বই আলোচনা : মোজাফ্ফর হোসেনের অতীত একটা ভিন দেশ

“মোজাফ্ফরের গল্পে নির্মান বলে কিছু নেই- সমস্ত বিষয়টি ভেঙ্গেচুড়ে দিয়ে যা তিনি সৃষ্টি করে উঠেন, তা যেন অস্তিত্বহীন একটি অবয়ব। অবয়বটিও যেন বায়বীয়-স্বপ্ন আর ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখা বাস্তবের প্রায় বিলীয়মান বাস্তব।“ মোজাফ্ফর হোসেন ও তার গল্প সম্পর্কে এমনটাই বলেছেন কথাসাহিত্যিক জাহানারা নওশিন।

আজ আলোচনা করছি বর্তমানের সময়ের প্রতিভাবান লেখক মোজাফ্ফর হোসেন এর গল্পগ্রন্থ অতীত একটা ভিনদেন। লেখকের স্বত্বে রাখা বই অতীত একটা ভিনদেশ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাসে অমর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে। বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলা বাংলা প্রকাশন। বইয়ের সাথে দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদ করেছেন হালের অন্যতম জনপ্রিয় প্রচ্ছদ শিল্পী চারুপিন্টু। দুইশত বিশ টাকা মুল্যমানের বইয়ের পৃষ্টা সংখ্যা একশত আটাশ।

মোজাফ্ফর হোসেন কোন প্রকার ভুমিকা ছাড়াই গল্প শুরু করেন, কিন্তু শেষ করার কোন গল্প থাকেনা। গল্পের শুরুতেই শেষের দিকে কি হবে এর কোন ধারনা পাওয়া যায়না। কেননা মোজাফ্ফর হোসেন গল্পটা শুরুই করেন কিন্তু শেষ করেন না। গল্প শুরু করেন মাঝখান থেকে এরপর বয়ান করতে করতে হঠাত করেই গল্প কোন একদিকে চলে যায়, সবশেষে এমন এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয় যখন মনে হয় এরপরও গল্পের আরো বেশ কিছু অংশ বাকী রয়ে গেছে। যে গল্পটা লিখতে চেয়েছেন সেটা আর পুর্ণতা পায়না। নতুন এক গল্পের অবতারণা হয়। এছাড়া গল্পে উত্তম পুরুষের ব্যবহারে বেশ চমতকার ভাবে কত্থকের ভুমিকা পালন করে গেছেন গল্পকার মোজাফ্ফর হোসেন।

বাঁশিওয়ালা মজ্জেল গল্পে মজ্জেলের সাথে লেখকের দেখা হয় পনের বছর পরে। দেখা হয় কথা হয়। যদি মজ্জেল বেঁচে থাকত তাহলে হয়তো এই কথা গুলোই হতো। পাঠকের কাছে মজ্জেল মৃত। পনের বছর পরে ফিরে আসা মজ্জেল কিন্তু কত্থকের কাছে বর্তমান। ফলে যে কারণে মজ্জেল হারিয়ে গিয়েছিল তার কারন কত্থক জানিয়ে দিতেই সম্ভবত মজ্জেলকে ফিরিয়ে আনেন লেখক। “এখন বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন, কত গান বাজনা হয়, অথচ বাঁশি বাজানোর অপরাধে তোমাকে গ্রামছাড়া হতে হলো।“ এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু পাঠকের মনে প্রশ্ন থেকেই যায় পনের বছর পর মজ্জেলের সাথে লেখকের দেখা হলো কি করে? সে ফিরে এলো কিভাবে? উত্তর পেতে হলে আরো গভীরে যেতে হবে। হতে পারে বিষয়টা অতিপ্রাকৃতিক অথবা এতে রয়েছে নিগুঢ় কোন দর্শন অথবা পাঠকের জন্য ভাবনা ভাবান্তর ঘটানোই লেখকের উদ্দেশ্য।

ভ্যদা কবির প্রস্থান গল্পটিও অনেকটা এমনই। ভ্যদা কবি যিনি নিজেকে কবি মনে করেন। অথচ তার কাব্য কেউ দেখতে পায়না। কালে ভদ্রে দু চার লাইন শোনার সুযোগ হলেও তাকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও ভ্যদা কবি হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠে। ভ্যদা কবির দর্শন বড় চমতকার। সে কবিতা লিখে জলে, কবিতা লিখে মনে মনে, কবিতা মানেই মনের ভিতর কবিতা চাষ। ফসল মানেই উজাড়। সে ভিতরে কবিতা নিয়ে আউরায় আর কেউ চেপে ধরলে দু চার লাইন শোনায়। তার মনে কবিতা গড় গড় করে বলে যাওয়ার বিষয় নয়। অনেক সাধনা করে তবেই কবিতা লিখতে হয়।ভ্যদা কবির বরাত দিয়ে লেখক বলেছেন,” কবিতা হলু রান্না করার মতোন। শুধু তরকারি সেদ্ধ করলি কি স্বাদ জমে? মসল্লা দিতি হয়না?কাব্যেরও তেমন মসল্লা লাগে। তরকারি যেমন দেখলি হয়না, চেকি বুঝতে হয়, তেমনি কাব্যও খালি শুনলি বা পড়লি হয় না, বোধ দি অনুভব করতি হয়। সেই বোধ আমি তোমাদের কেমুন করি বিলাই, কওতো?

চারিপাশের পরিবেশ আর মানুষের মনস্তাত্বিক বিষয় নিয়ে লেখক মোজাফ্ফর হোসেনের পর্যবেক্ষন বেশ পরিস্কার। একটা কুকুর তার সাথীর মৃত্যুতে বেদনা সিক্ত থাকে বছরের পর বছর। সে যেখানেই যাক, যে যা কিছুই খাবার দিক তাতে সে ঘুরে ফিরে প্রাইভেট কার দেখলেই আক্রমনের জন্য দৌড়ে যায়। সে ভুলেনা দু বছর আগে এখানেই প্রাইভেট কারের চাপায় তার সঙ্গিটি মারা গিয়েছিল। এই গল্পে বিদেশের প্রতি আমার দেশের মানুষের একটা অলীক কল্পনা আছে, অহেতুক আগ্রহ আছে যা কিনা শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও বিদ্যমান, এই বিষয়টি বেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিদেশ বিলাসী অধ্যাপক রেজাউল করিম যেন পুরো বাংলাদেশের মানুষের প্রতিচ্ছবি।

মোজাফ্‌ফর তার নিজের গল্পের প্রতি যথেষ্ট সচেতন। নিজের লেখা আর পারিপার্শিক সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে বেশ খোজ রাখেন। নিজের প্রতি তার মুল্যায়নও যথেষ্ট স্পস্ট। মোজাফ্ফর হোসেন তার অগাধ আত্নবিশ্বাস থেকে নিজের সম্পর্কে মুল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন,” আমার কাছে আমার সাহিত্য ভাবনা আর গল্পভাবনা আলাদা কিছুনা। আমার গল্পে আমার সামগ্রিক সাহিত্য ভাবনারই প্রতিফলন ঘটে। আমাকে আমার গল্প ভাবনার কথা বলতে হলে সেটি সাহিত্য ভাবনা দিয়েই শুরু হবে। আমি হয়ত খুব চিহ্নিত করে কিছু বলতে পারবোনা। তবে আমি আমার শিকড়ের কাছে ফিরে গিয়ে, আমার সাহিত্য- ঐতিহ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত পুর্ণ করে তুলতে পারব- এইটুকু বিশ্বাস রেখে শুরু করছি।“

এছাড়া গল্প লেখার ব্যপারে পাঠকের ভাবনাকে লেখক নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন। কিভাবে গল্প লিখেন এমন সহজাত প্রশ্নের উত্তরে মোজাফ্ফর হোসেন বলেন,” আমি যখন লিখতে শুরু করি, দেখা যায় অধিকাংশ গল্পই লিখতে লিখতে বাঁকবদল করে ভিন্ন একটা গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথ্যার্ত যে গল্পটা লিখবো বলে শুরু করেছি, শেষ পর্যন্ত আর সেই গল্পটা লেখা হয়ে উঠেনি। অনেকগুলো পথের মাঝখানে এসে আমি অন্য পথে চলে গেছি। এভাবেই না লিখতে পারা গল্পটার অতৃপ্তি আমাকে নতুন গল্পপথে চালনা করেছে।“ লেখকের স্বতর্স্ফুত স্বীকারুক্তির সত্যতা তার প্রতিটি গল্পেই পাওয়া যাবে।

সমকালীন বিষয় নিয়ে মোজাফ্ফর হোসেন বেশ সচেতন। চারিপাশের দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোকে তুলে এনেছেন একটি গল্পের মাধ্যমে। তুলে এনেছেন আমাদের মিডিয়া থেকে শুরু করে সুবিধাবাদী প্রতিটির চরিত্রের জেরক্স কপি। গল্পের নাম লাশটি জীবিত বাকিরা মৃত। একজন নির্মান শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে পা পিছলে পরে বাঁশের সাথে গেথে মারা যায়। পরিবারে উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিটি এখন হৃদস্পন্দনহীন অবস্থায় ঝুলে আছে। পরিবারটি অপেক্ষায় আছে লাশটাকে নামিয়ে দিলে তারা সেটা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। তাদের কাছে লাশটার সতকার করা একটা দায় আবার এই লাশটি জীবিত থাকার সময় যাদের দায়িত্ব নিয়েছিল তারা এখন কার দায়িত্বে যাবে তারও একটা দায় এসে শূণ্যে বর্তায়। এই পর্যন্ত হলে ভালই হতো। কিন্তু গল্প নাটকীয় ভাবে মোড় নেয় যখন একটা ছেলে প্রেমিকার সাখে ডেটিং শেষে একটু আড়ালে প্রাকৃতিক কাজে সাড়া দিতে এসে লাশের সাথে দেখা হয়ে যায়। সাথে সাথেই সেলফি তোলে সামাজিক সাইটে দিয়ে দেয় এবং নিজেকে অনলাইন এক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে। আধুনিকতা আর রাজনীতির কল্যাণে লাশের মুল মালিকেরা আড়ালে হারিয়ে যায় সামনে চলে আসে লাশের আবিস্কারক হিসেবে সেই কথিত অনলাইন এক্টিভিস্টের নাম। মুল নায়ক হয়ে উঠে সেই ছেলে। এছাড়া এখানেই শেষ হয়না গল্পটি। সময়ের প্রয়োজনের মুক্তিযুদ্ধের কথা আসে। আসে পরবর্তি সময়ের কথা। এলিট ফোর্স র্যবের কথাও। কেন আসে?পাঠক মনোযোগ দিলে এক গল্পে পুরো বাংলাদেশের মানুষের হুজুগ আর আইনি জটিলতা কিংবা সামগ্রিক একটা ধারণা পেয়ে যাবে।এরপর কি হয়? আরো জানতে হলে গল্পটা পড়তে হবে। কেননা বিভিন্ন কারণে এই গল্পটি অন্যতম হয়ে উঠে এই বইতে।

প্রতিটি গল্পেই লেখক নিজের লেখনীতে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করলেও চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিকতা এনেছেন। গল্পে প্রতিটি চরিত্র সাবলিল এবং কখনো কোন চরিত্র প্রয়োজন ব্যতিরেকে টানা হয়েছে বলে হয়নি। সংলাপের ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে ধন্যবাদ দিতে হয়ে মোজাফ্ফর হোসেনকে। বিশেষ বিশেষ সংলাপ চরিত্রের মুখ থেকে সংলাপগুলো বের হয়ে এসেছে দর্শনের চুড়ান্ত মাত্রা হিসেবে। মোজাফ্ফর হোসেনকে এক্ষেত্রে সফল বলা যেতে পারে।

“একা মানুষের আবার দ্যাশ কিসের রে? মাটির তলে কোন বাউন্ডারী আছে!কুনু বানচোত এটা বোঝেনা”-(যেখানে যুদ্ধের কোন বিকল্প ছিল না।)

“আল্লাহ আর ভগবান এক আকাশেই থাকেন, সমস্যা যত সব মাটিতেই”- (একটি নদীর গল্প)
“আমি যন্ত্রের মতো বুড়ো আঙ্গুলটাকে সর্দার বানিয়ে বাকি আঙ্গুলের গেরোগুলো ছুয়ে দিই।“ অথবা”যদি ঘর বাইরে থাকে তাহলে কারই বা ঘরে ফিরতে মন চায়! আমার কেবলই মনে হয় আজ শেষ ক্লাসটা দীর্ঘ হোক।”–(কেবল কথা বলতে চেয়েছিলাম।)

“পেটের কাছে প্রহরায় থাকা শাড়িটা ডিউটি ছেড়ে খানিক সরে দাড়ায়-(মৎসজীবন)

আমার মনে বিশেষ ভাবে দাগ কেটেছে লিখতে না পারা গল্পটা। আত্নহত্যা বলে শ্রুত মেয়েটি স্বপ্নে চলে আসে লেখকের কাছে। এখানে একটা ভিন্নতা এনেছেন লেখক। আগের দুটো গল্পে বাস্তবতার মত করেই মৃত লোকদের সাথে দেখা হলেও এখানে মেয়েটি আসে স্বপ্নে। স্বপ্নে এসে প্রতিবারই তাকে নিয়ে গল্প লেখার তাগাদা দেয়। সবাই যার মৃত্যুকে আত্নহত্যা বলে জানে আসলে সে আত্নহত্যা করেনি। তাকে খুন করা হয়েছে। লেখকের কাছে অনুরোধ নিয়ে এসেছে যেন তার এই গল্পটা লেখা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গল্পটা আর লেখা হয়ে উঠেনি। তাহলে পাঠক কি পড়েছেন? প্রশ্নের উত্তরটা গল্পের ভিতরেই পাওয়া যাবে তবে পাঠককে আরো একবার ভেবে নিতে হবে।

মোজাফ্ফর হোসেন এর অতীত একটা ভীন দেশ বইতে স্থান পেয়েছে মোট ১৪ টি ভিন্ন ধারার অভিন্ন গল্প। বাঁশিওয়ালা মজ্জেল, একটা কুকুর অথবা একজন কবির গল্প, ভ্যদা কবির প্রস্থান কবিতা, লাশটি জীবিত, বাকীরা মৃত, ঘুম পাড়ানো জল, একটা নদীর গল্প, যেখানে যুদ্ধের বিকল্প ছিলনা, না লিখতে পারা গল্পটা, খোয়াব, জীবনটা গল্পের অখবা মরীচিকার, মৎস্য জীবন, কেবল কথা বলতে চেয়েছিলাম, সুখ-অসুখ এবং ছুঁয়ে দেখা জীবন। প্রতিটি গল্পেই লেখকের লেখক স্বত্ত্বার স্বকীয়তার প্রমান মিলে। লেখক বা লেখনি নিয়ে মুল্যায়ন করছিনা বা সেই ইচ্ছাও আমার নেই। আমি কেবলমাত্র পাঠক হিসেবে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছি মাত্র। লেখকের ভাবনা পাঠকের কাছে পৌছানো অব্দি নানান প্রতিবন্ধকতার সীমা পার হয়। পাঠকের গ্রহন ক্ষমতাও এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ফলে লেখা ভাল কি মন্দ সেই বিচারকার্য পাঠক ভেদে ভিন্ন হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রকাশিত বইয়ের সব গুলো গল্পই পাঠকের ভাল লাগবে। তবে দু একটি হয়তোবা কারো কারো বিচারে এদিক সেদিক হয়ে যেতে পারে।

সবশেষে জ্যতিপ্রকাশ দত্তের একটি মুল্যায়ন দিয়ে শেষ করছি। তিনি মোজাফ্ফর হোসেনের গল্প নিয়ে মুল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন। “ মোজাফ্ফর এর গল্পের আপাত সরল কাঠামো, সাবলীল বর্ণনা ভঙ্গী পাঠকে দ্রুত গল্পের ভুবনে প্রবেশ করিয়ে দেবে যদিও সামান্য সময় পার হলেই তিনি পার হবেন নানান সম্ভাবনার, বহুকৌনিক গল্প জগতের। সচেতন পাঠক সেটিকে পরাবাস্তব, যাদু বাস্তব বা অতি আধুনিক গল্পের জগত- যে নামেই চিহ্নিত করুকনা কেন গল্পের পাঠতৃপ্তি কি পাঠ্যযোগ্যতা বিন্দুমাত্র ব্যহত হয়না তাতে।“

–লুৎফর রহমান পাশা

মন্তব্য করুন