নন্দিতার অন্য আকাশ
পর্ব-১
নাসির আহমেদ কাবুল ।।
বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। দশ মিনিট হাঁটলেই ক্লাসে পৌঁছতে পারে নন্দিতা। প্রতিদিনের চেয়ে আজ সে তিরিশ মিনিট আগে বাসা থেকে বের হয়েছে। হাতে প্রচুর সময় আছে ভেবে আস্তে-আস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এ সময়ে বন্ধুদের অনেকে গেটে থাকলেও আজ কাউকেই দেখতে পেল না নন্দিতা। গেটে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করে বার-বার ঘড়ি দেখে সে।
একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায় নন্দিতা। হয়ত কারো জন্যে অপেক্ষা করছে সে। লোকটি দেখতে বেশ। গায়ের রঙ কিছুটা তামাটে। ঘন কালো চুল মাথায়। পঁয়ত্রিশের উর্ধ্বে ভদ্রলোকের বয়স হবে—আন্দাজ করা যায়। পরনে প্যান্ট-শার্ট। পায়ে কালো রঙের জুতো। হাতে সিলভার কালারের ঘড়ি। রোদ লেগে চকচক করছে তার কপালের ঘাম। টিস্যুপেপার দিয়ে ঘাম মোছে সে। হঠাৎ চোখে চোখ পড়লে পায়ে-পায়ে নন্দিতার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটি। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। এতে নন্দিতা কিছুটা অবাক ও বিরক্ত হয়। আগ বাড়িয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবেন?
: আমি কি আপনার সঙ্গে দু-একটি কথা বলতে পারি?
: কথা বলছেন তো আপনি! কী কথা বলতে চান, সেটা বলুন।
: চলুন না, ওখানটায় গিয়ে বসি।
নন্দিতা অবাক হয়ে বলে, কী বলছেন আপনি! আপনার সঙ্গে লনে গিয়ে বসব কেন? আমি আপনাকে চিনি না, জানি না। হুট করে আপনার সঙ্গে লনে গিয়ে বসতে যাবো কেন?
নন্দিতার কথা শুনে ভদ্রলোক আমতা-আমতা করতে থাকে। বলে, নাÑমানে—এই আর-কি!
: আমি আপনাকে চিনি না, জানি না। তো হঠাৎ করে আপনার সঙ্গে লনে গিয়ে বসব, চা খাবো, আড্ডা দেবো। এমনটা তো হয় না। হতে পারে না।
: তা ঠিক। তবে আমি আপনাকে কিছুটা হলেও জানি।
: জানেন মানে? আপনি চেনেন আমাকে?
: চিনি না ঠিকই, তবে কিছুটা হলেও জানি।
অবাক হয় নন্দিতা। বলে, আমার সম্পর্কে কী জানেন আপনি?
এতক্ষণে লোকটি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বলল, আপনার আপা-দুলাভাই কিছু বলেননি আপনাকে?
: বলেছেন তো…
লোকটি হঠাৎ আগ্রহী হয়ে ওঠে—কী বলেছেন?
: বলেছেন ক্লাস শেষে যেন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাই। কেন বলুন তো?
: না ওসব নয়। আর কোনো কথা বলেননি?
: না তো!
হতাশ হয় লোকটি।
: ওঃ। সরি আপনাকে বিরক্ত করলাম।
লোকটি আর দাঁড়াল না। দ্রæত হাঁটতে লাগল বড় রাস্তার দিকে।
বান্ধবী চঞ্চলা কখন যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, নন্দিতা তা লক্ষ্য করেনি। চঞ্চলা নন্দিতার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে থাকে। বিরক্ত হয় নন্দিতা। নন্দিতা চঞ্চলাকে জিজ্ঞেস করে, কীরে হাসছিস কেন? কী এমন মজা পেলি যে অমন করে হাসতে হবে?
চঞ্চলা এবার বেশ জোরে হেসে উঠে বলে, মজা তো পাচ্ছিলামই। ডুবে-ডুবে জল খাচ্ছ, এতদিনেও তা জানতে পারলাম না!
: ডুবে-ডুবে জল খাওয়া মানে?
: কিছুই বুঝছিস না, না? কচি খুকি আর কি!
: দেখ চঞ্চলা, সব সময় তোর এই হেঁয়ালিপনা ভালো লাগে না আমার। যা বলার সরাসরি বল। একটু পরেই ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে।
: ক্লাস নেই আজ। ক্যানসেল হয়েছে, জানিস না?
: না। জানি না তো!
: আমিও জানতাম না। মিন্টুর কাছে শুনেছি। ভাবলাম তবুও ক্যাম্পাসে গিয়ে একটু আড্ডা দিয়ে আসি।
: তুই আড্ডা নিয়ে থাক। আমি চললাম।
পথ আগলে দাঁড়িয়ে চঞ্চলা বলে, যাবি মানে? বলে যাবি না?
: কী বলব?
: ওই যে ডুবে-ডুবে জল খাওয়া। তো হ্যান্ডসাম হিরোটি কে? কী করেন তিনি?
: আরে ধুৎ! কী শুরু করলি? হ্যান্ডসাম হিরো মানে! ওকে চিনি নাকি আমি?
: দেখ নন্দিতা, সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আমাকে ফাঁকি দিতে পারবি না। জানিস না, ইতিমধ্যে পাঁচ-পাঁচটি প্রেমপর্ব শেষ করেছি। ক্লাস এইটে শুরু। একটি টেনে, দুটি কলেজে, আর এখন পার্থর সঙ্গে। কি জানিস না তুই?
: এগুলোকে প্রেম বলে নাকি? নন্দিতা হাসে।
: বলেই তো। না বলার কী আছে?
: এই বয়সে পাঁচটি প্রেম! যা-তো, আমাকে যেতে দে।
: আরে শোন, পাঁচটা করব না তো কী করব? আমি তো আর বিয়ে করার জন্য প্রেম করি না।
: তাহলে?
: আমার প্রয়োজন মেটাতে ছেলে—মানে পুরুষ মানুষ দরকার। একজনের সঙ্গে একবার কিছু করলে তাকে আর ভাল্লাগে না। আমার কী দোষ, তুই-ই বল?
: প্রয়োজন মেটানো মানে?
: মানে ওই আর কি, শারীরিক প্রয়োজন। একজনকে একবার পেলে দ্বিতীয়বার আর ভালো লাগে না বলেই তো একটার পর একটা ধরছি আর ছাড়ছি। এসব কখনও করিসনি তুই?
: কী?
: ওই যে বিছানায়…
: ছিঃ! তোর মুখে আটকায় না কিছুই? কীসব নোংরা কথা বলছিস, তুই জানিস?
নন্দিতার কথায় চঞ্চলা খুব হাসে। হাসতে-হাসতে বলে, তুই তো মেয়ে মানুষই নোস। তোর এসব বোঝার কথাও নয়। বুঝবি, বিয়ে হোক। তারপর এক রাতও বরকে ছাড়া কাটাতে পারবি না। মিলিয়ে নিস আমার কথা।
চঞ্চলার কথায় নন্দিতা খুব বিরক্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করে। চঞ্চলা ওর পথ আগলে দাঁড়ায়।
: আচ্ছা, আর বলব না। চল এককাপ চা খেয়ে চলে যাই।
নন্দিতা না করে না। চায়ের দোকানে গিয়ে চা খায় ওরা দুজন। চঞ্চলা আবারও প্রশ্ন করে নন্দিতাকে, সত্যি করে বলত লোকটি কে?
: বলছি তো চিনি না!
: সত্যি চিনিস না? নাকি এড়িয়ে যেতে চাইছিস?
: এড়িয়ে যেতে চাইছি না। সত্যিই লোকটিকে চিনি না আমি। দেখিওনি কোনদিন।
: লোকটি যে তোর সঙ্গে কথা বলছিল!
: কথা বললেই কি চেনাজানা হয়?
: তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, কী বলছিল লোকটি?
: বলল, সে নাকি আমাকে না চিনলেও জানে। জিজ্ঞেস করল, আপা-দুলাভাই কিছু বলেছে কিনা। আমি না বলতেই চলে গেল।
: ওহ, তাই বল!
: কী?
: তুই আসলে একটা গবেট! লোকটিকে ভালো করে দেখা উচিত ছিল তোর।
: কেন?
: আরে বোকা তোর বিয়ের কথা হচ্ছে। দেখিস আপা-দুলাভাই তোকে এই কথাটিই বলবে। মিলিয়ে নিস।
: আরে ধ্যাৎ। বিয়ে করলে তো!
: অমন করে সবাই বলে। তারপর…
: তারপর কী?
চঞ্চলা হঠাৎ নন্দিতার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খায়। ক্যাম্পাসের অনেকগুলো চোখ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর আর নন্দিতা দাঁড়ায়নি। বাসার পথ ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে-হাঁটতে ভাবে, সত্যিই কি আপা-দুলাভাই তার বিয়ের কথা ভাবছে? কিন্তু সে তো পড়াশুনা শেষ না করে বিয়ে করবে না। নন্দিতা কি তাহলে সত্যিই বড় হয়ে গেছে! এখন তাকে বিয়ে করতে হবে, সংসার সামলাতে হবে, ছেলেমেয়ে বড় করতে হবে? কী অদ্ভুত নিয়ম সংসারের! বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে সাগর কী দোষ করেছিল? সাগর তো তাকে ভালোবাসত। আচ্ছা ভালোবাসা কি বিয়ে করার জন্যই? না হলে ভালোবেসে বিয়ে করার জন্য পাগল হয় কেন মানুষ? কেন একজন আরেকজনকে না পেয়ে গলায় ফাঁস দেয়, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। আবার অনেকে ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে যা ইচ্ছে তাই করে বসে! জীবন বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করে না! নন্দিতা এসবের কিছুই বোঝে না। নন্দিতা ভাবে, জীবনটা আসলেই জটিল—কিছুই বোঝা যায় না।
কলেজ জীবনে সাগর যখন নন্দিতাকে প্রচÐরকম ভালোবাসত, তখন তো সাগরকে পাত্তা দেয়নি নন্দিতা! কেউ তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে—এ কথা ভেবে খুব আনন্দ পেত সে। হাসিও পেত। মনে-মনে সাগরকে বলত, বোকা ছেলে!
আচ্ছা, প্রতিদিন কলেজ ছুটির পর নন্দিতার রিকশার পিছনে হেঁটে-হেঁটে দরজা পর্যন্ত এসে ফিরে যেত কেন সাগর? ওর বাসা তো অন্য পথে। ও কি তাহলে নন্দিতাকে বাসায় পৌঁছে দিতে আসতো? কী আনন্দ পেত ও? আজ এতদিন পর কেন সাগরকে মনে পড়ছে তার? তাহলে সে ভালোবাসা কী বুঝতে পারছে একটু-একটু করে? কী জানি! এসব ভাবতে চায় না নন্দিতা। এ মুহূর্তে এসব ভাবনা থেকে দূরে থাকতে চাইছে সে, কিন্তু পারছে না কিছুতেই।
মনে পড়ে একবার নন্দিতার জন্মদিনে রাত বারোটায় দরজার সামনে গোলাপ ও নিজের হাতে বানানো বার্থডে কার্ড রেখে বেল বাজিয়ে চলে গিয়েছিল সাগর। নন্দিতার মা পরের দিন পাড়ার একটি ছেলেকে সন্দেহ করে কী কাÐটাই না ঘটিয়েছিলেন!
নন্দিতার ক্লাসের বন্ধুরা মিলে সারপ্রাইজ বার্থডে পালন করেছিল পরদিন ক্লাসে। ওরা কেক কেটে, ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে সেদিন খুব আনন্দ দিয়েছিল নন্দিতাকে। ওই অনুষ্ঠানে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে উপস্থিত থাকলেও একমাত্র সাগর ছিল না। একদিন রাস্তায় একা পেয়ে নন্দিতা সাগরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই যে মশাই—এতো ভাব দেখাচ্ছ কেন?’
: কী ভাব দেখালাম?
: বার্থডের অনুষ্ঠানে সবাই ছিল, তুমি কেন থাকলে না?
সাগর কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলেছিল, ‘ভালোবাসার মানুষকে তার স্পেশাল দিনে অন্যদের সঙ্গে ক্লোজ হতে দেখলে কষ্ট হয়। তাই হয়ত দূরে থাকাটাই ঠিক মনে করেছিলাম।’
সাগরের কথা প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারেনি নন্দিতা। পরে বুঝতে পেরেছিল, ক্লাসের ছেলেবন্ধুদের কাউকে নন্দিতার ঘনিষ্ট হতে দেখলে ওর খারাপ লাগত। নন্দিতা ভাবে, ভালোবাসা তাহলে হিংসেরও জন্ম দেয়! কী বিচিত্র এই ভালোবাসা! ভালোবাসার এসব রসায়ন নন্দিতা বুঝতে পারে না, বুঝতে চায়ও না।
এরপর আর সাগর দাঁড়ায়নি। নন্দিতাকে অবাক করে দিয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল সে। যাবার সময় একবার কি দুবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। নন্দিতা সেটা দেখেছে এবং মনে-মনে হেসেছে এসব ওর পাগলামী মনে করে।
আজ এতদিন পর এসব ভাবতে কষ্ট হয় নন্দিতার। সাগরের সঙ্গে সবচেয়ে মন খারাপ করা বিষয়টি হয়েছিল কলেজের একটি অনুষ্ঠানের ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি মনে হলে আজও খারাপ লাগে নন্দিতার।
নন্দিতাকে আজ ভাবনায় পেয়ে বসেছে। হাঁটতে-হাঁটতে বাসার খুব কাছাকাছি চলে এলেও বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিল না তার। উল্টোপথে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হাঁটতে থাকে সে।
কলেজে স্পোর্টসের দিন সাগর ছবি তুলেছিল সবার। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ওর ফোকাসটা নন্দিতার দিকেই বেশি পড়েছিল। এ নিয়ে বান্ধবীরা টিচারের কাছে অভিযোগ করার কথা বললে প্রথমটায় রাজি হয়নি নন্দিতা। কারণ সে জানে, সাগর শুধু তার ছবিই তোলেনি, ওখানে যারা ছিলো, সবার ছবি তুলেছে সে। এক পর্যায়ে বন্ধুরা নন্দিতাকে বলে, ‘আমরা বুঝি কেউ না! ও-ই তোর কাছে আপন হয়ে গেলো?’ শেষ পর্যন্ত মন সায় না দিলেও গা-বাঁচাতে নন্দিতা সাগরের নামে কমপ্লেইন করতে গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। তবে নিজের মুখে কিছু বলেনি সে।
পরের দিন ক্লাসে স্যার শাস্তি দিয়েছিলেন সাগরকে! কিন্তু ও কিছুতেই স্বীকার করেনি যে, শুধু নন্দিতার ছবি তুলেছে সে। সে বার-বার জোর দিয়ে বলেছে, প্রোগ্রামের ছবিই তুলেছে সে। তারপর থেকে সাগর আর কোনদিন ক্লাস শেষে নন্দিতার পিছু নেয়নি। সেই থেকে সাগর অন্যরকম হয়ে যায়। এরপর বার-বার সাগরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে নন্দিতা, কিন্তু সাগর জেন্টলি এড়িয়ে গেছে তাকে।
কলেজ জীবন শেষ হলে সাগর কুয়েটে ভর্তি হয়েছিল—এটুকুই জানে নন্দিতা। আজ এতদিন পর কেন যে বার-বার সাগরের কথা মনে পড়ছে তার, ভেবে পায় না নন্দিতা।
নন্দিতা বুঝতে পারে, দেরিতে হলেও সাগর তার মনে কোথাও না কোথাও আসন পেতে বসে আছে। কী জানি হয়ত এরই নাম ভালোবাসা! আজও নন্দিতা তা বুঝতে চায় না বলে নিজেকে শাসন করে। তবে সাগরকে অমন করে ফিরিয়ে দিয়েছে বলেও কষ্ট হয় তার। সাগরের কথা মাঝে-মধ্যে মনে পড়লে বুকের মধ্যে কেমন খচ খচ করেÑতখন অস্থির হয় নন্দিতা। ভাবে এটাই কি তবে ভালোবাসা?
চলবে
0 মন্তব্যসমূহ