রহস্যময় প্রতিচ্ছবি

জর্জ বার্নার্ড শ’ ।।

রোডের নাম চার্চ। লন্ডন শহরের উপকণ্ঠে রাস্তাটা। শহরের বেশ সুন্দর খোলামেলা জায়গা এটি। ভিড় নেই একেবারে। এখানে যতদিন ছিলাম বেশ আনন্দেই কেটেছে।
কিন্তু বেশিদিন এখানে থাকা সম্ভব হলো না। এলাকাটি ছাড়তে হয়েছে বাজে একটি বাড়ির জন্যে। আমরা যখন এ এলাকায় ছিলাম তখন বাড়িটা ছিল না, জায়গাটা ফাঁকা পড়েছিল অনেকদিন।
আমাদের বাড়িটি একেবারে শেষ মাথায় চার্চ রোডের আর্ল স্ট্রীটের কাছাকাছি। আমরা এখানে আসার বেশ কিছুদিন পর বাড়িটি উঠেছে-শ্রীহীনভাবে, শিল্পকর্ম ছাড়াই। এক কথায় বাড়িটি ছিল কুশ্রী। এমন বাড়ি এতো টাকা খরচ করে কে তৈরি করল কে জানে?
বাড়ি তৈরি হওয়ার পর মিস স্পেনসার নামে এক ভদ্রমহিলা বাড়িতে উঠলেন। ঝি-চাকর ছাড়া আর কোনো আপনজন ছিল না স্পেনসারের। আস্তে-আস্তে অনেক কিছুই জানা হলো নতুন প্রতিবেশী সম্পর্কে।
রোজ সকালে স্পেনসার বাড়ির পাশের একটা দরজা দিয়ে বের হতেন। তিনি প্রায় এক ঘণ্টা চার্চ রোডের এ-প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে বেড়াতেন। ভদ্রমহিলার চেহারা লম্বা, দোহারা, পোশাক-আশাক বেশ আভিজাত্যপূর্ণ।
রাস্তার পাশে ছায়ায়-ছায়ায় যখন তিনি চলতেন, তখন তাকে দেখতে বেশ ভালো লাগত। তার আর কোনো পরিচয় জানতাম না, নামটুকু ছাড়া। তবে তিনি যে অভিজাত পরিবারেরÑএটা বেশ বুঝতে পারতাম। তার গাড়িটিও বেশ দামী। তার যে অর্থের অভাব নেই, এটা সহজেই বোঝা যায়। তার জীবন নিঃস্ব ছিল বলে মনে হতো।
আমার সমবেদনা হতো তার নিঃস্ব জীবনযাপন দেখে। মনে মনে ভাবতাম তার কি কোন কাছের মানুষ নেই!
একদিন চায়ের টেবিলে আমার স্বামীকে বললাম, অতো বড় একটি বাড়িতে একাকী থাকতে মিস স্পনসারের নিশ্চয় কষ্ট হয়। একলা থাকাটা খুবই একঘেয়ে ব্যাপার।
গাড়ি থেমেছে স্মিথের স্টুডিওর সামনে। শহরতলীতে স্মিথের খুব নামডাক হলো যে, সে খুব ভালো ফটোপ্রাফার। আমি আর আমার স্বামী এখান থেক কয়েকবার ফটো তুলেছি। স্মিথ ছবি তুলেছে খুব যতœ করে। ছবিও খুব সুন্দর হয়েছে।
আমাদের ঢুকতে দেখে কাউন্টার থেকে একটি অল্পবয়সী মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ছবি তুলবেন?’
মিস স্পেনসার বললেন, ‘হ্যাঁ।’
মেয়েটি বললো, ‘আপনাদের কি আসার কথা ছিলো?’
Ñ হ্যাঁ, আসার কথা ছিলো দুটার সময়।
মিস স্পেনসার তার নাম বললেন।
‘আসুন, আপনারা ভিতর আসুন।’মেয়েটি আমাদের নিয়ে গেলো ভিতরের একটি কক্ষে। এই কক্ষটি ছবি তোলার জন্য সাজানো আছে।
‘ডার্ক চেম্বার’ থেকে একটু পরেই স্মিথ বেরিয়ে এলো। একটু হেসে বললো, ‘এই যে মিসেস হোক, কী রকম পোজে ছবি তুলবেন?’
‘আমি নই, আমার বান্ধবী ছবি তুলবেন।’ জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা মিস স্পেনসারকে দেখালাম।
আমার কথা শেষ না হতেই মিস স্পনসার আস্তে-আস্তে ঘুরে দাঁড়ালেন। তার দিকে তাকিয়ে ফটোগ্রাফার স্মিথ চমকে উঠল।
হ্যাঁ, চমকাবারই কথা। অদ্ভুত পরিবর্তন ভদ্রমহিলার মুখে। মাত্র দশ মিনিট আগে আমি কি এই মহিলার সঙ্গেই গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা করছিলাম? চোখ দুটো বসে গিয়েছে মিস স্পেনসারের। মুখখানা পাÐুর। সেখানে একবিন্দু রক্ত নেই। তার সুন্দর গোল মুখখানা কেমন যেনো লম্বাটে হয়ে গিয়েছে। অসহনীয় যন্ত্রণায় নির্ভুল ইঙ্গিত তার মুখের রেখায় ফুটে উঠেছে। অমানুষিক যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন মহিলা।
‘আপনি অসুস্থ… আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন…’ আমি চিৎকার করে আরও বললামÑ ‘একটু জল…তাড়াতাড়ি একটু জল আনুন কেউ।’
‘না, জলের প্রয়োজন নেই’ মিসেস স্পেনসার অদ্ভুত গলায় বললেন। তারপর সামনের আসনে বসে স্মিথকে ইঙ্গিত দিলেন ছবি তোলার জন্য।
স্মিথ তাড়াতাড়ি কালো পর্দাঘেরা কোণায় গিয়ে ঢুকলো। পরে আমার মনে হয়েছিল স্মিথ মিস স্পেনসারের বসার ভঙ্গি ঠিক করে দেয়নি, এমন কি একটা কথা বলেনি এ সম্পর্কে!
‘এখন ছবি তুলে কী হবে? কী দরকার?’ মিস স্পেনসারের পাশে হাঁটুগেড়ে বসে তার বরফের মতো ঠাÐা হাদ দু-খানা ঘষতে ঘষতে বললাম, ‘আপনি অসুস্থ।’ এখন আপনার শরীরের অবস্থা ছবি তোলার জন্যে উপযুক্ত নয়। ছবিতে উঠবে না আপনার আসল চেহারা। মৃত মানুষের ছবির মতো মনে হবে।’
মিস স্পেনসারের গলা চিড়ে বেরিয়ে এলো এক অমানুষিক দুঃসহ আর্তনাদ। পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা যেন ধরা পড়ল ঐ তীব্র-তীক্ষè আর্তনাদের মধ্যে। তার ডান হাতখানা চেপে ধরল চেয়ারের হাতল, দাঁতে দাঁত আটকে গেল। মিস স্পেনসারের কপালে ফুটে উঠল বড় বড় ঘামের ফোঁটা। একটা প্রচÐ ভয় যেনো আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইছে তাকে। প্রবল ইচ্ছেশক্তি দিয়ে তিনি যুঝে চলেছেন সেই মহাভয়ের সঙ্গে।
আমার দারুণ ভয় হলো ভদ্রমহিলার এ রকম অবস্থা দেখে। কাঁপতে লাগলাম আমি।
‘আসুন, চলে আসুন আপনি’ আমি চিৎকার করে উঠলাম ভদ্রমহিলাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলবার চেষ্টা করতে করতে।
বাধা দিলেন মিস স্পেনসার। ভাঙা গলায় ফ্যাস ফ্যাস করে তিনি বললেন, ‘আমি জানবো… আমাকে জানতেই হবে আপনি আমার কাছে থাকুন…কাছে থাকুন আমার…একটু সাহায্য করুন আমাকে…’
পাশে বসলাম মিস স্পেনসারের। দু-হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেললাম। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকাবার সাহস আমি হারিয়ে ফেলছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি যেনো কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি একটা বিয়োগান্তক নাটকে। কীসের জন্য, ভয় তা না জানায় আমার আতঙ্ক যেনো ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল।
কেটে যাচ্ছে সময়। কারও জন্য সময় বসে থাকে না। কালো কাপড়ে ঘেরা জায়গাটার মধ্যে ফটোগ্রাফার স্মিথের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। বসে রইলাম অভিভূতের মতো।
চমকে উঠলাম হঠাৎ স্মিথের কণ্ঠস্বরে। স্মিথ বলছে, ‘খুবই দুঃখিত ম্যাডাম, আপনার ফটো তোলা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
একটা কথাও বললেন না মিস স্পেনসার। চেয়ার থেকে উঠে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার মুখে নিদারুণ হতাশার ছাপ। খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল তাকে।
বাড়ির ফিরবার পথে কোনো কথা হলো না আমাদের দুজনের মধ্যে। আমাদের বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি পৌঁছলে তিনি এই প্রথম আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। তারপর বিষণœ কণ্ঠে বললেন, ‘বিদায় মিসেস হোপ, চির বিদায়।’
জলে ভরে এসেছিল আমার দুচোখ। গলার ভিতর থেকে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিল। মিস স্পেনসারের কথার অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না। কান্নাভরা গলায় তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না কোনো কথা। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই ঠিক সময়ে আমাকে খুলে বলবেন তার সব কথা।
সন্ধ্যায় আমার স্বামী ফিরলে সবকথা খুলে বললাম তাকে। বাদ দিলাম না একটি কথাও। আমার স্বামী হালকাভাবে নিলেন ব্যাপারটাকে। বললেন, ‘এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। এ হলো ¯œায়ুর দোষ। খেয়ালী মনের উৎকৃষ্ট কল্পনাবিলাসও বলা যেতে পারে একে।’
প্রতিবাদের সুরে আমি বললাম, ‘কখনও নয়, তুমি যদি মিস স্পেনসারের পরিবর্তিত ভয়ঙ্কর মুখখানা দেখতে, তাহলে কিছুতেই এরকম কথা বলতে পারতে না।’
আমার কথা শেষ হতে না হতেই পরিচারিকা এসে বলল, ‘ফটোগ্রাফার মিঃ স্মিথ এসেছেন। তিনি গিন্নীমার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
আমি বললাম, ‘এখানে নিয়ে এসো।’
মিঃ স্মিথ ঘরে এলে আমার স্বামী বললেন, ‘এই যে মিঃ স্মিথ, আপনার স্টুডিওতে আজকে নাকি কীসব রহস্যময় অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছেন আমার স্ত্রী।’
‘তাতে অবাক হবো না। কারণ আমি নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছি। মিসেস হোপের সঙ্গে যে মহিলা আজকে আমার স্টুডিতে গিয়েছিলেন তার সম্বন্ধে কিছুই জানি না আমি। ভদ্রমহিলা যদি মিসেস হোপের বান্ধবী হন, তবে একথা বলতে আমি বাধ্য হবো যে, ভদ্রমহিলা ঠিক স্বাভাবিক নন। কোনো একটা অবিশ্বাস্য অদ্ভুত ব্যাপার জড়িয়ে আছে ওর জীবনের সঙ্গে। হয়ত ব্যাপারটা অলৌকিক…অপ্রকৃত।’
‘এ রকম ধারণার কারণ?’
‘ছবি তোলা সম্ভব হয়নি ভদ্রমহিলার।’
‘শুধু এই কারণে আপনার এমন ধারণা হলো?’ আমার স্বামী প্রশ্ন করলেন অবজ্ঞার সুরে।
‘না, শুধু আজকের ব্যাপার নয়। মিস স্পেনসারকে আমি আগেও দেখেছি। পাঁচ বছর আগে আমি একটি বিখ্যাত কোম্পানীর ফটোগ্রাফার ছিলাম। উনি ফটো তোলার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। আমি ওর ফটো তুলতে পারিনি অনেক চেষ্টা করেও। ভদ্রমহিলার ছবি তোলা যে অসম্ভব, সে কথা তখন ওকে জানিয়েও দিয়েছিলাম।
‘অসম্ভব কেন?’ প্রশ্ন করলেন আমার স্বামী।
‘কারণ অসংখ্য দাগে ভরা প্রত্যেকটা নেগেটিভ। ভদ্রমহিলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন, কাজেই তার মুখটা আমি প্রথমে দেখতে পাইনি। কিন্তু উনি যখন ঘুরে আমার দিকে তাকালেন তখন দেখলাম একখানা শঙ্কা-বিহŸল মুখ। দেখেই ওকে চিনতে পারলাম। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম ফটো তোলার জন্য। কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা।’
‘কেন? কী হলো?’ প্রশ্ন করলাম আমি। আমার গলা থরথর করে কাঁপছিল উত্তেজনায়।
‘সেই ফল একই রকম। তবু আপনাদের দেখাবার জন্য আমি দু’খানা নেগেটিভ প্রিন্টও করেছি। ফল কী হয়েছে দেখুন। আপনিই আগে দেখুন মিঃ হোপ।’
ব্যাগের ভিতর থেকে দু-খান ছবি বের করে মিঃ স্মিথ আমার স্বামীর হাতে দিলেন।
মুহূর্তের মধ্যে আমার স্বামীর মুখের চেহারা পালটে গেলো ছবি দেখে। প্রচÐ কৌতূহল আর উৎকণ্ঠায় আমি যেনো ফেটে পড়ছিলাম। আমার আর তর সইছিল না, আমিও ফটোগুলির দিকে তাকালাম।
‘হায় ঈশ্বর! এ কী দৃশ্য দেখলাম! আমার সমস্ত শরীর দারুণ আতঙ্কে থর-থর কঁপতে লাগল। সমস্ত ছবি দাগে ভরে গিয়েছে। প্রতিটি দাগে মুখের ছাপ একটি করে। হ্যাঁ, কোন ভুলে নেই পরিষ্কার মুখের ছাপ…নিখুঁত ছাপ!
আর সে ছাপ মৃত মানুষের মুখের!
শিউরে উঠলাম দারুণ আতঙ্কে। দুল উঠল আমার চারপাশ। অন্ধকার! অন্ধকার! পুঞ্জ-পুঞ্জ অন্ধকার আমার চারপাশে। চারপাশ থেকে অন্ধকারের মহাসমুদ্রে যেন আমাকে গ্রাস করবার জন্যে ছুটে আসছে।
আর কিছু আমার মনে নেই। আমি বোধ হয় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলাম ঘরের মেঝেতে।
পরদিন আমাকে ও-বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেন আমার স্বামী।
যখন ফিরলাম পনের দিন পরে তখন সামনের বাড়িটা খালি। মিস স্পেনসার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমার দেখা হয়নি তার সঙ্গে আর। ভবিষ্যতে ভদ্রমহিলা যতো বড়ো অপরাধই করে থাকুন না কেন, আমি জানি তিনি অনেক শাস্তি পেয়েছেন…তাকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক যন্ত্রণা। দুঃসহ সে যন্ত্রণা। তিনি যে মহাপাপ করেছেন, তার জন্যে তার মন অহরহ অনুতাপ হচ্ছে…হচ্ছে অনুশোচনাও। তার মুক্তি নেই এ দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে, কোনদিনই মুক্তি নেই।
সমবেদনা বোধ করি মিস স্পেনসারের জন্যে, আমার সমস্ত মন দিয়ে তার উদ্দেশে জানাই আমার অনুকম্পা, আর প্রার্থনা করি পরম পুরুষের কাছে তার আত্মার শান্তির জন্যে।