আমার ভূত দেখা

এইচ জি ওয়েলস ।।

ক্লেটন হঠাৎ বলল, গত রাতটা আমি ক্লাবে কাটিয়েছি। আর আমি সে সময় একটি ভূতকে আটক করেছি। বন্ধুরা সকলে কৌতূহলী হয়ে উঠে ভূতের কথা শুনে। সকলে ঘিরে ধরে ক্লেটনকে। অনুরোধ জানায় ব্যাপারটা খুলে বলতে।
কেউ-কেউ পরিহাস করে ব্যাপারটা নিয়ে। সব ব্যাপারটাই যে ডাহা মিথ্যে সে কথা বলতেও কেউ ছাড়েনি।
কিন্তু তাদের কথা গায়ে মাখে না ক্লেটন। সে স্পষ্টভাবে বলে, আমি ভূত-টুত বিশ্বাস করতাম না, আপনারা সকলেই বেশ ভালো করেই জানেন। কাজেই ব্যাপারটা বেশ ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্লাবের সদস্যরা ক্লেটনকে অনুরোধ করে বলে, অযথা ভূমিকা না বাড়িয়ে আসল ব্যাপারটা খুলে বলুন।
ক্লেটন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, নিশ্চয়ই বলব। ভূতের সঙ্গে যখন আমার দেখা হলো তখন বেচারার খুব শোচনীয় অবস্থা। আমার জানা ছিল না যে, ভূতও কাঁদতে পারে!
একটা চুরুট ধরিয়ে বেশ আয়েশ করে বসে ক্লেটন। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল প্রথম থেকেই। চুরুটে সে বড়ো-বড়ো কয়েকটা টান দেয় এবং ধীরে-ধীরে বলে, আমরা সাধারণত যেসব ভূতের কথা বলি, তারা একই জায়গায় ঘুর-ঘুর করে সব সময়। ভয় দেখায় লোকদের। আমার দেখা ভূতটা কিন্তু সে ধরনের নয়। সে যেনো অন্য রকমের। কথা বলতে-বলতে ক্লেটন একবার চারদিকে তাকায়।
আবার বলতে শুরু করে ক্লেটন, ‘ভূতটাকে আমি প্রথম দেখতে পাই। কেননা, সে আমার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়েছিল। ওর দেহটা কী রকম যেন স্বচ্ছ ও সাদাটে। তাছাড়া ওর দেহটা ভেদ করে দূরের জানালার আলো আমি ভালো করে দেখতে পাই। আমার সুবিধে মনে হয় না ওর হাবভাব। মনে হয়, কিছু একটা করার তার ইচ্ছে। কিন্তু কী যে করবে, তা ভেবে পাচ্ছে না। কাঠের দেয়ালে এক হাত দিয়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। আর এক হাত মুখের কাছে নিয়ে নাড়াচ্ছে।
ক্লেটন একটু থামলে স্যান্ডারসন নামে এক সদস্য বলে, কী রকম ছিল ভূতের চেহারা?
ক্লেটন বলে, বেশ রোগাটে। লম্বা, বেঁটে। মাথায় কদমছাট চুল। স্বাভাবিক নয় কান দুটি। দেহের তুলনায় কাঁধ খুবই সরু। গায়ে ছিল কলার দেয়া রেডিমেড জ্যাকেট। পরনে ছিল হাঁটুছেঁড়া বেশ ঢোলা প্যান্ট।
প্রথমে নিঃশব্দে আমি দোতলায় উঠি। আমার পায়ে হালকা চটি ছিল। আমার হাতে কোনো আলো ছিল না। সিঁড়িতে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে আমি দেখতে পাই ওকে। দাঁড়িয়ে পড়ি। খুব ভালো করে ভূতটাকে লক্ষ্য করি। সে সময় আমি অবশ্য বিন্দুমাত্র ভয় পাইনি। বরঞ্চ আমার কৌতূহল বেড়ে যায়। মনে-মনে ভাবি, বিগত পঁচিশ বছর ধরে ভূতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এসেছি। বয়সকালে একে দেখার আমার সৌভাগ্য হলো!
আমাকে দেখতে পায় এক সময় ভূতটা। সঙ্গে-সঙ্গে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। এবার ভূতটাকে আরও ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাই। ভূতটাকে আমার অপরিণত বয়স্ক মনে হয়। নাক, মুখ ইত্যাদি বেশ সুন্দর নয়। সবে ওঠা খোঁচা-খোঁচা গোঁফ ঠোঁটের ওপরে।
ভূতটাও বেশ ধৈর্যসহকারে আমাকে দেখে। ভূতের করণীয় কর্তব্য ব্যাপারে সজাগ হয়। সে বেশ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নিয়ম অনুসারে মাথাটা সামনের দিকে এগোয়। লম্বা-লম্বা হাত দুটো দেহের দুপাশে ঝুলিয়ে রাখে। মুখটা খুলে মৃদু শব্দ করে। পায়ে-পায়ে আমার দিকে এগুতে থাকে।
আমি কিন্তু বিন্দুমাত্র ভয় পাইনি। আমি ভূতটাকে বেশ জোরে ধমক দিলাম। বললাম, বোকার মতো চিৎকার করো না। এটা তোমার জায়গা নয়। এখানে এসে শুধু-শুধু ঝামেলা করছ কেন?
আমার ধমকে ভূতটা কেমন যেনো জড়োসড়ো হলো। আগের মতো নাকি সুরে ওঁ-ওঁ বলে মৃদু চিৎকার করে ওঠে। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ওকে প্রশ্ন করি—তুমি যে এখানে এসেছ, তুমি এই ক্লাবের মেম্বার? মেম্বার ছাড়া এই ক্লাবে প্রবেশ করা অপরাধ।
এ ছাড়া আমি যে ভূতটাকে কেয়ার করি না, তা বোঝানোর জন্য ওর ছায়াসর্বস্ব দেহের একটা কোণের ভেতর দিয়ে দোতলার বারান্দায় যাই। মোমবাতি জ্বালাবার চেষ্টা করি।
তবে ভূতটার ওপর থেকে আমি নজর সরাই না। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করি, আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু আমি পাইনি।
ভূতটা আমার প্রশ্নে হোক, কিংবা বেপরোয়া ভাব দেখে বারান্দায় চলাফেরার যথেষ্ট পথ রেখে একপাশে দাঁড়ায়। বিষণœভাবে বলে, ‘না, আমি আপনাদের ক্লাবের মেম্বর নই। তবে আমি হলাম একজন ভূত।
আসলে ভূতটা আমাকে ভয় পাওয়াতে চাইছে।
আমিও বেপরোয়া ভাব দেখাই। বলি মেম্বার ছাড়া ক্লাবে ঘোরাফেরা খুবই নিন্দনীয়। তাহলে কি তুমি ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?
অবশ্য আমাকে প্রত্যেকটি কথা খুবই হিসেব করে বলতে হচ্ছিল। পাছে ভূতটা আমার মনের দুর্বলতা টের পেয়ে যায়।
অতি কষ্টে আমি একটা মোমবাতি জ্বালি। মোমবাতি হাতে ভূতটার দিকে ঘুরে দাঁড়াই। প্রশ্ন করি, আসলে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলে?
মোমবাতির আলোয় ভূতটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সুবোধ বালকের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। পরে আস্তে-আস্তে বলে, প্রকৃতপক্ষে আমি এখানে এসেছি মানুষকে ভয় দেখাতে।
ভূতের কথায় আমার কৌতূহল জাগে। আবার প্রশ্ন করি, এ বুদ্ধিটা তোমাকে কে দিলো?
ভূতটা আমতা-আমতা করে বলে, আমি একজন ভূত। ভূত সব সময় জীবন্ত মানুষদের ভয় দেখায়। আমিও আমার মহান কর্তব্য পালন করতে এখানে এসেছি।
আমিও ছাড়বার পাত্র নই। সঙ্গে-সঙ্গে বলি, এটা ভদ্রলোকের ক্লাব। এখানে ক্লাবের সদস্যদের অনুমতি ছাড়া কারও কিছু করার অধিকার নেই। তাছাড়া, এই ক্লাবে মহিলা ও শিশুরা আসে। তারা যদি একটিবার তোমার শ্রীবদনখানা দেখে, তাহলে সত্যি-সত্যি ভয় পাবে। ক্লাবের বদনাম হবে। এসব কথা কি একটিবারও ভেবে দেখেছ?
ভূতটা মাথা চুলকায়। অপ্রস্তুতভাবে বলে, আজ্ঞে না, সে রকম কিছু ভাবিনি।
তাহলে কী তুমি এখানে খুন হয়েছিলে?
আজ্ঞে তাও নয়। তবে জায়গাটা দেখার পর কেন জানি না আমার খুব পছন্দ হয়। কেননা এখানকার পরিবেশ সেকালের মতো।
কথা বলতে-বলতে ভূতটা একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
আমি ভূতটার কাছে যাই। বলি—একি হচ্ছে? এভাবে কাঁদলে কি সমস্যার সমাধান হবে?
কথা বলতে-বলতে অভ্যাসবশত ভূতের পিঠে হাত দিতে যাই।
কিন্তু আমার হাতটা ভূতের ছায়াশরীর ভেদ করে নিচে নামে। আমি সমস্ত শরীরে শিহরণ অনুভব করি। কয়েক পা পিছিয়ে আসি। ওকে সাহায্য করার জন্য আমিও হাত দুটি দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গি করতে শুরু করি।
স্যান্ডারসন মন্তব্য করে, শেষ পর্যন্ত ভূতটা তোমার সহায়তায় সাফল্যমÐিত হলো?
তুমি ঠিকই ধরেছ স্যান্ডারসন। অতি কষ্টে ভূতটার মনোবল ফিরিয়ে আনি। ওকে এক রকম জোর করে দাঁড়া করাই। নানান ভঙ্গি ভূতটাকে দেখাই।
ভূতটা মনোযোগ দিয়ে আমার নানান ভঙ্গি দেখে। পরে বলে আপনাকে দেখে আমি বেসামাল হয়ে পড়েছি।
অগত্যা আমি ভূতটার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াই। আয়নার মাধ্যমে ওর দিকে লক্ষ্য রাখি।
আমাকে পিছন ফিরতে দেখে ভূত সঙ্গে-সঙ্গে নানান রকম ভঙ্গি করতে থাকে। এক সময় শেষ ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। অর্থাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের হাত দুটি দুপাশে ছড়িয়ে দেয়।
ঠিক সে সময় ক্লাবের ঘড়ি সশব্দে রাত একটা ঘোষণা করে।
এতোক্ষণ ইভান্স চুপ করে ছিল। সে এবার প্রশ্ন করে, তারপর তুমি কী করলে ক্লেটন?
তারপর, তারপর আর কী করব? ততোক্ষণে ইচ্ছে হলো ঘুমিয়ে শরীরের ক্লান্তি দূর করি।
ক্লেটনের বক্তব্য সবাই বিশ্বাস করতে পারে না।
বিশেষ করে প্রাচীন ও বর্তমান স্থাপত্য বিষয়ে গবেষক স্যান্ডারসন ভূতের দেহের ভঙ্গিগুলো বিশ্বাস করে না। ক্লেটনকে সে ভঙ্গিগুলো দেখাতে বলে। অন্য সদস্য ইভান্স বাধা দেয়। বলে তার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা ওসব ভঙ্গি করতে গিয়ে ক্লেটনের কোনো ক্ষতি হয়, নিশ্চয়ই আমরা সহজভাবে নিতে পারব না।
অন্য সদস্যরা সমর্থন জানায় উইশ ইভান্সকে।
ক্লেটন তবুও ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়ায়। অল্প সময় নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে কী যেনো চিন্তা করে। পরে তার হোতজোড়া সমান্তরালভাবে সামনের দিকে এগোয়…
দেহের বিভিন্ন ভঙ্গিমা করার পর স্যান্ডারসন বলে, বেশ ভঙ্গিমা আয়ত্ব করেছ ভূতের কাছ থেকে। কিন্তু শেষের ভঙ্গিটা তুমি কিন্তু করোনি ক্লেটন।
হাসে ক্লেটন। বলে, আমি জানি। তবে ভূতটা অদৃশ্য হয়েছিল ওই ভঙ্গির পরেই। তবু স্যান্ডারসন ছাড়ার পাত্র নয়। বিজ্ঞানের যুগে সে এ জাতীয় মনের দুর্বলতাকে পরিহাস করে।
অন্যদের আপত্তি সত্তে¡ও ক্লেটন আবার নতুন করে ভূতের অদৃশ্য হওয়ার ভঙ্গিগুলো শুরু করে।
এক সময় সব ক’টি অঙ্গভঙ্গি করে ক্লেটন স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ক্লেটন যে মজার গল্প তৈরি করেছে, সে বিষয়ে সদস্যদের কোন সন্দেহ থাকে না।
যখন সকলে ব্যাপারটা নিয়ে হাসহাসি করছে, তখন আসলে কিন্তু ক্লেটনের মুখমÐল পাল্টাতে শুরু করে। মৃতের মতো স্থির হয়েছে তার চোখ। শক্ত হয়ে গেছে শরীর। নিশ্চল পাথরের মতো হলেও অল্প-অল্প দুলতে থাকে। তারপরেই হঠাৎ একই সঙ্গে ঘরের চেয়ার আসবাবপত্র ইত্যাদি আপনা-আপনি মেঝেতে আছড়ে পড়তে শুরু করে। সকলে ব্যস্ত হয়। ভয়ও পায়।
ক্লেটনের দেহটা মাটিতে আছড়ে পড়ে দাঁড়ানো অবস্থায়। কোন লক্ষণই দেখা যায় না ওঠার। ইভান্স ছুটে গিয়ে ক্লেটনকে ধরে। কিছুক্ষণ ধরে কথা বলতে পারে না ক্লাবের কোন সদস্যই। হকচকিয়ে যায় সকলে।
স্যান্ডারসন সঙ্গে-সঙ্গে ক্লেটনের দেহ পরীক্ষা করে ক্লেটনকে মৃত ঘোষণা করে!