নাবিলেরবন্ধু/সুদীপ দাস

                                      

                                                        

ভীষণ রাগ উঠে ঐশির। কখন থেকে ডাকছে। তবুও ছেলেটার উঠবার নাম নেই।এদিকে স্কুলে যাওয়ার সময় বয়ে যাচ্ছে।
-এই নাবিল, উঠবি না বাপ? উঠ বলছি। আরও দেরী করলে গায়ে পানি ঢেলে দেবো দেখিস।
মায়ের ডাকে নাবিলের সাড়া দেওয়ার কোন লক্ষণ নেই। এবার ঐশির জেদ চেপে যায়।নাবিলের পা ধরে টেনে বিছানা হতে অর্ধেক নামিয়ে দেয়। নাবিল হাই তোলে।পিটপিট করে ঐশির দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসে।আর তাতেই ঐশির সমস্ত রাগ পানি হয়ে যায়।
-আম্মা,কয়টা বাজলো?
-নয়টা।
ঐশি উত্তর দেয়।
-বারে,আরও আগে ডাক দেবেনা? স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে।
নাবিল ঐশিকে বলে।
-কুম্ভকর্ণের মত ঘুমালে এমনই হবে তোর।
ঐশি নাবিলকে তুলে দিয়ে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে। নাবিল পড়িমড়ি করে বাথরুমের দিকে ছুট দেয়।বাথরুম থেকে ধুরুম-ধারুম শব্দ ভেসে আসে।ঐশি চেঁচিয়ে নাবিলকে সাবধান করে দেয়।

নাবিল মোসাদ্দক আর ঐশির একমাত্র সন্তান।দশম শ্রেণীতে পড়ে। পড়াশুনায় অত্যন্ত তুখোড় নাবিল।তবে সমস্যা হলো সে কারও সাথে তেমন একটা মেশেনা।ঐশি নাবিলের এই স্বভাবে বেশ চিন্তিত।তাই গল্পে গল্পে জানবার চেষ্টা করে,নাবিলের বন্ধু কয়জন।তাদের বাড়িতে আনেনা কেন।অপরদিকে নাবিলের ঘুরে ফিরে উত্তরগুলো একই ধরণের-লাইব্রেরী স্কুল আর প্রাইভেট পড়া।বাড়ি ভর্তি গল্পের বই নাবিলের।জাফর ইকবালের লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত সে।ওর আব্বার উৎসাহেই বাড়িতে নাবিল গল্পের বইয়ের পাহাড় তৈরি করেছে, ঐশি তা জানে।এই নিয়ে মোসাদ্দেকের সাথে প্রায়ই ঐশির লেগে যায়।মোসাদ্দেককে সে বোঝানোর চেষ্টা করে,-এত গল্পের বই সামনে থাকলে পড়ার বইয়ে মনযোগের ঘাটতি থাকবে। মোসাদ্দেক তখন বড় বড় চোখ করে ঐশির দিকে তাকায় আর বলে,-নাবিল কোন বিষয়ে কম নম্বর পেয়েছে কিনা ?তখন ঐশির আর কিছু বলার থাকে না।তবে করোনার এই অদ্ভুদ সময়ে ঐশি বুঝতে পেরেছে যে নাবিলের আব্বাই সঠিক ছিল।প্রায় এক বছরের উপর স্কুল বন্ধ ছিল। প্রতিবেশী ছেলে-মেয়েদের কত রকম সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে।কত ধরণের আসক্তির কথা শোনা যাচ্ছে।কিন্তু নাবিল? পড়ার বই আর গল্পের বইয়ের মধ্যেই ওর ছোট্ট জগৎ সাজিয়ে নিয়েছিল।বেশ সুন্দরভাবে করোনাকালীন বন্ধ সময় পার হয়ে এলো।

বেশ জোড়েই সাইকেল চালাচ্ছিল নাবিল।একটু বেখেয়াল ছিল বুঝি।ধরাম করে আর একটি সাইকেলের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দেয়।দুই সাইকেল চালকই সটান ভূমিতে।নিজের সাইকেল উঠিয়ে অপর আরোহীকে উঠতে সাহায্য করে।অপর জন নাবিলেরই বয়সী।ছেলেটির স্কুল ব্যাগ ছিঁড়ে গিয়েছে।বই-খাতা সব রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে।তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে নাবিল তার বই-খাতাগুলি গুছিয়ে দেয়।বইগুলির মধ্যে একটি গল্পের বইও ছিল,নাবিল দেখে বইটি কাকনডুবি।জাফর ইকবালের লেখা।
-ব্যাথা পাওনিতো?দোষটা অবশ্য আমারই।এই মোড়ে এত জোড়ে সাইকেল চালানো আমার উচিৎ হয়নি।
নাবিল বলে।
-না না ভাই।কি যে বল।দোষতো আমারই।আর একটু ডান সাইডে থাকা উচিৎ ছিল আমার।তোমারতো হাত ছিলে গিয়েছে।
ছেলেটি বলে।
-ও কিচ্ছুনা।এতটুকু ছড়ে যাওয়ায় কিচ্ছু হবেনা।আচ্ছা চলি।
এইকথা বলেই নাবিল সাইকেলে উঠে বসে।ছড়ে যাওয়া স্থানে বেশ জ্বলছে ওর।

আগে প্রতিদিন বিকেলে নাবিল সাইকেল নিয়ে বেড়াতে বের হতো।করোনার পুরো সময় বাড়ি হতে বেড় হয়নি সে।আব্বা চাইতোনা লকডাউনের সময় নাবিল বাড়ির বাহিরে যাক।তবে এখন স্কুল খুলে গিয়েছে।আব্বাও পারমিশন দিয়েছে বিকেলে বেড়ানোর।তবে অবশ্যই মাস্ক পড়ে।সপ্তাহে দুইদিন নাবিল বিকেলে ঘুরতে বেড় হয়।নাবিল কোনদিন পার্কে যায়।কোনদিন নাটোর রাজবাড়িতে বেড়াতে যায়।রাজবাড়িতে গেলে তার একটাই কাজ, তা হলো কোন নিরিবিলি জায়গায় চুপ করে বসে থাকা।আসলে সে প্রকৃতিকে বুঝতে চায়।আজও সে রাজবাড়িতেই এসেছে।হাঁটতে হাঁটতে সে ছোট তরফের প্রাসাদের দিকে যায়।মেহগনী গাছটির পাশে বসতে গিয়েই সে সেদিনের সেই ছেলেটিকে দেখতে পায়।নাবিল এগিয়ে যায়।
-আরে তুমি?
নাবিল বেশ উচ্ছসিত হয়েই প্রশ্ন করে।
-ঘুরতে ঘুরতে চলে আসলাম আরকি।
হাসতে হাসতে ছেলেটি বলে।
-আমি নাবিল।দশম শ্রেণীতে পড়ি।
-আমি সাব্বির।
-কোন ক্লাসে পড়?
নাবিলের প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়না ছেলেটি।সাব্বির মেহগনি গাছটির নীচে বসে।নাবিলও ওর পাশে গিয়ে বসে পড়ে।
-জায়গাটা খুব নির্জন,তাইনা নাবিল?
-আমার এমন নির্জনতাই পছন্দ।শুধু গাছ-পাখি আর আমি।কি মজা!
নাবিল বলে।
-আমারও একই অবস্থা।
সাব্বির হেসে উত্তর দেয়।
-তুমি জাফর ইকবালের বই পড়?
নাবিল প্রশ্ন করে।
-হ্যাঁ,কি করে জানলে?
-সেদিন তোমার ব্যাগ হতে কাকনডুবি পড়ে গিয়েছিল তো তাই।আমি উনার গল্পের ভীষণ ভক্ত।লাইব্রেরীতে নতুন কোন বই আসলেই কিনে ফেলি।
নাবিল বলে।
-আব্বা-আম্মা কিছু বলেনা।?
সাব্বির জিজ্ঞাসা করে।
-আব্বাইতো সব বই কিনে দেয়।আর আম্মা মাঝে-মধ্যে আব্বাকে বকা দেয়।
নাবিলের কথা শুনে সাব্বির হো হো করে হেসে উঠে।
-তুমি মাস্ক পড়ে আসোনি কেন?
নাবিল সাব্বিরকে জিজ্ঞাসা করে।
-আমার মাস্ক পড়ার প্রয়োজন নেই।
সাব্বিরের উত্তর নাবিলের কাছে অদ্ভুত লাগে।

খুব দ্রুতই নাবিল আর সাব্বির একে অপরের বন্ধু হয়ে যায়।দুইজনের মধ্যে নিয়মিত গল্পের বই আদান-প্রদান হয়।তবে নাবিল তার নতুন বন্ধু সম্পর্কে আব্বা-আম্মাকে কিছুই জানায়না।

একদিন বিকেলে ছোট তরফের প্রাসাদের পাশ দিয়ে ওরা দুইজন হাঁটছিল।শীতের বিকেল।সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে।ভীষণ নির্জন চারপাশ।নাবিল আর সাব্বির ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা।
-চল প্রাসাদের ভেতর যাই।
সাব্বির প্রস্তাব করে।
-পাগল নাকি?ওই বিশাল গাছটি দেখেছো,প্রাসাদের ওই পার্শ্বে?গতবছর আমাদের বয়সী এক ছেলে ওই গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়েছে।এখন তার ভূত প্রাসাদের ভেতর ঘুরে বেড়ায়।ভয়ে এদিকে খুব একটা কেউ আসেনা।
নাবিল বেশ গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে।
-ওসব ভূত-প্রেত আমি বিশ্বাস করিনা।আর আমাদের বয়সী ছেলে কেনইবা গলায় ফাঁস নেবে?
সাব্বির প্রশ্ন করে।
-ওতো কিছু আমি জানিনা।শুনেছি ছেলেটির ভূত প্রাসাদের ভেতর আছে।বেশ!
সাব্বির দ্রুত বলে যায়।
-তুমি তাহলে ভেতরে যাবেনা?
সাব্বির প্রশ্ন করে।
-না।
নাবিল সাফ জবাব দেয়।
-বেশ।তাহলে তুমি এখানেই থাকো,আমি ভেতর থেকে ঘুরে আসছি।
এই কথা বলেই সাব্বির হনহন করে প্রাসাদের ভেতর চলে যায়।বেশ কিছুক্ষণ ধরে নাবিল একাই দাঁড়িয়ে থাকে।বুকের ভেতর তার ধুক-পুক করছে।যেই মাত্র ও ভাবছে ভেতরে যাবে কিনা,ঠিক তখনই সে সাব্বিরের আর্তনাদ শুনতে পায়-বাঁচাও।কিসের ভূত আর কিসের ভয়?এক দৌড়ে নাবিল প্রাসাদের ভেতর চলে যায়।ভেতরে আধো অন্ধকার।দুর্গন্ধ,ময়লা আর গা ছমছমে ভাব।
-সাব্বির।সাব্বির।কোথায় তুমি?
সাব্বিরের কোন সাড়াশব্দ নেই।নাবিলের মনে ভয় জেঁকে বসতে শুরু করে।ফড়ফড় শব্দে কিছু একটা উড়ে যায়।তবুও সে সাব্বিরকে খুঁজতে থাকে।আর একসময় সাব্বিরকে পেয়েও যায়।মাটিতে পড়ে আছে সাব্বির।কোন নড়াচড়া নেই।নাবিল ধাক্কা দেয় সাব্বিরকে।সাব্বির অনঢ় পড়ে আছে মেঝেতে।কি করবে নাবিল বুঝতে পারেনা।কাকে ডাকবে সে?আশেপাশে কেউ নেই।চিৎকার করলেও কেউ শুনবেনা।তবুও নাবিল চেষ্টা করে।জানালার কাছে গিয়ে চিৎকার করে সাহায্য চায়।কিছুক্ষণ চিৎকার করেও যখন কাউকে পায়না তখন সাব্বিরের কাছে ফিরে আসে।সাব্বিরের কাছে এসেই নাবিলের শরীর ভয়ে হিম হয়ে যায়।সাব্বিরের শরীর শূণ্যে ভাসছে।

-এই নাবিল।নাবিল।চোখ মেলো।
নাবিলের যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে প্রথমেই সাব্বিরকে দেখতে পায়।উদ্বিগ্ন নয়নে নাবিলের দিকে চেয়ে আছে।নাবিল উঠে বসে।ভয়ার্ত চোখে চারপাশে চায়।প্রাসাদের বাহিরে কিভাবে এলো তা নাবিল বুঝতে পারেনা।
-আমাকে কে এখানে আনলো?
নাবিল প্রশ্ন করে।
-কে আবার?আমি।
সাব্বির বলে।
-কি হয়েছিল আমার?
নাবিল জানতে চায়।
-আচমকা আমি তোমার কন্ঠ শুনতে পাই।তুমি চিৎকার করে বলছিলে,কেউ কি আছো,আমাদের সাহায্য কর।আমি শব্দ লক্ষ্য করে দৌড়ে আসি।দেখি প্রাসাদের পশ্চিম পাশের ঘরটির সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছো।উফ: তোমার যা ওজন!
সাব্বির হাসতে হাসতে বলে।নাবিল বেশ লজ্জা পেয়ে যায়।

নাবিল সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরে।ঐশি কিছু বলেনা।তবে অবাক হয়।নাবিল যখন ঐশির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন অন্যরকম এক গন্ধ ঐশির নাকে ধাক্কা মারে।নাবিল ফ্রেশ হয়ে আসলে তাকে পায়েস খেতে দেয় ঐশি।
-আজ কোথায় বেড়িয়ে আসলি?
-রাজবাড়ির ছোট তরফের প্রাসাদের দিকে গিয়েছিলাম আম্মা।
-তোর জামা কেমন ভেজা ভেজা লাগছিল?
-জয়কালি বাড়ির দিঘির জলে মাথা ভিজিয়ে ছিলাম তাই জামার কলার ভিজে গিয়েছিল।
নাবিল উত্তর দেয়।
-কি যে কান্ড কারখানা তোর?জ্বর না আসলেই হয়।
ঐশি বলে।

শুতে শুতে দেরী হয়ে যায় নাবিলের।শোবার আগে শেলফের সামনে দাঁড়ায়।আগামীকাল কোন বইটা সাব্বিরকে দেওয়া যায় ভাবছিল সে।পরে মনে হয় বুবুনের বাবা বইটি সাব্বির এখনও পড়েনি।

-এই নাও আজ তোমার জন্যে বুবুনের বাবা নিয়ে এসেছি।
বইটি এগিয়ে দিতে দিতে নাবিল বলে।সাব্বির বইটি নেয়।কিছুক্ষণ পাতা উল্টায়।এরপর আবার তা নাবিলের হাতে ফিরিয়ে দেয়।
-কি হলো?
নাবিল প্রশ্ন করে।
-আব্বা আমাকে নিয়ে যাবে।
সাব্বির বলে।
-কোথায়?
-আমেরিকায়।
এই কথা বলেই সাব্বির দৌড় দেয়।চুপ করে বসে থাকে নাবিল।অজান্তেই কান্নার জল গাল বেয়ে নেমে আসে তার।

রাতে আব্বা-আম্মার সাথে খেতে বসেছিল নাবিল।
-ঐশি,তোমার জাহিদের কথা মনে আছে?
মোসাদ্দেক স্ত্রীকে প্রশ্ন করে।
-সাব্বিরের আব্বা?
ঐশি বলে।
-ঠিক ধরেছো।গত বছর এই মাসে জাহিদ আর সাব্বির করোনায় মারা গিয়েছে।আমি আজকে জানলাম।
ধরা গলায় মোসাদ্দেক বলে।
-সাব্বির আর নাবিলের মধ্যে খুব ভাবছিল।দু’জনেই তখন সবেমাত্র কথা শিখছিল।বাড়িটা ভরে থাকতো তখন।
কথা বলতে বলতে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নেয় ঐশি।
-সাব্বিরের কথা নাবিলের মনে থাকার কথা নয়।ওতটুকু ছেলে নিয়ে জাহিদ আমেরিকায় চলে গিয়েছিল।কি লাভ হল?
মোসাদ্দেক সাহেব কান্না ভেজা গলায় বলতে থাকে।

রুহীগাঁও
২৭/০৯/২০২১