অলোক আচার্য ।।
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’- বই নিয়ে চিরায়ত সত্য এ উপলদ্ধি করেছেন ১৯৫০-৬০ এর দশকের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, রম্যরচয়িতা এবং বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের অগ্রদূত বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। পাশাপাশি অনুবাদেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। সৈয়দ মুজতবা আলীর বর্ণনার সাবলীল ভঙ্গি এবং রসাত্মক উপস্থাপনা গদ্যের মধ্যেও পাঠকের অন্তরতৃপ্তি করতে সক্ষম হয়েছে। তার বর্ণনার ধারা এতটা সাবলীল এবং সুখপাঠ্য যে, পাঠক সহজেই তা হৃদয়ঙ্গম করে নেয়।
মুজতবা আলীর ভ্রমণকাহিনিগুলো এমনভাবে রচিত হয়েছে যে, সেসব পড়ার সময় এক ধরনের গল্পের অনুভূতি জন্মে। বিশেষ করে লেখকের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভ্রমণকাহিনীসমূহের বর্ণনায় সেই স্থান সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ জন্মে। বহুমাত্রিক এ সাহিত্যিকের সাথে পরিচয় ঘটে পাঠ্যবইয়ে পঠিত জনপ্রিয় ছোটগল্প ’রসগোল্লা পাঠের মাধ্যমে। বস’ রসগোল্লার চেয়ে কোনো অংশেই কম রস ছিল না সেই গল্পে। ’রসগোল্লা’ গল্পের পুরো অংশ জুড়েই কেবল রসগোল্লা। বাঙালি এমনিতেই রসগোল্লা প্রিয়। গল্পটি রসগোল্লার রসের স্বাদ আরও বেশি মনে করিয়ে দেয়। গল্পের অন্যতম চরিত্র ’ঝান্ডুদা ও চুঙ্গিওয়ালা। যেখানে নাছোড়বান্দা চুঙ্গিওয়ালা ঝান্ডুদার সাথে বহন করা টিনের মিষ্টির প্যাকেট যে কোনো মূল্যে কাটতে চান। অপরদিকে ঝান্ডুদা যতই বোঝাতে চান যে টিন কাটলে ভেতরের মিষ্টি নষ্ট হতে পারে তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না। শেষমেশ এই গল্পের পরিণতি হয় রসগোল্লা খেয়েই। সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার বদলির চাকরির সুবাদে প্রাথমিক পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেন। এরপর ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তিনি ’বিশ্বভারতী এর প্রথম দিকের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি বহু ভাষায় পান্দিত্ত অর্জন করেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
তার শিক্ষা জীবন এবং চাকরির সুবাদেই তিনি বহু স্থানে ভ্রমণ করেন। সেসব কাহিনীই পরবর্তীতে গ্রন্থ আকারে, গল্প এবং রম্য বর্ণনায় পাঠকের সাহিত্য সুধা পূরণ করেছেন। তিনি কয়েকটি ছদ্মনামে লিখতেন। তিনি সত্যপীর,ওমর খৈয়াম,টেকচাঁদ রায়পিথোরা,প্রিয়দর্শী ইত্যাদি ছদ্মনামে লিখেছেন বলে জানা যায়। লিখেছেন সত্যযুগ, বসুমতি,শনিবারের চিঠি,কালান্তর,মোহাম্মদীসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। তার ভ্রমণকাহিনীগুলোতে ভ্রমণ স্থানের, মানুষের বর্ণনা এত চমৎকারভাবে পাওয়া যায় যে জানার আগ্রহ আরও বৃদ্ধি করে। সৈয়দ মুজতবা আলী ও ইংরেজি ও ফারসী ভাষার শিক্ষক হিসাবে পাকিস্থানের কাবুলে একটি শিক্ষাদপ্তরে তিন বছর অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি ’ All Indian council for cultural relations’’ এর সচিব All india Radio এর কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে বিশ্বভারতীতে ইসলামিক ইতিহাস বিভাগে রিডার হিসাবে যুক্ত হন এবং ১৯৬৫ সালের দিকে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। ১৯৪৯ সালে দেশে বিদেশে গ্রন্থের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে আগমন ঘটে। তার আফগানিস্থানের স্মৃতি নিয়ে গ্রন্থটি রচিত। এই গ্রন্থে তার আফগানিস্থানের ভ্রমণ স্মৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই ভ্রমণকাহিনিটি গদ্য তবে ভেতরে রম্য রসে লিখিত এক অসাধারণ গদ্য। সৈয়দ মুজতবা আলীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে দেশে বিদেশে (১৯৪৯), জলে ডাঙায় (১৯৬০), পঞ্চতন্ত্র, ময়ূরকন্ঠী (১৯৫২), চাচাকাহিনী (১৯৫৯), ধূপছায়া,পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা,দ্বন্দ্বমধুর,চতুরঙ্গ,শ্রেষ্ঠগল্প,ভবঘুরে ও অন্যান্য,টুনিমেম,প্রেম,বড়বাবু,রাজা-উজির,হিটলার,কত না অশ্রুজল,মুশাফির ইত্যাদি। তার অবদানের জন্য তিনি ১৯৪৯ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নরসিংহ দাস পুরস্কার, ১৯৬১ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এ লেখক ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
আজ আগামী ডেস্ক/অআ/৭-৩০