আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার জগদ্দল মূর্তি/আলমগীর খান

কলম্বাসসহ সব লুণ্ঠকের মূর্তি ভাঙ্গার আন্দোলন ইতিহাসের অনিবার্যতা। বাংলাদেশে আমরা ভাগ্যবান যে, এখানে লুণ্ঠকের মূর্তি নেই। এখানে আছে ধর্মীয় মূর্তি, যা বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে প্রাণের মতো প্রিয়; আর আছে কিছু ভাস্কর্য, যা আমাদের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল আন্দোলন-সংগ্রামকে তুলে ধরেছে। এ দুইই আমাদের খেটেখাওয়াসহ সর্বশ্রেণীর মানুষের মনে বেঁচে থাকার প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার শক্তি দিয়ে থাকে। হয়ত আমাদের সামাজিক পরিবেশ আমেরিকা-ইউরোপের মতো হলে এখানেও নানা স্থানে শোষকের মূর্তি শোভা পেত। এই শোষকরা হলো দুইশো বছর বাংলাকে লুটে খাওয়া ইংরেজ শক্তি। তাদের মূর্তি যেখানে-সেখানে নেই বটে, কিন্তু তাদের অমূর্ত মূর্তিতে আমাদের দেশ ও মনোজগৎ ছেয়ে আছে। আমাদের অনেক শহরের অনেক জায়গা ও রাস্তাঘাট ব্রিটিশের নানা ছোটবড় কেরানিদের নামে। সে কি শুধুই ইতিহাস-ঐতিহ্যের দোহাই, না মনোজগতের উপনিবেশ? বহাল আছে ব্রিটিশ শক্তির স্বস্বার্থে তৈরি করা শিক্ষা, আইন ইত্যাদিসহ প্রায় সকল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।

এখন তো ভাবতেই ভয় লাগে মহান ব্রিটিশরা না এলে আমাদের শিক্ষা, আইনকানুনসহ সকল ব্যবস্থার কী হতো, এসব কোথায় পেতাম, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না! অতএব ইংরেজরা আমাদের ছাড়ে নাই, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আসলে তারা ছাড়তেও পারছে না, কেননা আমরাইতো জোর করে জাপটে ধরে রেখেছি।
আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম, কারণ ইংরেজিতে পাশনম্বরের চেয়ে কম পেয়েছিলাম। আমার মতো হাজার হাজারজনের এ অভিজ্ঞতা আছে। বলতে পারেন পৃথিবীতে এমন একটি সভ্য শিক্ষাব্যবস্থা আছে যেখানে কেউ উচ্চমাধ্যমিকে কোনো বিদেশি ভাষায় পাস না করায় শিক্ষায় তার কোনো অর্জন স্বীকার করা হয় না, সকল অর্জনকে এক পলকে শূন্য ঘোষণা করা হয়, সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে অপদস্থ করে, তার অন্য সকল দিক ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়, তাকে বিবেচনা করা হয় মেধাশূন্য অপদার্থ, তার সামনে বিকাশের সকল দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দেয়া হয়? লজ্জা কার, আমার না এই নীচ ঔপনিবেশিক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার? আপনি ইংরেজিতে বলবেন, ইংলিশ ইজ দি ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ! কারণ আপনি দাসানুদাস, প্রভুর একটি ছুঁড়ে দেয়া পোশাক পরে লেজ নেড়ে নেচেকুঁদে কী মজাই না পাচ্ছেন!

প্রসঙ্গ যেহেতু এলোই বলি, বিদেশি ভাষাশিক্ষা যদি পরীক্ষায় থাকেও সেই বিষয়টিতে পাসফেলের মতো কিছু থাকা উচিত না। ঐ বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বরটি শুধু মোট নম্বরের সঙ্গে যোগ হতে পারে, অন্য কিছু নয়। তা দিয়ে মোট ফল বা গ্রেড পয়েন্টকে প্রভাবিত করা ঠিক নয়। আর সেই অন্য ভাষাটি কেবল ইংরেজিই হতে হবে কেন, শিক্ষার্থীর পছন্দমত যেকোনো একটি বিদেশি ভাষাই হতে পারে, একেকবছর একেকটাও হতে পারে। সবাইকে ইংরেজ বানানোর এই দেউলিয়া চেষ্টা বন্ধ করে আমাদের ছাত্রছাত্রীকে জার্মান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, আরবি, চাইনিজ, জাপানিজ ইত্যাদি ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে জাতির লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। চেষ্টা থাকলে ধীরে ধীরে শিক্ষক ও বইয়ের অভাবপূরণ হওয়া সম্ভব। কিন্তু সবার জন্য মাতৃভাষাটি হতে হবে সর্বাগ্রগণ্য, এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া চলবে না।

ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষাজীবনে এতটা গুরুত্ব দিয়ে আমরা কি আসলে ভাষাটি শিখেছি? আমাদের এই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে ইংরেজিতে অকৃতকার্য হওয়া মানে আপনি বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্য, মানবিকতা ইত্যাদি কিছুই শেখেন নাই বলে রায় দেয়া হয়, সে কি সেই ভাষাটাও ঠিকমত শেখাতে পারছে? বারো-চৌদ্দ বছর ধরে ইংরেজি শিখে ও তার পায়ে তারুণ্যের শক্তিকে মর্মান্তিকভাবে বিসর্জন দিয়ে আমরা যা শিখছি, তা শুনে বোঝার সাধ্য বাঙ্গালি কেন, ইংরেজের বাপেরও নেই। পশ্চাৎপদ মানুষ যেমন পূজনীয় মূর্তি ফেলে দিতে ভয়ে সিঁটকে ওঠে, এই ইংরেজি ভাষার মূর্তিটাকে মাটিতে নামাতে আমাদের ধনিক ও মধ্যবিত্ত দালালশ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ^কাঁপানো শাসকদের পর্যন্ত তেমনি হাতপা কাঁপছে।

এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার এই মূর্তি দেখলে স্বয়ং মেকলে পর্যন্ত না কেঁদে পারবেন না মনে হয়। আজ যদি পরপার থেকে সে আবার এ দেশে আসে তার নিশ্চিত ধারণা হবে আমরা তার ওপর শোধ নেওয়ার জন্যই চালাকি করে স্কুল-কলেজে ইংরেজি ভাষা শেখানার এই সার্কাসটা চালু রেখেছি। লর্ড মেকলে যত ধুরন্ধরই হোক সে তো তার মাতৃভাষা ইংরেজিটাকে ভালবাসতো এবং তা এতখানি যে বিরাট সমুদ্র পেরিয়ে ভিনভাষী মানুষকেও তা শেখাতে এসেছিলেন। আর আমরা আমাদের বাংলা বিদেশিদের শেখানো দূরে থাক, নিজেরাই তো ভুলতে বসেছি। সেইসাথে ইংরেজিটারও যে বারোটা বাজাচ্ছি না, এ কথা কেউ মেকলেকে বোঝাতে পারবেন না। এক মাধ্যমে চলছে বাংরেজি আর আরেক মাধ্যমে বেংলিশ শেখার দৌড়। এখন কল্পনায় মেকলের কেঁদে ফেলাটুকু দেখতেই আমার তৃপ্তি!

কিন্তু ভয় পাচ্ছে না ইউরোপ-আমেরিকার কালো মানুষরা। আমরাতো সংকর বর্ণের, তাই হয়তো সাদা বর্ণের প্রতি সাদা মানুষদের চেয়েও বেশি টান অনুভব করি। আমাদের ঘরে তাই খাবার বা বই থাকুক বা না থাকুক, ফেয়ার এন্ড লাভলি ছাড়া কি চলে? সম্পূর্ণ কালো মানুষের এই কোনটা থুয়ে কোনটা ফেলি ধরনের সংকট নেই। তারা প্রচলিত বীর ও পূজনীয়দেরকে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ভেঙে ফেলছে তাদের মূর্তি।

ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে স্থাপিত দাসব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টোনের মূর্তি নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছে আন্দোলনকারী জনতা। দাসব্যবসায়ী রবার্ট মিলিগানের মূর্তি লন্ডন যাদুঘরের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সা¤্রাজ্যবাদী সেসিল রোডসের মুর্তি সরিয়ে ফেলার দাবি উঠছে অনেক দিন থেকে। বেলজিয়ামে আফ্রিকান-হত্যাকারী নৃশংস রাজা লিওপল্ডের মূর্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অগণ্য হত্যাকা- ও দাসব্যবসায়ের হোতা ইতালিয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তির গলায় দড়ি বেঁধে ছুঁড়ে ফেলা হয় নদীতে। আমেরিকায় দাসত্বপ্রথার সমর্থক সামরিকনেতা রবার্ট ই. লি এবং জেনারেল জে. ই. বি. স্টুয়ার্টের মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় গণহত্যা ও দাসত্বের হোতা ক্যাপ্টেন কুকের মূর্তি সরিয়ে ফেলার দাবি উঠেছে। ইতালির মিলানে ফ্যাসিজম সমর্থক ইন্দ্রো মনতানেলির মূর্তির গায়ে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘জাতি-বিদ্বেষী, ধর্ষক’। বাংলায় দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী উইনস্টন চার্চিলের মূর্তির গায়েও সেঁটে দেয়া হয়েছে তার আসল পরিচয়Ñ ‘ওয়াজ এ রেসিস্ট’। পলাশী যুদ্ধের ঘৃণ্য বিজয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা লুণ্ঠনকারী রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি ভেঙে ফেলার দাবি উঠেছে।

লিখতে চেয়েছিলাম কলম্বাসসহ সব লুণ্ঠকের মূর্তি ভাঙ্গার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। লিখলাম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার জগদ্দল মূর্তি নিয়ে। একেই কি বলেÑ ধান ভানতে শিবের গীত? না। শাসন-শোষণ ও আধিপত্যের মূর্ত ও অমূর্ত সব জগদ্দল মূর্তির কথাই বলছি।

লেখক: সম্পাদক, ছোটকাগজ ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’

সম্পাদনা/অলোক আচার্য -ফিচার এডিটর/আজ আগামী

মন্তব্য করুন