকে আর বেশি কিছু আপনাদের অবগতির জন্যে বলাটা রুচির দিক থেকে গর্হিত হবে বলে মনে করছি আমি। যেটুকু আপনাদের সামনে আমি পড়লাম তা থেকেই মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষটিকে বুঝতে পারবেন আপনারা; আমাদের এই নৈতিক অবনতির যুগেও এই ধরনের আদর্শবাদী উন্মাদের সংখ্যা বড়ো কম।
এই উন্মাদ রোগগ্রস্ত স্বামীর ঘরে আমার মক্কেল যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছেন সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তিনি বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করেছেন। আমার বিশ্বাস এই বিশেষ পরিস্থিতিতে বিবাহবিচ্ছেদের পূর্ণ অধিকার তাঁর রয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ