কালো বিড়াল

এডগার এলেন পো ।।
অত্যন্ত দুরন্ত, অথচ অত্যন্ত ঘরোয়া যে কাহিনিটি আমি লিখতে বসেছি, সেটি লোকে বিশ্বাস করবে, তা যেমন আমি আশা করি না, তেমনি কাউকে তা বিশ্বাস করতে বলবও না। যেখানে আমাদের নিজের চোখ-কানই নিজেকে বিশ্বাস করে না, সেখানে অন্যের কাছ থেকে সেই বিশ্বাস আশা করাই তো পাগলামি। অথচ আমি তো পাগল নই, আর নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখাটাও আমার কাজ নয়। কিন্তু আগামীকাল আমি মারা যাব, তাই আজ আমার মনের বোঝাটা হালকা করতে চাই। নেহাতই একটি পারিবারিক ঘটনা-শৃঙ্খলকে সহজ কথায়, সংক্ষেপে ও বিনা মন্তব্যে জগতের সামনে তুলে ধরাই আমার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য। সেসব ঘটনা আমাকে সন্ত্রস্ত করেছে, নির্যাতিত করেছে, ধ্বংস করেছে। তবু তাদের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা আমি করব না। আমার কাছে সেসব ঘটনা আতঙ্কেরই অন্য নাম। হয় অন্যের কাছে সেগুলো ততটা ভয়ঙ্কর নাও হতে পারে। হয়তো পরবর্তীকালে এমন সব বুদ্ধিমান মানুষ আসবে, যারা আমার ভৌতিক কল্পনাকে সাধারণ ঘটনার পর্যায়ে নামিয়ে আনবেÑযেসব ঘটনা আমাকে ভয়ার্ত করে তুলেছে, তারা হয়তো তার মধ্যে স্বাভাবিক কার্যকারণ পরম্পরা-ভিন্ন আর কিছুই দেখতে পাবে না।
ছোটবেলা থেকেই ন¤্রতা ও মানবিকতাই ছিল আমার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। আমার মনটা এতই নরম ছিল যে, সঙ্গীরা পর্যন্ত তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত। বিশেষ করে জীবজন্তু ছিল আমার অতিশয় প্রিয়। বাবা-মাও আমাকে নানা রকম জীবজন্তু এনে দিতেন আদর করে পুষবার জন্য। তাদের নিয়েই আমার বেশি সময় কাটত। তাদের খাইয়ে, আদরযতœ করে আমি খুবই খুশি হতাম। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যও বাড়তে লাগল।
অল্প বয়সেই আমার বিয়ে হলো। আমার স্ত্রীর স্বভাবটিও আমার স্বভাবের অনুরূপ হওয়ায় আমি বেশ খুশি হলাম। পোষা জীবজন্তুর প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করে সেও সুযোগ পেলেই নানা রকম জীবজন্তুর বাচ্চা আমাকে এনে দিত। এভাবে আমাদের চিড়িয়াখানায় জমা হলো নানা রকম পাখি, সোনালি মাছ, একটা কুকুর, খরগোশ, একটা ছোট বানর। আর একটা বিড়াল।
এই শেষোক্ত প্রাণীটি ছিল বেশ বড়সড় ও সুন্দর। কালো কুচকুচে, আর অসাধারণ তীক্ষèধী। তার বুদ্ধির কথা উঠলেই আমার স্ত্রী প্রায়ই একটি প্রাচীন প্রবাদ বাক্যের উল্লেখ করে বলত, সব কালো বিড়ালই নাকি ছদ্মবেশী ডাইনি। সে যে খুব গুরুত্ব দিয়ে কথাটা বলত, তা কিন্তু নয়, আর আমিও কথাটা উল্লেখ করলাম হঠাৎ মনে পড়ে গেল বলেই, অন্য কোনো কারণে নয়।
বিড়ালটার নাম ছিল প্লুটো। আমার খুবই প্রিয় এবং খেলার সাথি। একমাত্র আমিই তাকে খাওয়াতাম, আর সেও বাড়ির মধ্যে সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। এমনকি অনেক কষ্ট করে তার রাজপথে আমার সঙ্গে যাওয়া থেকে তাকে বিরত রাখতে হতো।
আমাদের এই রকম বন্ধুত্ব বেশ কয়েক বছর চলল। ইতোমধ্যে আমার সাধারণ মেজাজ ও চরিত্রে পাষÐ সুরাসক্তির পদসঞ্চারের ফলে আমূল পরিবর্তন ঘটল। যত দিন যেতে লাগল ততই আমি আরও বদমেজাজি, আরও খিটখিটে, অন্যের অনুভ‚তি সম্পর্কে আরও বেশি উদাসীন হয়ে উঠলাম। স্ত্রীর প্রতিও অসংযত ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত তার গায়ে হাত তুলতে পর্যন্ত দ্বিধা করতাম না। পোষা প্রাণীগুলোও আমার মেজাজের এই পরিবর্তন অনুভব করতে লাগল। শুধু যে তাদের অবহেলা করতাম তা-ই নয়, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করতাম। অন্য সব জীবজন্তু যেমন খরগোশ, বানর, এমনকি কুকুরটাও যখনই আমার কাছে এসে দাঁড়াত, তখনই তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতাম। অবশ্য প্লুটোর ব্যাপারে বলব, আমি যথেষ্ট সংযত আচরণই করতাম। কিন্তু রোগ আমাকে পেয়ে বসলÑমদের মতো ব্যাধি আর কী আছে! আর শেষ পর্যন্ত প্লুটোওÑএত দিনে সেও বুড়ো হয়েছে, একটু খিটখিটে হয়েছেÑআমার বদমেজাজের শিকার হতে লাগল।
একদিন রাতে বেশ নেশা করে শহরের আড্ডা থেকে ফিরে এসেই মনে হলো, বিড়ালটা আমাকে এড়িয়ে চলছে। সেটাকে পাকড়াও করলাম। সেও ভয় পেয়ে আমার হাতে দাঁত বসিয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে অসুরের ক্রোধ জাগল আমার মনে। নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। মনে হলো, সেই মুহূর্তে আমার আত্মা আমার দেহ ছেড়ে পালিয়ে গেছে; শয়তানের অধিক এক প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি সুরার প্রভাবে আচ্ছন্ন আমার দেহের প্রতিটি ¯œায়ুকে বুঝি উত্তেজিত করে তুলল। ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে কলম কাটা ছুরিটা বের করে ধারালো ফলাটা খুলে বেচারি বিড়ালটার গলা চেপে ধরলাম; তার একটা চোখকে কোটর থেকে কেটে তুলে নিলাম। সেই আসুরিক নির্যাতনের কথা লিখতে বসে লজ্জায় আমার মাথা নুয়ে পড়ছে, বুকের ভেতরটা জ্বলছে, সারা শরীর শিউরে উঠছে।
রাতের অমিতাচারের সব কালো ধোঁয়া একটা গভীর ঘুমের আমেজে কাটিয়ে ফেলে সকালে যখন আমার সুবুদ্ধি ফিরে এলো তখনও রাতে যে দুষ্কর্মটি করেছি, তার দরুন আধা-আতঙ্ক ও আধা-অনুশোচনার একটা মিশ্র অনুভ‚তি আমার মনকে ছুঁয়েছিল; কিন্তু সে অনুভ‚তি ছিল বড়ই দুর্বল। অতএব আমার আত্মাকে স্পর্শ করতে পারেনি। পুনরায় অমিতাচারে ডুব দিলাম; অচিরেই সেই দুষ্কৃতির স্মৃতি মদের সাগরে ডুবে গেল।
ইতোমধ্যে বিড়ালটা ধীরে-ধীরে ভালো হয়ে উঠল। হারানো চোখের কোটরটি দেখতে ভয়াবহ হলেও মনে হলো এখন আর তার চোখে কোনো যন্ত্রণা নেই। সে আগের মতো বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু আমাকে দেখলেই তীব্র ভয়ে পালিয়ে যায়। তখনও বোধ হয় আগেকার অন্তরটিকে সম্পূর্ণ হারাইনি, তাই যে প্রাণীটি একদিন আমাকে এত ভালোবাসত, আমার প্রতি তার এই বিতৃষ্ণা দেখে প্রথম দিকে আমার কষ্ট হতো। কিন্তু অচিরেই সেই কষ্টের বদলে জন্ম নিল বিরক্তি। আর তারপরেই দেখা দিলÑবুঝিবা আমার চরম ও অনিবার্য পতনকে ডেকে আনতেইÑদেখা দিল এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। দর্শনশাস্ত্রে এই বিকৃতির কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু আমি তো জানি তার স্বরূপ। আগেই বলেছি, আমার চরম পতন ঘটাতেই দেখা দিল এই মানসিক বিকৃতি। একদিন এই নির্দোষ জন্তুটির যে ক্ষতি আমি করেছিলাম, এই বিকৃত মানসিকতার তাড়নাতেই এবার আমি সেই ক্ষতির পূর্ণতা সাধন করলাম। একদিন সকালে ঠান্ডা মাথায় বিড়ালটার গলায় একটা ফাঁস পরিয়ে দিয়ে তাকে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিলাম;Ñসে কাজ করতে আমার চোখে অশ্রæধারা বয়ে গেল; তিক্ততম অনুশোচনায় কেঁদে উঠল আমার অন্তর; তাকে ফাঁসিতে ঝোলালাম, কারণ আমি জানতাম সে একদিন আমাকে ভালোবাসত, আরও বুঝতাম যে সে আমার প্রতি কোনো অন্যায় করেনি। তাকে ঝুলিয়ে দিলাম কারণ আমি জানতাম এই কাজটা করে আমি পাপ করছিÑযে পাপ এতই মারাত্মক যে তার ফলে আমার অমর আত্মা এত দূর বিপন্ন হয়ে পড়বে যেÑযদি তার কোনো সম্ভাবনা থাকেÑপরম দয়ালু ও চরম ভয়ঙ্কর ঈশ্বরের অপার করুণাও তার কাছে কোনো দিন পৌঁছবে না।
যেদিন এই নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটেছিল সেই রাতেই ‘আগুন-আগুন’ চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমার বিছানার মশারিতে আগুন লেগেছিল। সমস্ত বাড়িটাই পুড়ে গেল। বহু চেষ্টার ফলে আমার স্ত্রী, একটি ভৃত্য ও আমি নিজে অগ্নিকাÐের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। সেই আগুন আমার সমস্ত পার্থিব সম্পদ গ্রাস করল। আর সেই থেকেই আমি হলাম এক তীব্র হতাশার শিকার।
যে ঘটনা-শৃঙ্খলের বিবরণ লিখতে বসেছি তার কোনো কথাই আমি বাদ দেব না। অগ্নিকাÐের পরদিন ধ্বংসস্তূপ দেখতে গেলাম। একটি ছাড়া অন্য সব দেয়াল ভেঙে পড়েছে। যে দেয়ালটি খাড়া আছে সেদিকেই ছিল আমার শয্যার মাথা। দেখলাম, সেই দেয়ালের কাছে বেশ ভিড় জমেছে; অনেকেই গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেয়ালের একটি বিশেষ অংশ পরীক্ষা করছে। ‘আশ্চর্য! অদ্ভুত!’ এবং অনুরূপ সব মন্তব্য শুনে আমারও কৌত‚হল জাগল। একটু এগিয়েই দেখতে পেলাম একটি প্রকাÐ বিড়ালের মূর্তি যেন সাদা পটভ‚মিতে খোদাই করা রয়েছে। বাস্তবের সঙ্গে ছবিটির হুবহু মিল সত্যিই বিস্ময়কর। জন্তুটির গলায় একটি দড়িও ছিল!
প্রথম যখন এই প্রেতমূর্তি দেখলামÑএর চাইতে অন্য কিছু তখন আমি ভাবতে পারিনি। তখন আমার বিস্ময় ও আতঙ্ক একেবারে চরমে উঠেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচার-বিবেচনাই আমার সহায় হলো। মনে পড়ল, আমাদের গৃহসংলগ্ন বিড়ালটাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আগুনের সতর্কবাণী শুনে বহু মানুষ বাগানে জমায়েত হয়েছিলÑহয়ত তাদেরই কেউ জন্তুটিকে গাছ থেকে কেটে নামিয়ে খোলা জানালা দিয়ে আমার ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল। সম্ভবত আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার জন্যই এ কাজটা করা হয়েছিল। তারপর ধসেপড়া অন্য দেয়ালের চাপে এবং পলেস্তারা ও চুনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উল্লিখিত ছবিটি আঁকা হয়ে গিয়েছিল। আর সেটা দেখেই আমি আঁতকে উঠেছিলাম।
বিবেককে না হলেও আমার বিচার-বুদ্ধিকে ব্যাপারটা এইভাবে বোঝাতে পারলেও আমার কল্পনার ওপর তার প্রভাব কিন্তু গভীরভাবেই আঁকা পড়ল। মাসের পর মাস বিড়ালের অপচ্ছায়া আমাকে তাড়া করে ফিরতে লাগল। হয়ত কিছুটা অনুশোচনার ভাবও মনে জেগেছিল। এমনও মনে হতো যে বিড়ালটাকে হারিয়ে আমি নিজেরই ক্ষতি করেছি। তাই এখানে-সেখানে ওই জাতের আর একটা দেখতে অনেকটা সেই রকম বিড়ালের খোঁজ করতে শুরু করলাম, যাতে আগের বিড়ালটার শূন্যস্থানটি পূর্ণ করা যায়।
একদিন রাতে প্রায় হতবুদ্ধি অবস্থায় একটা কুখ্যাত আড্ডাখানায় বসেছিলাম। হঠাৎ একটা কালো বস্তুর ওপর আমার নজর পড়ল। ঘরে যেসব বড় বড় জিন ও রামের পিপে ছিল তারই একটার মাথার ওপর তিনি আরাম করে শুয়ে ছিলেন। একটু এগিয়ে গিয়ে তার গায়ে হাত রাখলাম; একটা কালো বিড়ালÑপ্রকাÐ বড় চেহারাÑপ্লুটোর মতোই। মাত্র একটি ছাড়া আর সব বিষয়েই প্লুটোর সঙ্গে বিড়ালটার মিলও যথেষ্ট। প্লুটোর দেহে কোথাও সাদা লোম ছিল না; কিন্তু এই বিড়ালটার বুকের প্রায় সবটাই সাদা লোমে ঢাকা।
আমি হাত ছোঁয়াতেই বিড়ালটি উঠে বসল। জোরে গরগর শব্দ করে উঠল। মনে হলো তার দিকে আমার নজর পড়ায় সে বেশ খুশিই হয়েছে। তাহলে তো একেই এতদিন খুঁজে বেড়িয়েছি। তখনই মালিকের কাছে বিড়ালটিকে কিনে নেয়ার প্রস্তাব করলাম; কিন্তু মালিক বিড়ালটাকে তার সম্পত্তি বলে দাবিই করল নাÑসে ওটাকে চেনেই না, আগে কখনো চোখেই দেখেনি।
আরও কিছুক্ষণ আদর করে যখন বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম, তখন মনে হলো বিড়ালটাও আমার সঙ্গী হতে ইচ্ছুক। সঙ্গে নিলাম; পথে যেতে যেতে মাঝে-মধ্যে নিচু হয়ে তাকে আদরও করলাম। বাড়িতে পৌঁছেই বিড়ালটা যেন অনেক দিনের পোষা হয়ে গেল; সঙ্গে সঙ্গেই সে আমার স্ত্রীর খুব প্রিয় হয়ে গেল।
আমার মনে কিন্তু বিড়ালটার প্রতি একটা বিরূপ ভাবই দেখা দিল। যা ভেবেছিলাম বাস্তবে ঘটল তার ঠিক উল্টো। কিন্তু কেমন করে বা কেন এটা ঘটল, তা জানি নাÑবিড়ালটা যে আমার ন্যাওটা হয়ে পড়ল তাতে আমি বিরক্ত ও উত্ত্যক্তই হলাম। আমার এই বিরূপ মনোভাব ধীরে-ধীরে বাড়তে-বাড়তে তীব্র ঘৃণায় পৌঁছে গেল। বিড়ালটাকে আমি এড়িয়েই চলি; একটা লজ্জাবোধের ফলে, এবং একদা যে নিষ্ঠুর কাজটি করেছি সে-কথা মনে করে তার গায়েও হাত তুলতে পারি না। কয়েক সপ্তাহ তাকে মারধর কিছুই করলাম না; কিন্তু আস্তে আস্তেÑখুবই আস্তে আমার মনে তার প্রতি একটা অকথ্য ঘৃণা দেখা দিল; মহামারির নিঃশ্বাস থেকে মানুষ যেভাবে পালায়। আমিও তার ন্যক্কারজনক সান্নিধ্য থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে যেতে লাগলাম।
জীবটির প্রতি এই বিদ্বেষের অন্য একটি কারণ আবিষ্কার করেছিলাম, সেটাকে বাড়িতে আনার পরদিন সকালেই। প্লুটোর মতোই সে বিড়ালটারও একটা চোখ ছিল না। অবশ্যই ওই একই কারণে আমার স্ত্রীর কাছে সে আরও বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিড়ালটা যত বেশি করে আমার দিকে ঘেঁষতে আসে ততই যেন তার প্রতি আমার বিদ্বেষ বেড়েই চলে। এমন একগুঁয়েভাবে সে আমার পেছন-পেছন হাঁটে যে তা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। আমি যখনই বসি, সে আমার চেয়ারের নিচে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকে; কখনো-বা আমার হাঁটুর ওপর লাফিয়ে উঠে আমাকে জবরদস্তি আদর করতে থাকে। যখনই হাঁটতে শুরু করি, সে-ও আমার পায়ে-পায়ে হাঁটে, দুই পায়ের মাঝখানে ঢুকে আমাকে ফেলে দেওয়ার উপক্রম করে, অথবা তার লম্বা-লম্বা ধারালো থাবা আমার পোশাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এইভাবে আমার বুকে পর্যন্ত উঠে দাঁড়ায়। অনেক সময়ই মনে হতোÑদিই দুই ঘা লাগিয়ে। কিন্তু তাও করতে পারতাম না আগেকার অপরাধের কথা স্মরণ করে। কিন্তু অকপটেই স্বীকার করছি প্রধানত জন্তুটাকে আমি বড় ভয় করতাম বলে।
ভয়টা যে কোনোরকম শারীরিক ক্ষতির, তা কিন্তু ঠিক নয়। অথচ আর কীভাবে যে সেটাকে প্রকাশ করব, তাও বুঝতে পারি না। তবু স্বীকার করতেও লজ্জা করে যে বিড়ালটাকে দেখে আমার এই ভয়, এই আতঙ্ক আমার নিজেরই একটা অলীক কল্পনার ফল। এই বিড়ালটার গায়ে সাদা লোমের কথা আগেই বলেছি। এখানে পাঠককে স্মরণ রাখতে হবে যে, এই সাদা লোমের চিহ্নটা বেশ বড় বলে গোড়ায় খুবই অস্পষ্ট ছিল, কিন্তু একটু একটু করে বেড়ে কখন যে সেটা খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা বুঝতেও পারিনি। এখন সেই চিহ্নটা এমন একটা বস্তুর প্রতীক হয়ে উঠছে, যার নাম করতেই আতঙ্কে আমি শিউরে উঠিÑআর সেই কারণেই আমি তাকে ঘৃণা করি, তাকে ভয় করি। আর সাহসে কুলোলে সেই রাক্ষসটার হাত থেকে মুক্তি পেতে চাইÑআমার কাছে সেটা এখন ফাঁসির দড়ির এক বীভৎস প্রতিমূর্তি! হায়! কত আতঙ্কের ও অপরাধেরÑকত যন্ত্রণার ও মৃত্যুর এক শোকাবহ ভয়ঙ্কর যন্ত্র!
আজ আমার মতো হতভাগ্য মানুষ আর কে আছে! একটি ইতর পশুÑযার এক জাতভাইকে আমি শোচনীয়ভাবে খুন করেছিÑএকটি ইতর পশুর ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিরূপে গড়া আমার মতো একটি মানুষের জন্য এনেছে কী দুঃসহ দুঃখ! হায়! কি দিনে কি রাতে শান্তির আশীর্বাদ আমার ললাটকে একটু স্পর্শও করে না। দিনে সেই জীবটি মুহূর্তের জন্যও আমাকে একলা থাকতে দেয় না; আর রাত হলে অকথ্য ভয়ের স্বপ্ন ভেঙে যেতেই আমার মুখের ওপর এসে পড়ে সেই জীবটির উষ্ণ নিশ্বাসÑএকটা মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের বিরাট বোঝা আমার বুকের ওপর চিরকালের মতো চেপে বসে, তাকে এতটুকু সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই!
এসব যন্ত্রণার চাপে তখন পর্যন্ত যেটুকু ভালো আমার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল তারও শেষ হয়ে গেল। অন্যায় চিন্তাÑনিকৃষ্টতম পাপ-চিন্তা আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল। এমনকি আমার যে সরলা স্ত্রীটি মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করেছে, সে-ও হয়ে উঠল আমার অত্যাচারের নীরব শিকার।
একদিন পারিবারিক প্রয়োজনে সেই বিড়ালটা আমার সঙ্গে পুরোনো বাড়ির ভ‚গর্ভ-কক্ষে গেল। দারিদ্র্যের চাপে আমরা তখন বাধ্য হয়ে সেই বাড়িতেই বাস করি। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় আমাদের অনুসরণ করে সে আমাকে প্রায় উল্টে ফেলে দেয়ার জোগাড় করেছিল। তাতেই আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। একটা কুড়াল তুলে নিয়ে বিড়ালটাকে লক্ষ্য করে এক কোপ বসিয়ে দিলাম। কোপটা সঠিক লক্ষ্যে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে বাছাধনের ভবলীলা সাঙ্গ হতো। কিন্তু কোপটা আটকে গেল আমার স্ত্রী হাত বাড়িয়ে বাধা দেয়ায়। বাধা পেয়ে আমার রাগ আসুরিক মূর্তি ধারণ করল। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সজোরে কুড়ালের কোপ বসিয়ে দিলাম স্ত্রীর মাথায়। সেখানেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। একটা আর্তনাদও বের হলো না তার মুখ থেকে।
বীভৎস হত্যাকাÐটি করে মৃতদেহটিকে লুকিয়ে ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি জানতাম দিনে হোক বা রাতে হোক মৃতদেহটা বাড়ি থেকে সরাতে গেলেই কেউ-না-কেউ দেখে ফেলবে। অনেক রকম ফন্দি মাথায় এলো। একবার ভাবলাম, ভ‚গর্ভ-পক্ষের মেঝেতে ওটাকে কবর দেব। আবার ভাবলাম, উঠানের কুয়োর মধ্যে ফেলে দেবÑমালপত্রের মতো একটা বাক্সের মধ্যে প্যাক করে কুলি ডেকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাব। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, ভ‚গর্ভ-কক্ষে সেটাকে পাঁচিল তুলে আটকে দেবÑমধ্যযুগে সন্ন্যাসীরা যেভাবে তাদের শত্রæদের শাস্তি দিতেন।
বাড়ির ভ‚গর্ভ-কক্ষটাকে সহজেই এই কাজে ব্যহার করা গেল। একটা শাবল দিয়ে দেয়ালের ইট খুলে মৃতুদেহটাকে সেই ফোঁকরের মধ্যে বসিয়ে হুবহু আগেকার মতো করেই দেয়ালটাকে পলেস্তারা বসিয়ে দিতে মোটেই অসুবিধা হলো না। কাজ শেষ হলে তা দেখে খুব খুশি হলাম। নতুন পলেস্তারার চিহ্নমাত্রও চোখে পড়ছে না; সবটাই দেখাচ্ছে ঠিক আগেকার পলেস্তারারই মতো। মেঝেতে ইটের টুকরো, চুন ও বালু যা পড়েছিল বেশ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তুলে দিলাম। বিজয়ীর ভঙ্গিতে চারদিকে তাকিয়ে নিজেকেই বললাম, ‘অন্তত এক্ষেত্রে আমার চেষ্টা বিফল হয়নি!’
আমার পরবর্তী কাজ হলো সব নষ্টের গোড়া এই বিড়ালটাকে খুঁজে বের করা। কারণ এবার আমি মনস্থির করে ফেলেছি যে, সেটাকেও শেষ করে ফেলব। সেই মুহূর্তে তাকে হাতের কাছে পেলে তার ভবলীলা সাঙ্গ হতে বিলম্ব ঘটত না। কিন্তু চতুর জন্তুটি আমার রাগের বহর দেখে যথাসময়েই সেখান থেকে সরে পড়েছে। রাতেও তার দেখা পেলাম নাÑআর এইভাবে নতুন বিড়ালটা এ বাড়িতে আসার পর থেকে এই প্রথম একটা রাতে আমি শান্তিতে গভীর ঘুম ঘুমালাম; হ্যাঁ, একটা খুনের বোঝা বুকে নিয়েও ঘুমালাম!
দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন কেটে গেল, তখনও আমার যন্ত্রণাদাতা এলো না। আবার আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। রাক্ষসটা ভয়েই এ-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে! আর তাকে চোখে দেখতে হবে না! আমার কী অপার আনন্দ! আমার পাপ কাজ নিয়েও বিশেষ গোলমাল হলো না। অল্প কিছু খোঁজখবর হলো বটে, কিন্তু সে ঝামেলা সহজেই মিটে গেল। একটা খানা-তল্লাশিও হলো, কিন্তু তাতেও কিছু পাওয়া গেল না। অতএব আমার ভবিষ্যৎ নিরাপদ।
খুনের চতুর্থ দিনে খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে একদল পুলিশ বাড়িতে এলো। সারা বাড়ি তন্ন-তন্ন করে খুঁজল। আমি তো জানতাম, শত চেষ্টাতেও পুলিশ কিছুই খুঁজে পাবে না; কাজেই আমি মোটেই বিব্রত হলাম না। পুলিশ-অফিসারদের নির্দেশে তল্লাশির সময় আমিও তাদের সঙ্গে গেলাম। বাড়ির এ-কোণ সে-কোণ কোনো জায়গাই তারা বাকি রাখল না। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বা চতুর্থবারে তারা ভ‚গর্ভ-কক্ষে নেমে গেল। আমার একটা মাংসপেশিও কাঁপল না। ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত আমি হাঁটতে লাগলাম। দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে আমি সহজভাবেই ঘোরাফেরা করতে লাগলাম। পুলিশরা কোনো কিছু না পেয়ে ফিরে যেতে উদ্যোগী হলো। মহাআনন্দে আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না। জয়ের আনন্দকে প্রকাশ করতে অন্তত একটা কথা বলার জন্য আমার মনটা উশখুশ করে উঠল। ভাবলাম, তাহলেই আমি যে সম্পূর্ণ নির্দোষ যে সম্পর্কে তারা দ্বিগুণ নিশ্চিত হবে।
পুলিশের দলটি সিঁড়িতে পা দিতেই আমি বলে উঠলাম, ‘মশায়রা, আপনাদের সব সন্দেহ দূর করতে পারায় আমি আনন্দিত। আপনারা সুস্থ থাকুন এই কামনা করি। হ্যাঁÑভালো কথা মশায়রা, এইÑএই যে বাড়িটা দেখছেনÑএটা খুব ভালোভাবে নির্মিতÑবরং বলতে পারি খুবই উৎকৃষ্ট এর নির্মাণকার্য। এই দেয়ালগুলোÑআপনারা কি চলে যাচ্ছেন নাকি? এই দেয়ালগুলো খুব নিরেটভাবে গাঁথা।’ কথাগুলো বলার সময় সাহসিকতা প্রদর্শনের অতিউৎসাহে আমি হাতের বেতের লাঠিটা দিয়ে দেয়ালের ঠিক সেই জায়গাটাতেই সজোরে আঘাত করলাম, যার পেছনেই রাখা ছিল আমার প্রিয়তমা পতœীর মৃতদেহটি!
কিন্তুÑসেই মহাশয়তানের থাবা থেকে ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন! আমার আঘাতের প্রতিধ্বনিটা মিলিয়ে যেতে না যেতেই কবরের ভেতর থেকে কার কণ্ঠস্বর আমার কথার উত্তর দিল!Ñএকটা কান্নার শব্দ, প্রথমে চাপা ও ভাঙাভাঙা, একটি শিশুর ফুঁপিয়ে কান্নার মতো, ক্রমে অতি দ্রæত বা উদ্বেলিত হয়ে উঠল একটি দীর্ঘ, উচ্চ, অবিরাম আর্তনাদে, একান্ত সামঞ্জস্যহীন এবং অমানবিকÑএকটা ক্রুদ্ধ গর্জনÑএকটা করুণ আর্তনাদ, অর্ধেক ত্রাসের, অর্ধেক জয়ের; এমন কণ্ঠস্বর আসতে পারে একমাত্র নরক থেকেÑযারা নির্যাতিত হয়ে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, আর যে দানবরা নির্যাতন করে উল্লাসে চিৎকার করছে, সেই দুইয়ের মিলিত কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়ে।
আমার নিজের কথা তো বলাই বোকামি। টলতে-টলতে আমি মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলাম বিপরীত দিকের দেয়ালের ওপর। মুহূর্তের জন্য তদন্তকারী দলটি আতঙ্কে ও ভয়ে সিঁড়ির ওপর নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরমুহূর্তেই এক ডজন বলিষ্ঠ হাত পড়ল দেয়ালের গায়ে। দেয়াল ভেঙে পড়ল। জমাট রক্তমাখা গলিত মৃতদেহটি দর্শকবৃন্দের চোখের সামনে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথার ওপর বিস্ফারিত লাল মুখ ও একটিমাত্র অগ্নিময় চোখ নিয়ে বসে আছে সেই বীভৎস প্রাণীটি, যার চাতুরী আমাকে এই খুনের পথে ভুলিয়ে এনেছিল, আর যার কণ্ঠস্বর আমাকে তুলে দিয়েছিল ফাঁসির জল্লাদের হাতে। দেয়াল তুলে সেই রাক্ষসটাকেও আমি কবরের মধ্যে আটকে রেখেছিলাম!

অনুবাদ : মণীন্দ্র দত্ত