তরুণদের আত্মহননের অন্যতম কারণ মানসিক রোগ/ শীলা প্রামাণিক 

তরুণরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। অথচ এই তরুণ সমাজ বর্তমানে কঠিন সময় পার করছেন। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ বাড়ছে। বাড়ছে আত্মহননের প্রবণতা। পৃথিবীব্যাপী চলছে হিংসা, হানাহানি যুদ্ধ-সংঘাত, চলছে ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, রয়েছে সড়ক ও অন্যান্য দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্প জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, শ্রেণিবৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতির কারণে তরুণরা বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত, তরুণরা চরম মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। তারুণ্য জীবনধারার এমন একটি পর্যায় যখন শারীরবৃত্তীয়, মানসিক এবং সামাজিক আচরণের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তনের এই সময়টাকে মোকাবেলা করা চরম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ বয়সন্ধিকাল মোকাবেলা করতে হয় এই বয়সেই। আর এই সময়টি নিয়ে যখন তারা দ্বন্দ্বে বা অনিশ্চয়তায় ভোগে তখনই সৃষ্টি হয় মানসিক রোগের। যার চরম পরিণতি হয় আত্মহনন।

যেসব আচরণ স্বাভাবিক আচরণ বহির্ভূত সেসব আচরণকে সাধারণভাবে অস্বাভাবিক আচরণ বলে। যা নিজের এবং অন্যদের জন্য ক্ষতিকর। এই অস্বাভাবিক আচরণই হলো মানসিক রোগ।

বিভিন্ন কারণে মানসিক রোগ হয়ে থাকে যেমন– বংশগত বা জিনগত কারণ, শারীরিক অসুস্থতা, মাদকাসক্তি, মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণ, হঠাৎ ভয় পাওয়া, মানসিক উদ্‌বেগ, অপ্রাপ্তির বঞ্চনা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, হতাশা, আবেগের আধিক্য, প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক কলহ, পরিবেশগত কারণ, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ইত্যাদি।

জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ প্রযোজনায় যে জরিপ হয়েছে, সেখানে দেখা গিয়েছে, তরুণদের মধ্যে মানসিক সমস্যায় আক্রান্তের হার ১৩ ভাগ। বয়স্কদের হারও কম নয়। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে অন্তত ৩ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় আছেন বা মানসিক রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন মানসিক রোগে ভুগছেন। এ হার প্রতিদিন বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের প্রায় ১৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ১৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা গিয়েছে। অথচ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বিপরীতে আমাদের চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র এক হাজার। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

মানসিক রোগীদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা দেয় তা হলো: রাতে ঘুম কম হওয়া, খিটখিটে মেজাজ, হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, খাবারে অরুচি, অতিরিক্ত ইগো, একাকীত্ব অনুভব, কথা কম বলা অথবা বেশি বলা, সন্দেহ প্রবণতা, নিজের প্রতি উদাসীনতা, শুচিবায়গ্রস্ততা, কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, সব কিছুর প্রতি অমনোযোগিতা, বিষণ্ণতায় ভোগা, আত্মহননের চিন্তা ইত্যাদি। তবে সব অস্বাভাবিক আচরণ মানসিক রোগ নয।

তরুণদের বিষণ্ণতা একটি মারাত্মক মানসিক রোগ। কেউ দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকলে তাকে অবশ্যই চিকিৎসার আওতায় নিতে হবে। মানসিক রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বড়ো অসুবিধা হলো রোগী কিছুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না। সেক্ষেত্রে পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। কারো মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণগুলো দেখা দিলে প্রথমেই মনোবিদদের সহযোগিতা নিয়ে কাউন্সিলিং থেরাপির মাধ্যমে এসব রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা যেতে পারে। তাতে সমস্যার সমাধান না হলে ডাক্তারি চিকিৎসা(medical therapy) অর্থাৎ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যদিও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমাদের হাতের কাছে খুব কমই পাওয়া যায়। তবে অনলাইন মাধ্যমেও মানসিক রোগের চিকিৎসা সেবা পাওয়া সম্ভব।

বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতায় বিষণ্ণতা, প্রিয়জন বিয়োগের বিষণ্ণতা এবং ভর্তিযুদ্ধে লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারার হতাশাও তরুণ সমাজের মানসিক রোগের একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তরুণদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। যার ফলে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। আসলে যে-কোনো ব্যর্থতাই মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য। তবে এটাও ভাবতে হবে যে ব্যর্থতা মানেই সব শেষ হয়ে যায় না। প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। ব্যর্থতাকে জয় করেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। তবে ব্যর্থতা থেকে ভুলে থাকবার জন্য দুশ্চিন্তা, মাদক সেবন, অন্যের প্রতি রাগ পোষণ করা, হতাশায় ভোগা এসব থেকে দূরে থাকতে হবে। মানসিকভাবে ইতিবাচক হতে হবে। নিজের ভালোলাগার কাজগুলো করতে হবে। যেমন-বই পড়া, গান শোনা, সাংস্কৃতিক কাজকর্মে অংশ নেওয়া, ব্যায়াম করা, হাঁটা, খেলাধুলা, ধর্মচর্চা, কবিতা পড়া, ছবি আঁকা, লেখালেখি ইত্যাদি সৃজনশীল কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখে ব্যর্থতার চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব। কোনোভাবেই হতাশাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তরুণ সমাজের প্রতি একান্ত আহ্বান জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে জীবনের পথে। মনে রাখতে হবে জীবন সরলরেখা নয়। জীবনে অনেক চড়াই -উতরাই আসবে। তা মোকাবেলা করেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।

তারুণ্যের অবস্থানটা অনেকটা জীবনকালের সেতুর মতো। যা শৈশব ও কৈশোরকে মধ্যবয়স এবং বয়োজ্যেষ্ঠ কালের সঙ্গে সংযুক্ত করে। ব্যক্তির জীবনকালে তারুণ্যের জোরালো একটা ভূমিকা রয়েছে। অনেক চাপ নিতে হয় এই সময়ে। তাই তরুণদের উচিত মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিয়ে সুস্থভাবে নিজেকে গড়ে তোলা। 

সেই সাথে মোবাইল ফেসবুক ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বেই করতে হবে। যে-কোনো পদ্ধতিতেই হোক সেটা করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করাতে সন্তানদেরকে অবশ্যই প্রযুক্তির সুবিধা দিতে হবে, তবে তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মা-বাবার হাতে থাকতে হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তরুণ সমাজকে এই মারাত্মক সমস্যা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। রক্ষা করা যেতে পারে আত্মহননের মতো মরণঘাতী ঝুঁকি থেকে।

শীলা প্রামাণিক

সহকারী অধ্যাপক (মনোবিজ্ঞান বিভাগ)