প্রকৃতি আজ খুব শান্ত-ধীর-স্থির। কোথাও কোনো কোলাহল নেই এতটুকু। আকাশে কোথাও-কোথাও খণ্ড-খণ্ড মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘের ফাঁক থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ছে বন-বনান্তে। প্রকৃতিতে আজ রৌদ্র-ছায়ার অপরূপ খেলা। গাছের পাতায় সূর্যের কিরণ পড়ে চকচক করছে। আবার মেঘ সূর্যকে আড়াল করলে কেমন একটা বিষণ্ণতা পেয়ে বসছে গাছগুলোকে। এমন শান্ত-ধীর পরিবেশেও নন্দিতার মন একেবারেই অশান্ত আজ। আজ নন্দিতার মন খারাপের দিন। একটুও মন ভালো নেই আজ তার।
সাগরের কথা ভাবতে-ভাবতে কেমন অবসাদ নেমে আসছে মনে। নন্দিতা ভুলতে চায় এসব পুরনো কথা। মনকে আর ভারাক্রান্ত করতে চায় না কোনকিছুতেই। মনে পড়ে রবি ঠাকুরের গানÑ‘যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর…’। নন্দিতা মুহূর্তে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয় সাগরকে। কিন্তু একি! সাগরের জায়গায় অপরিচিত ওই লোকটার মুখ কেন চলে আসছে বার-বার! কেন অস্থির করে তুলছে তাকে! কেনই-বা এসেছিল, আবার হঠাৎ করে কেনই-বা চলে গেল সে!
ক্লাস না থাকলেও এতটা সময় বাইরে কাটিয়ে দেওয়ার কারণ নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে আপা। মাও বলবেন এটাসেটা। নন্দিতা ভেবে পায় না, বড় হলে মায়েরা কেন এমন পর হয়ে যায়! বাবা থাকলে তিনিও কি মায়ের মতো হয়ে যেতেন?
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে নন্দিতা। বাবাকে নিয়ে একটি সুখস্মৃতি প্রায়ই তার মনে পড়ে। তখন সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ঈদের কেনাকাটা করার জন্য নন্দিতা বাবা-মায়ের সঙ্গে শপিংয়ে যায়। পুরো মার্কেট ঘুরে কিছুই পছন্দ হয় না তার। শেষে মা বললেন, আমি আর পারছি না। তোমরা বাপ-বেটি যাও। আমি এখানে বসছি।
মাকে না নিয়ে বাবার সঙ্গে আবারও পছন্দের পোশাক কেনার জন্য ঘুরতে থাকে নন্দিতা। এতক্ষণে একটা নীল রঙের ড্রেস তার খুব পছন্দ হলো। এবার মাকে দেখাতে হবে। কিন্তু মা দেখে সেলসম্যানকে বললেন, এটার আর কোনো কালার নেই?
নন্দিতা আপত্তি করল—অন্য কোন কালার কেন মা? এটাই আমার পছন্দ। তাছাড়া বাবাও তো এটা পছন্দ করেছেন।
মা শুনলেন না নন্দিতার কথা। তিনি কফি কালারের একটি ড্রেস কিনলেন। বাসায় এসে নন্দিতার মন খুব খারাপ। বাবা চুপি-চুপি বললেন, ‘মন খারাপ করিস না, আমি আছি তো!’
পরদিন বাবা চেঞ্জ করে নন্দিতার পছন্দের নীল কালারের ড্রেসটিই নিয়ে এসেছিলেন। মা দেখে তো রেগে আগুন। কথা বলা বন্ধ করে দিলেন সবার সঙ্গে। রাতে খাবার টেবিলেও আসছেন না দেখে বাবা নন্দিতাকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে মায়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন। অথচ ওপাশে বেডরুমে মা রাগ করে শুয়ে আছেন। টিভিও দেখছেন না আজ। বাবা মাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে লাগলেন, তোর মা-ই কিন্তু ঠিক ছিল। নীল রঙটা আনা ঠিক হয়নি। কফি কালারটাই তোকে সুন্দর মানাতো।
বাবার কথা শুনে মা উঠে এসে খাবার প্লেট দিলেন। ভাত বেড়ে দিতে-দিতে মা বললেন, তোমাদের বাপ-বেটির যা পছন্দ, তা তো আমি জানিই। একদম বাজে তোমাদের চয়েস। তাই তো আমি কফি কালারটাই ওর জন্য নিয়েছিলাম। ঠিক আছে। আমি তো পরব না। আমার কী যায়-আসে!
মায়ের অভিমানের কথা শেষ হতেই বাবা বললেন, ভুলই করলাম রে! ওই কফি কালারের ড্রেসটা রেখে দিলে তোর মা পরতে পারত। মানাতো বেশ।
কথা বলতে বলতে বাবা নন্দিতার দিকে তাকিয়ে তখন মিটিমিটি হাসছিলেন। বাবার কথা শুনে মা তখন আর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। হেসে ফেললেন তিনি। আজ বাবা নেই। আজ তার সমস্যার কথা শোনারও কেউ নেই। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল নন্দিতার।
নন্দিতা এখন দাঁড়িয়ে আছে ঘর থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে একটি গাছের নিচে। বাবলা গাছ। ঘন পাতা। পাতার ফাঁকে-ফাঁকে ছোটো-ছোটো পাখির উচ্ছ¡াস। এই প্রকৃতিতে ওদেরও ভূমিকা আছে তাহলে! নন্দিতার কোনো কিছু করার নেই কেন? কোনো ভূমিকা নেই কেন তার? আপা-দুলাভাইয়ের সংসারে রান্নাঘরে মাকে, বোনকে সাহায্য আর লেখাপড়া করা, গান শোনা ছাড়া কি কোনো দায়িত্ব নেই তার? না, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাকে। সমাজের জন্য তাকেও কিছু করতে হবে। যে পথশিশুটির জন্য সে বাদাম কিনে দেয়, যে পথশিশুদের কষ্টে তার বুক কাঁপে, তাদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে মনে। কিন্তু কীভাবে? নন্দিতা ভাবে—তাকে মফস্বল শহরে পড়ে থাকলে চলবে না। ঢাকায় যেতে হবে। সেখানে বেশ কিছু এনজিও আছে, যারা পথশিশু ও নারীদের নিয়ে কাজ করে। নন্দিতা ঢাকায় গিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দেবে। তার আগে লেখাপড়াটা শেষ করতে হবে তাকে। তাছাড়া লেখাপড়া শেষ না করে বিয়েও করবে না সে।
হঠাৎ সেল ফোন বেজে ওঠে নন্দিতার। দুলাভাইয়ের ফোন। ফোন রিসিভ করে নন্দিতা।
Ñ নন্দিতা, তোমার ক্লাস শেষ হয়েছে? তুমি কি ফ্রি আছ এখন?
Ñ কেন দুলাভাই?
Ñ একটু আসতে পারবে? আমি নন্দা রেস্টুরেন্টের সামনে অপেক্ষা করছি। তোমার আপার জন্য একটা শাড়ি কিনব। তুমি পছন্দ করে দেবে?
ক্লাস হয়নি কথাটা চেপে গেল নন্দিতা। বলল, জি। এখনই আসছি দুলাভাই।
নন্দা রেস্টুরেন্টে নন্দিতার পৌঁছতে সময় লাগেনি। রেস্টুরেন্টের সামনেই দুলাভাই দাঁড়িয়ে আছেন। দুলাভাইয়ের সঙ্গে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দেখা লোকটাকে দেখে বুকটা কেঁপে ওঠল নন্দিতার। চঞ্চলার কথা মনে পড়ল তার। সত্যিই কি এই লোকটা…। নন্দিতার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে।
দুলাভাই লোকটিকে তার বন্ধুর ছোটভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে-ঢুকতে বললেন, এসো কিছু খেয়ে নাও।
দুলাভাইকে ফলো করে রেস্টুরেন্টে ঢুকল নন্দিতা। সঙ্গে লোকটিও। রেস্টুরেন্টটি বড়। ছিমছামÑগোছানো। তিনজন একটা কেবিনে গিয়ে বসল। নন্দিতা ও দুলাভাই একপাশে। লোকটি সামনাসামনি। লোকটি বার-বার নন্দিতার দিকে তাকাচ্ছিল বলে নন্দিতার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। নন্দিতার মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ করে দুলাভাই বললেন, কী হয়েছে তোমার? অমন উসখুস করছ কেন?
নন্দিতা কোনো উত্তর দেয় না। বেয়ারা কিছু একটা দিয়ে গেলেও তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার।
Ñকী হলো, খাচ্ছ না কেন? দুলাভাই তাড়া দিলেন।
নন্দিতা বলল, এসব খাবো না। শুধু এক কাপ চা দিতে বলুন।
দুলাভাই জোর করলেন না। চায়ের অর্ডার দিয়ে বললেন, তোমরা একটু বসো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
কিছু না খেয়েই বের হয়ে গেলেন দুলাভাই।
নন্দিতা ঘামছে। মনে হচ্ছে ছুটে পালাতে পারলে বেঁচে যায় সে।
Ñ আপনি ঘামছেন কেন? কী হয়েছে আপনার? লোকটি প্রশ্ন করলো।
Ñ কই, ঘামছি না তো!
Ñ ও আচ্ছা!
লোকটা হাসতে লাগল। নন্দিতা আরো ঘামতে লাগল।
লোকটি বলল, এবার কোন ইয়ারে আপনি?
Ñ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ।
Ñ সাবজেক্ট?
Ñ ইংরেজি।
Ñ লিটারেচার, চমৎকার! পাস করে কী করতে চান, চাকরি?
Ñ আগে তো পাস করি। তারপর ভাববো।
Ñ নিশ্চয়ই-নিশ্চয়ই।
Ñ গান শুনতে পছন্দ করেন?
Ñ কেন জিজ্ঞেস করছেন বলুন তো?
Ñ না এমনিই। জাস্ট কৌতূহল।
Ñ হুঁ। শুনি।
Ñ কী গান বেশি পছন্দ?
Ñ রবীন্দ্রনাথের গান। আধুনিকও।
Ñ আমি এতগুলো প্রশ্ন করলাম। আপনার কোনো প্রশ্ন নেই?
লোকটিকে আড়ালে-আবডালে কয়েক নজর দেখে নিল নন্দিতা। একবার চোখাচুখি হলে লজ্জায় লাল হলো, মুখ ফ্যাকাশে হলো তার। টেবিলে পানির বোতল থেকে পানি খেলো নন্দিতা।
Ñ রান্না করতে জানেন?
Ñ না।
নন্দিতা কিছুটা মিথ্যে বলল।
Ñ বাঙালি নারী, রান্না করতে জানা দরকার না?
লোকটি হাসতে লাগল।
Ñ যখন দরকার, তখন শিখে নেব।
Ñ ও আচ্ছা। অন্তত একটা প্রশ্ন করুন আমাকে। আমিই তো আপনাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি।
লোকটি হ্যান্ডসাম। ভদ্র। মার্জিত। বয়সে একটু বেশি মনে হলো। বাঙালি পুরুষরা সাধারণত এর চেয়ে কম বয়সে বিয়ে করে ফেলে। তবে তাকে অপছন্দ করার কিছু নেই। নন্দিতা ভাবল, আপা-দুলাভাই যদি এই লোকটির সঙ্গেই তার সম্পর্ক করতে চান, অন্তত কিছু তো জানা দরকার। নন্দিতা জিজ্ঞেস করল, কী করেন আপনি?
Ñ কলেজে পড়াই। লেকচারার। চমৎকার প্রশ্ন।
Ñ চমৎকার প্রশ্ন কেন?
Ñ পুরুষের সত্যিকার আইডেনটিটি তো তার কাজের মধ্যেই। তাই আপনার জানার আগ্রহটি চমৎকার।
নন্দিতা হাসলো। এই ফাঁকে আরও একনজর দেখে নিলো লোকটিকে। এর মধ্যে দুলাভাই ফিরে এলেন। বললেন, ‘চলো যাই।’ যেন তিনি কিছুই জানেন না। এসবের কোনো কিছুই যেন তার পরিকল্পনায় মধ্যে ছিল নাÑএমন ভাব দেখালেন তিনি।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল লোকটি। দুলাভাই বললেন, আজ দেরি হয়ে গেল। চলো বাসায় যাই। শাড়ি না হয় অন্য একদিন এসে কিনব। তোমার আপা পছন্দ না করলে তখন আবার পাল্টানোর ঝামেলা পোহাতে হবে!
নন্দিতা বলল, চলুন। মনে-মনে বলল, বোকা দুলাভাই আমার!
বাসায় ফেরার পথে দুলাভাই ক্লাস-লেখাপড়া নিয়ে স্বাভাবিক প্রশ্ন করলেন। বাসায় ফিরে কারও মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করল না নন্দিতা। তবে অবাক হয়েছে এই ভেবে যে, আজই প্রথম নন্দিতা ক্লাস শেষে দুলাভাইয়ের সঙ্গে বাসায় ফিরল—দুলাভাইও ব্যাংকের জব শেষে এত সকালে বাসায় ফিরে এলেন, অথচ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না! এই অস্বাভাবিকতা দেখে নন্দিতার বুঝতে বাকি রইলো না যে, চঞ্চলার কথাই ঠিক।
তিন-চারদিন কেটে গেল এভাবেই। একদিন সন্ধ্যায় দুলাভাই ড্রইংরুমে সবাইকে ডাকলেন। নন্দিতাকে অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি খাতির করে বললেন, ‘ছোটো গিন্নি, তুমি আমার পাশে এসো বসো।’ দুলাভাইয়ের পাশে গিয়ে বসতেই বললেন, তোমার সঙ্গে যে ছেলেটির রেস্টুরেন্টে দেখা, ওর আপা-দুলাভাই কাল সকালে আমাদের বাসায় তোমাকে দেখতে আসবে।
দুলাভাইয়ের কথা শুনে নন্দিতা হিমশীতল হয়ে যাচ্ছিল। কোন কথা বলতে পারছিল না সে।
নন্দিতার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে আপা বলল, দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না! নন্দিতারও তো একটা পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে। নন্দিতা পছন্দ করলে বিয়ে হবে, না করলে হবে না।
নন্দিতা কিছু বলল না। মাথা নিচু করে বসে রইল।
মা বললেন, এতে মন খারাপের কী হলো? বিয়ে দেবো না কি সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রাখব! যত্তসব!
মায়ের কথা পছন্দ হয়নি নন্দিতার। সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয় নন্দিতা। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে।
নন্দিতা জানে না, কেন সে কাঁদছে! কী হয়েছে তার। এই বয়সেই তো মেয়েদের বিয়ে হয়। তারও হবে। এটাই তো স্বাভাবিক। নন্দিতার বেশ কয়েকজন বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে। তারা তো কেউ কেঁদেছে বলে শোনেনি নন্দিতা। তাহলে সে কাঁদছে কেন! সাগরই কি তাহলে ওর বাধা? তাও-বা কেন হবে, সেই তো সাগরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। নন্দিতা এসব ভাবতে পারে না। ভাবতে চায়ও না। যা হোক হবে বলে নিজেকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে সে।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। এক কাপ চা না খেলে মাথা ধরে নন্দিতার। অথচ সারাটি বিকেল চলে গেল একাকী ঘরের মধ্যে, একবারও কেউ তার খোঁজ নিলো না! কেউ এসে বলল না, দরজা খোল নন্দিতা, তোর তো চা না খেলে আবার মাথা ধরে। আয় সবাই মিলে চা খাই। এমন কি মাও এলেন না! তাহলে কি নন্দিতার প্রতি মায়ের ভালোবাসাও কমে গেছে? অথচ নন্দিতা একদিন হারিয়ে গেলে মা সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন। বুক চাপড়ে কেঁদেছিলেন মা। সেই ছোটবেলার কথা—তখন নন্দিতার বয়স সাত কি আট বছর। মামা একটা ফিশিং গেম কিনে দিয়েছিলেন নন্দিতাকে। একটি জারে অনেকগুলো মাছ মুখ হাঁ করে থাকে। তিনটি ছিপ দিয়ে তিনজনে খেলতে হয়। ওই জারে বড়শি ফেলে হাঁ-করা মাছগুলো বড়শির মধ্যে গেঁথে উঠাতে হবে। যে বেশি মাছ উঠাতে পারবে, সে-ই জয়ী হবে।
বন্ধুদের নিয়ে নন্দিতা এই ফিশিং গেমটা খেলত। ওরা নন্দিতার চেয়ে বয়সে বড় বলে নন্দিতা বার-বার হেরে যায়। এ জন্য নন্দিতাকে ‘হেরো-হেরো’ বলে খ্যাপায় ওরা। এ কারণে নন্দিতা আর ওদের সঙ্গে খেলতে চাইত না। তাই একা-একা খেলার সিদ্ধান্ত নেয় নন্দিতা। কিন্তু একা খেলতে গেলে ওরা দুজন ওকে খুঁজে বের করে খ্যাপাতে থাকে। এ জন্য নন্দিতা একদিন স্টোররুমে গিয়ে খেলতে থাকে। খেলতে-খেলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে সেখানেই।
এদিকে দুপুর গড়িয়ে যায়। কেউ কোথাও নন্দিতাকে খুঁজে পায় না। বাবা ছিলেন দূরে। তিনি খবর পেয়ে ছুটে আসেন। মা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। পরে অবশ্য ওর এক খালা স্টোররুমে খুঁজে পেয়েছিলেন নন্দিতাকে।
নন্দিতার আজ খুব বেশি একা-একা লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ নেই তার পাশে। চারদিকে শুধুই শূন্যতা গ্রাস করছে তাকে! খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল নন্দিতার। অনেক্ষণ কাঁদল সে। তারপর সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে গিয়ে ওর প্রিয় রকিং চেয়ারটায় বসল। নন্দিতার মন খারাপ হলেই এই রকিং চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে একা-একা কথা বলে, গান গায়।
প্রতিদিনের মতো নয়, আজকের সন্ধ্যাটা নন্দিতার জন্য স্পেশাল কী যেন বার্তা নিয়ে এসেছে। আকাশ ভরা তারা, দূরে পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে যাচ্ছে। বাতাস বইছে বেশ ধীরে। নন্দিতা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। তারপর সেই ছোট্টবেলায় ফিরে যায় আবার। মনে পড়ে খেলার সাথীদের কথা। মনে পড়ে বাবার কথা। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন, কত কথা বলার ছিল নন্দিতার! যে কথাগুলো মা বা অন্য কাউকে বলা যায় না। আচ্ছা, যে লোকটা ওর জীবনে আসতে যাচ্ছে, তাকে কি বলা যাবে মনের কথা? সে কি বুঝবে নন্দিতাকে? না কি আর পাঁচটা পুরুষের মতো স্বার্থপর হবে সে, নিজের ভালোটাই বুঝবে শুধু?
নন্দিতার দুটি ভাগ্নে-ভাগ্নি হঠাৎ ছাদে উঠে এসে বলল, ‘খালামণি, তুমি এখানে বসে আছ! আর আমরা তোমাকে খুঁজে মরছি!’
Ñ কেন, কী হয়েছে তোদের? এখন পড়ার সময়, খালামণিকে কী দরকার?
ওরা বলে, পড়া তো হয়ে গেছে। এখন তোমার সঙ্গে লুডু খেলব, চলো।
নন্দিতা ওদের কোন আবদার না রেখে পারে না। ভালোবাসার এমনি জোর, সবকিছু চাপিয়ে দিলেও মন খারাপ হয় না। নন্দিতা ওদের দুজনকে নিয়ে ছাদ থেকে নামে। তারপর লুডু খেলার মধ্যে হারিয়ে ফেলে একটু আগের সব বিষণœতা।
0 মন্তব্যসমূহ