কিছু বই গিলতে হয়…

নাসির আহমেদ কাবুল ।।
লেখক যা লেখেন তার শতগুণ পড়েন। না পড়ে কেউ লেখক হতে পারেন না। এর সারমর্ম লেখককে পড়তেই হবে। কিন্তু কী রকম সেই পড়া? সাধারণ পাঠকও পড়েন আবার লেখকও পড়েন। আদৌ এই দুইশ্রেণির পাঠকের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য আছে কি?

কোন কিছু বুঝতে হলে পড়তে হবে। কিন্তু সেই পড়া কী রকম হওয়া উচিত। এ সম্পর্কে মর্টিমার এডলার ১৯৪০ সালে তার লেখা একটি বইয়ে চার ধরনের পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে ১. প্রাথমিক ২. পরীক্ষামূলক ৩. বিশ্লেষাত্মক ৪. তুলনামূলক পড়া।

প্রাথমিক পাঠক হচ্ছে জীবনে প্রথম যখন আমরা পড়া শিখেছিলাম। অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা যে পাঠ শিখেছিলাম, সেটাই প্রাথমিক পাঠ হিসাবে গণ্য হতে পারে।

পরীক্ষামূলক পড়া হচ্ছে ভাসা ভাসা পাঠ। কোন কিছু বিশেষভাবে মনে না রাখা বা নোট না করা। এই পড়ার মাধ্যমে লেখকের চিন্তার উপকরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া বোঝায়। এই পড়া থেকে একজন পাঠক বুঝতে পারেন বইটি আবারও তাকে পড়তে হবে কিনা বা কিছু মনে রাখতে হবে কিনা। অনেক ক্ষেত্রে এটি রস আস্বাদনের জন্যেও হতে পারে।

বিশ্লেষণাত্মক পাঠক হচ্ছে পুরো লেখাটির বিশ্লেষণ করা। একজন পাঠক তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটিকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পান। বিশ্লেষণাত্মক পড়া হচ্ছে খাওয়া ও হজম করা। ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, কিছু বই গিলতে হয় আর কিছু বই চিবিয়ে হজম করতে হয়। এই হজম করাই হচ্ছে বিশ্লেষণাত্মক পড়া। পরীক্ষামূলক পাঠ হয় দ্রুত কিন্তু বিশ্লেষণাত্মক পড়া হচ্ছে ধীরে-ধীরে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়া। একজন পাঠকের তাড়াহুড়ো না করে সময় নিয়ে আত্মস্থ করে পড়াকেই বিশ্লেষণাত্মক পড়া বলে।

এরপর আসে তুলনামূলক পড়া। এই পড়ার ধাপটি সবচেয়ে কঠিন। একই বিষয়ের উপর বিভিন্ন বইয়ে তুলনামূলক পড়া বোঝায়। এতে একজন পাঠক কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখার তুলনা করতে পারেন এবং নিজে কোন কোনটির সঙ্গে একমত হতে পারেন অথবা নাও হতে পারেন। পড়ার এই শেষ ধাপটি থেকেই একজন পাঠক সত্যিকার পাঠক হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ কোন কিছু পড়ার মধ্যে তার আর কোন বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলো না বা অজানা রইলো না।
একজন সাধারণ পাঠক প্রথমত কোন কিছুর রস আস্বাদনের জন্য পড়েন। তার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে রস আস্বাদন করা। রস আস্বাদনের জন্য সাধারণ পাঠকের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ থাকে। কোনো কোনো পাঠক কবিতা পড়তে ভালোবাসতে পারেন। কোনো কোনো পাঠক উপন্যাস বা গল্প ভালোবেসে পড়েন। আবার কোন কোনো পাঠক জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে পড়তে পছন্দ করেন। কেউ কেউ আবার ইতিহাস নির্ভর লেখা পড়তে ভালোবাসতে পারেন। তাই কোন বিষয়ে রস পাওয়া যাবে, সে বিষয়টি একজন সাধারণ পাঠকের কাছে মুখ্য বিষয়। কিন্তু লেখক পাঠকের কাছে এটি মুখ্য নয়।

একজন লেখক পাঠক মূলত শুধুই রস আস্বাদের জন্যে পড়েন না। শুধু রস আস্বাদের জন্য তাই তার নিজস্ব কোন পছন্দও থাকে না। তিনি যে ধরনের লেখা লিখছেন সে বিষয়টিই তার পছন্দের তালিকায় সবার আগে স্থান পায়। যেমন একজন কবি কবিতা পড়তেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হবেন, তবে এটাই প্রথম কথা বা একমাত্র কথা যদিও নয়। আবার যে লেখক গল্প বা উপন্যাস পড়েন তিনি গল্প বা উপন্যাসকেই পছন্দের তালিকায় প্রথমে স্থান দেবেন এটাই স্বাভাবিক।

সাধারণ পাঠককে সব সময় লেখার গভীরে প্রবেশ না করলেও চলে। এ কারণে তিনি দ্রুতপঠন পদ্ধতিকে অনুসরণ করেন। দ্রত পঠন হচ্ছে শব্দগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে যাওয়া। কিন্তু লেখকের জন্য দ্রুতপঠন সমীচীন নয়।

শেষে এ কথা বলা যায় যে, একজন সাধারণ পাঠকের পড়া হয় পরীক্ষামূলক কিন্তু একজন লেখক পাঠকের লেখা হয় পরীক্ষামূলক, বিশ্লেষাত্মক ও তুলনামূলক পড়া।

মন্তব্য করুন