ছোটবেলার ইদ ও রোজা/হুমায়ুন কবীর

আমাদের ছোটকালটা অভাবের কাল ছিল। গাঁ- গ্রামের মানুষের ঘর-বাড়ি, পোশাক – পরিচ্ছদ আর খাদ্য- খাবারে প্রাচুর্যের লক্ষণ দেখা মিলতো না। চাওয়া – পাওয়ার ব্যবধান ছিল বিস্তর । তবু ইদের দিনে দেখেছি অভাবকে ছাপিয়ে আনন্দ উপচে পড়ছে।দেখেছি উৎসবের দাবিটা প্রাণ – প্রাচুর্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ভর রমজান জুড়ে থাকতো ইদের আগাম আনন্দ —- ইদ আসছে…ইদ আসছে এমন একটা বোধ । ইদ যত এগিয়ে আসে ইদের আনন্দ তত বড়ো হয়ে আসে। একরাশ পবিত্র অনুভূতিতে ছেয়ে যায় মন।

সেসময় প্রাপ্তবয়স্ক সবাই যে রোজা রাখতো তা না।তবে রোজা থাকুক চাই না থাকুক রোজার মাসকে সবাই শ্রদ্ধা করত। চায়ের দোকানের প্রবেশ পথ কাপড় দিয়ে ঘেরা থাকত। মাইকে গান – বাজনা বন্ধ থাকত । দেখতাম রোজাদারদের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ কিন্তু কেমন যেন পবিত্রতার ছোঁয়া! এটা বোধহয় ইবাদতের সৌন্দর্যের বাহ্যিক প্রকাশ। বাড়ির ছোট বড় সবাই ইফতার সামনে আজানের অপেক্ষায় বসে আছে —- কখন মুয়াজ্জিন বলে উঠবে — আল্লাহু আকবার .. আল্লাহু আকবার— অমনি একগ্লাস শীতল জলে কণ্ঠ ভেজাবে!

এখনকার মতো গ্রামে – শহরে ইফতার পার্টির ছড়াছড়ি তখন দেখিনি। বাড়ি – বাড়ি নানা পদের থালা ভর্তি ইফতার সামগ্রী? না, এগুলোও না—- বাড়ির গাছের পেঁপে- কলা, একটু চিড়া ভিজা আর আখের গুড় দিয়েই সারা হতো ইফতার।
আমাদের ছোটোবেলায় গ্রামে গ্রামে কেবল বিদ্যুৎ আসা শুরু করেছে— সব গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি।মুখে আজান আর কত দূর পৌঁছে? বাড়ির ছোটরা মসজিদের নিকট এগিয়ে আসতো। আজান শুনে দৌড়ে গিয়ে বড়োদের বলত, হ্যাঁ, আজান হচ্ছে।
মসজিদে মাইকের ব্যবহারটাও বিদ্যুৎ আসার সমবয়সী । অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকতো না— আজানের শব্দে কান পেতে থাকতে থাকতে বিলম্ব হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে,কেউ কেউ মুরগি ঘরে ওঠা দেখে ইফতার করে ফেলত।মেঘলা দিনে বেশ সমস্যাই হতো।

তারাবি নামাজ যে সবাই পড়তো তাও না।মা- চাচিরা কোন এক বাড়িতে জামাত করে পড়তেন।
রোজার রাতে কোন কোন যুবক অথবা মধ্যবয়সী ধার্মিক মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি করতেন। কোন কোন মহল্লায় টিনের পাত্রে শব্দ করে চলতো এই ডাকাডাকি । মাইক আকৃতির টিনের চোঙ মুখে লাগিয়ে ডাকতেন—-“রোজাদার ভাই ও বোনেরা উ..ঠু…ন,সেহরি খেয়ে নিন, সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে।সুর করে ছান্দসিক উচ্চারণে বলতেন
:”ঘুম ছেড়ে সেহরি খেতে ওঠো মুমিন ভাই
সেহরি খাবার সময় তো আর বেশি বাকি নাই।”
কেউ বা ডাকের মাঝে হামদ – নাত গেয়ে শোনাতেন। কবি নজরুলের ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’…, ‘রসুল নামের ফুল এনেছি রে’…
, ‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি’… এরকম সংগীতগুলো বেশ মনে পড়ে। গভীর রাতে অধিক ডাকাডাকিতে অনেকের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত। কেউ কেউ বিরক্ত হতো।

রোজার শেষের দিকে ফিতরা বিতরণ ; গরিবদের হাতে কিছু অর্থ আসছে। তারা খুশি।আশা, অন্য দিনের তুলনায় ইদের দিনটা ভালো যাবে।
সামর্থের সাথে মিল রেখে দর্জিবাড়ি জামা-কাপড়ের অর্ডার পড়ত। নিশ্চয় সব পরিবারে না; হতদরিদ্র পরিবারে পুরাতন চলমান পোশাকেই চলতো ইদ- উৎসব। বাবা-মায়েরা নিজেরা তেমন পোশাক তৈরি করাতেন না বললেই চলে। তারা সারাজীবনই উদার— ছেলে মেয়েদের সুখ কিনতে নিজেদের সুখ বিক্রি করে দেন।
রোজার ইদের চাঁদ দেখাটা অন্যরকম আনন্দ ছিল। কেউ মাঠের দিকে ফাঁকা জায়গায়, কেউ বা একটা উঁচু কোথাও উঠে পশ্চিম আকাশে খুঁজে ফিরতো সাধের চাঁদ।গ্রামে দালান বাড়ি খুবই কম ছিল।আমাদের গ্রামে আমার মেজ দাদার আর জমিদারদের দ্বিতল ভবন ছিল।আমরা দাদার দোতালায় উঠে মহানন্দে চাঁদ দেখতাম।আকাশের চাঁদটা কে আগে আবিষ্কার করতে পারে এই প্রতিযোগিতা চলতো। কেউ দেখতে পেলে সে কী আনন্দ! পাড়ার মধ্যে আমার আব্বার রেডিও ছিল; টিভি তখনও গ্রামে কেউ কেনেনি। ইদের আগের সন্ধ্যায় রেডিওতে বেজে উঠতো নজরুলের সেই অমর গান:ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ… কী যে ভালো লাগতো!

গানটার সব বাণীই অসাধারণ —- শ্রবণে হৃদয়টা যুগপৎ আনন্দ আর উদারতায় ভরে উঠতো।”তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে,আসমানী তাগিদ।তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ। দে জাকাত,মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ.. .
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত- দুসমন,হাত মেলাও হাতে—–” গানের এইসব বাণী শুনে মনটা অন্য পাঁচ দিনের তুলনায় উদারতায় ভরে উঠত ।বন্ধু- প্রতিবেশীদের সাথে দীর্ঘদিনের বিবাদ অজান্তেই প্রশমিত হতো।

গ্রামে ঈদগা কমিটি ছিল। মসজিদে স্বল্প পরিসরে কমিটির সভা বসতো।সময় নির্ধারণ হতো। গ্রামের অতি উৎসাহী যুবক বা মধ্যবয়সী কেউ কেউ মসজিদের মাইকে —” ইদ মোবারক, জিন্দাবাদ ” ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলতো।কমিটির সেক্রেটারি গোছের কেউ একজন প্রচার দিত:” প্রিয় গ্রামবাসী,আচ্ছালামুয়ালাইকুম। আগামীকাল ইদ – উল- ফিতর– ইদ মোবারক। -আগামীকাল ইদের জামাত শুরু হবে সকাল সাড়ে আটটায় ।”

শ্যাম্পুর ব্যবহারটা তখনও দেখিনি। সকালে সাবান মেখে গোসল করার ধুম পড়ে যেতো। নদী তীরের মানুষগুলো নদীতে স্নানে যেতো। কেউ পুকুরে ,কেউ বা কলের পাড়ে লাইন দিত। কলের পাড়ে সাবান মাখা চলছে,মায়েরা নিজহাতে ছোট ছেলে মেয়েদের গোসল করিয়ে দিচ্ছে— সেই সুদূর ছোট বেলায় চোখ ফেরালে এইসব ছবি ভেসে ওঠে। এখন দেখি সেই শিশুদের শুভ্র – কেশ ; কুঞ্চিত চর্ম ; আর সেই মা- চাচি আর দাদিরা অধিকাংশই মৃত্তিকাবাসে স্থিত। স্মৃতি বড় সুখের, স্মৃতি বড় বেদনার।তবে বড়দের স্মৃতি প্রকোষ্ঠে বেদনা বেশি।

সেকালে নিকট বাজারে গরু- ছাগল জবেহ তেমন হতো না। গ্রামে কারও বাড়িতেই রেফ্রিজারেটর ছিল না।সকালে কেউ কেউ বাজার থেকে মাংস কিনে আনতো। মাংস কিনে ফিরতে অনেক সময় দেরি হয়ে যেত, ইদের জামাত ফেল করতো। নিম্ন আয়ের মানুষেরা বাড়িতে পোষা মোরগটা জবেহ করে ইদ উৎসব পার করে দিত।
এভাবেই সাধ্যের ভিতরে বাবারা ছেলে মেয়েদের মুখে একটু ভাল খাবার তুলে দেবার চেষ্টা করতো।
সেইসব বাবাদের প্রিয়মুখ আজ আর নেই। এখন বয়স্কদের ইদ উৎসবের মধ্যে স্মৃতি হয়ে তারা ঢুকে পড়ে।মনে করিয়ে দেয় এ জগত মায়াময়, এ সংসার ক্ষণিকের। তাই বয়স্কদের কাছে ইদ কিছুটা আনন্দের,কিছুটা বেদনার।

বিশ্বকর্মার চাষ থেমে থাকে না।কালের আবর্তে তিঁনি নতুন মুখ পাঠান। সেদিনের শিশু আজকে আমরা কেউ পিতা , কেউ মাতা।ঘরে ঘরে নব প্রজন্মদের সাথে আমাদের বয়স্কদের চলে ইদ—সময়ে মনে হয় যেন– “পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গেছে নব প্রেমজালে।” পরক্ষণেই মনে হয়, না,তা বোধহয় না; সত্যি এই যে, আনন্দের দিনে চলে যাওয়া প্রিয় মানুষগুলো অশরীরী অস্তিত্ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় বলে, “একদা আমরাও ছিলাম”। অনেক দিন আগে চলে যাওয়া কারও মুখ ভেসে ওঠে।সে যেন বলে—“যদি পড়িয়া মনে —-ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে — তবু মনে রেখ। “

মায়ের হাতের সেমাই খুব মজা।নতুন পোশাক, চোখে সুরমার প্রলেপ,মাথায় টুপি— এমনি ইদের সাজ।আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, অনুগ্রহ করে তিঁনি দিয়েছেন এই আনন্দ। জায়নামাজ হাতে বাইরে বেরিয়ে পড়ি। বাড়ি- বাড়ি খোঁজ করি– কে বেরুলো,কার কত দেরি? বাবা- চাচা আর দাদা — তিন প্রযন্মের মানুষ একসাথে ইদগাহে যাওয়া । নানাজন মিশে যায় পথের স্রোতে। দলবেঁধে চলা— মুখে তাকবির— ” আল্লাহর হামদ। সে এক স্নিগ্ধ দৃশ্য। সবার চোখেমুখে পবিত্রতার আভা। ইদগা – প্রবেশ পথে ভিক্ষুকের সারি। এইদিনে সবার মন ভালো তাদের দু’পয়সা দিয়ে মাঠে প্রবেশ।
ইদগার খোলামাঠে নামাজের আনন্দই অন্যরকম। সবাই মহান আল্লাহর দরবারে মাথানত করছে,রুকু- সেজদায় তাঁরই পরিত্রতা আর মাহাত্ম্য ঘোষনা করছে, উচ্চারণ করছে সামি আল্লাহ লিমান হামিদা, রাব্বানা লাকাল হামদ।নারায়ের তাকবির, আল্লাহ আকবর ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আকাশে- বাতাসে। সকলে ইমাম সাহেবের আবেগী খুতবা শুনছে , ইহকাল – পরকালের কল্যাণ কামনা করছে।এক আল্লাহর দরবারে মুসলিমদের সামষ্টিক এই প্রার্থনা সত্যিই অনন্য।
সবশেষে কোলাকুলি, হাতে হাত মেলানো ; দলে দলে বাড়ি ফেরা। আমরা ছোটোরা বড়োদের সালাম করছি,দোয়া নিচ্ছি আর বাড়ি – বাড়ি সেমাই খেয়ে ফিরছি — দারুণ খুশি খুশি ভাব।

ইদের দিন বিকাল । মিষ্টি নিয়ে কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে।মসজিদ প্রাঙ্গণে শিরনী চলছে।নতুন লুঙি- গেঞ্জি পরে কেউ কেউ বসে মাচায় গল্প করছে। চোখে সুরমা। একটা পবিত্র- পবিত্র ভাব।খুব কাজের মানুষটারও আজ অবসর। কেউ মাঠেঘাটে যাবে না — আত্মীয় – বন্ধুদের নিয়ে কাটাচ্ছে দিনটা।গল্পে- আলাপে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গ্রামের যে ছেলেটা বাইরে পড়ে বা চাকরি করে,সেও যোগ দেয় এই বৈকালিক আসরে,এর – ওর সাথে কুশল বিনিময় করে। অবশেষে বিকেলের আলো ম্লান হয়ে সন্ধ্যে নামে।মসজিদ থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আজান— আল্লাহু আকবার,আল্লাহু আকবর…।একটা মায়া এসে গ্রাস করে— আবার কবে আসবে এই দিন? আমাদের মনের অনুভূতিটা কবি নজরুল ধরেছেন এভাবে :
যাবার বেলায় সালাম লহো
হে পাক রমজান
তব বিদায় বেলায় কাঁদিছে
নিখিল মুসলিম জাহান।
আবেগের সাথে আনন্দের একটা যোগসূত্র আছে। আমাদের বয়স হয়েছে,আবেগে ভাটা পড়েছে।।আমরা আর আগের মতো শিহরিত হই না, পুলকিত হই না। নতুন পোশাকটা ইদের আগে কাওকে দেখাব না,লুকিয়ে রাখবো — এই মন আর নেই।তবে হ্যাঁ,নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার আসমানি তাগিদটা ভেতরে- ভেতরে অনুভব করি। জানি না, আমরা কি তা পারছি ?