নাসির আহমেদ কাবুলের একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা

আমার আজ কোনো অভিমান নেই

তু‌মি তখনও পাথরের মতো স্থ‌বির!
দুই চোখে যখন আমার ক্লা‌ন্তির বিষবাষ্প
ফেনা‌য়িত, বিষণ্ণ ‌গোধূ‌লিতে যখন আ‌মি
স্পর্শকাতর খুব, ‌তোমার কণ্ঠলগ্ন হতে
ব্যাকুল আ‌মি যখন—
তখ‌নও তু‌মি ডাকোনি আমাকে!

আমারো তো কিছু অ‌ভিমান থা‌কতে পা‌রে—
‌থাকতে পরে কিছু অপারগতার কৈ‌ফিয়ত।

তু‌মি না জানার ভাণ করে ঘু‌মাও নিজের ভেত‌র;
বরাবরই তু‌মি একরোখা, নিজেকে ব্যস্ত রাখো
‌নিজের মধ্যে; আমার অনুপ্র‌বেশ রুখে দাও
দরজার খিল এঁটে! আ‌মি অসহায় জলজ—
তোমার বিদ্রু‌পের দাবানলে পুড়ে ছাই হই!

অ‌ভিমানের পাথরচাপা অসহায় আর্তনাদ দিক-
‌দিগ‌ন্তে ছ‌ড়িয়ে গেলে, বনবনান্ত পুড়ে ছাই হলে
কীই-বা কার আসে-যায়!
সেসব দিন এখন শুধু ক‌বিতার শরীরে মেদ
বাড়ায়, আর কিছু নয়!

আমারো তো কিছু অ‌ভিমান থা‌কতে পা‌রে—

‌থাকতে পরে কিছু অপারগতার কৈ‌ফিয়ত।

তু‌মি তা কোনোদিনই শুনতে চাও‌নি বলে
নীল ক‌ষ্টে আকণ্ঠ নিম‌জ্জিত আ‌মি
তোমার দুয়ার থে‌কে স‌রি‌য়ে নিলাম ‌নিজেকে চির‌দি‌নের জন্য।

আমার আজ আর কোনো অ‌ভিমান নেই!

ঢাকা
২৯ মার্চ, ২০২০

একদিন আমিও ছিলাম

একদিন সন্ধ্যা নামবে, গাঢ় অন্ধকারে
ঢেকে যাবে চরাচর; কোন অজানায় তখন
তোমাদের খুঁজে পাবো আমি? তার আগে যেটুকু
রোদ্দুর তার বর্ণচ্ছটায় তোমাদের করে রেখে গেলাম
আজ এই আমাকে।
ভুলে যাবে হয়তো একদিন; তবু দিনের শেষ রশ্মিটুকু
অন্ধকারেও উঁকি দেবে কোনো আঁধার স্মৃতি তটরেখায়।
মনে পড়বে একদিন ছিলাম আমিও তোমাদের।

দুচোখে কেবল অন্ধকার

চো‌খে চোখ রে‌খে যে যায় রূপালী চাঁ‌দের রা‌তে

কতকাল দে‌খি না তা‌রে আর

কতকাল মু‌খোমু‌খি বসে শুধা‌তে পা‌রি না তা‌রে

হ‌বে ‌কি আজ একটু অবসর?

শী‌তের সকা‌লে নাড়ার আগু‌নে ওম নি‌তে নি‌তে

স্বলাজ কিশোরী চোখ টি‌পে হা‌সে

কত প্রশ্ন তার- অবসর কেন? কী কার‌ণে অবসর,

বু‌ঝেও কিছু‌তেই বুঝ‌তো না সে!

অনুরা‌গে ঠোঁট কাঁ‌পে তার থর থর, রক্তলাল অধর

আ‌রো লাল হতো, সে আ‌রো সলাজ

‌সেই ‌চোখ মায়াময়‌ ভাসা ভাসা দুরন্ত হ‌রিণীর মত

ছু‌টে এ‌সে শুধায় না, কেন এ‌লে আজ?

বাঁশী তার বা‌জে, মগ্ন চৈত‌ন্যে ফে‌লে যায় দীর্ঘশ্বাস

মায়াবী চাঁদে ছায়া প‌ড়ে আজ তার

সে গে‌ছে চ‌লে ‌চিরতরে রূপালী চাঁ‌দ সা‌থে নি‌য়ে

আমার দু‌চোখে এখন কেবলই অন্ধকার!

৪ এ‌প্রিল, ২০২০

ঢাকা

তুমি সাড়া দাওনি তাই
কতবার তোমাকে ডেকেছিলাম আমি, তুমি তখন দরোজার ওপাশে
ঘুমকাতার চোখে ‘উঁহ’ বলে কোলবালিশটা জড়িয়ে কোথায় যে
হারিয়ে গেলে! আমি ডাকতে-ডাকতে বিবর্ণ বিষাদে অস্থির হয়েছিলাম;
তুমি তখনো সাড়া দাওনি!

তুমি সাড়া দাওনি! তুমি সাড়া দাওনি তাই—
মধ্যাহ্নে একটি প্রজাপাতি খুন হলো—একটি গাঙচিল ডানা হারালো
একটি দোয়েল শিষ দিতে গিয়ে বেসুরো বাজালো স্বরলিপি
একটি সকাল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো চন্দ্রিমা উদ্যানে, যাযাবর বাতাস
ফিরে গেলো মন খারাপ করা বার্তা নিয়ে কোন এক অচীন দেশে!

তুমি সাড়া দাওনি! তুমি সাড়া দাওনি তাই—
উচ্ছ্বল কিশোরীর নীল জামা কালো রঙে ছেয়ে গেলো হঠাৎ করে
কৃষ্ণচূড়া রঙ-ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে গেলো কী এক বিদ্রুপে
মগ্ন কবির হাত থেকে কলম খসে পড়ে গিয়ে সুখের জায়নামাজে
লিখলো বিচ্ছেদের দিনলিপি!

তুমি সাড়া দাওনি! তুমি সাড়া দাওনি তাই—
গ্যালাক্সি থেকে আস্তে-আস্তে হাজার তারা উধাও হলো কৃষ্ণগহ্বরে
পৃথিবীর সব আলো নিভে গিয়ে প্রেতপুরিতে নির্বাসিত হলো ভালোবাসা
আর তরুণ-তরুণীরা বিষাদের কালো পতাকা মিছিল নিয়ে
এগিয়ে গেলো তাজমহলের দিকে!

মোহাম্মদপুর, ঢাকা
২৮ আগস্ট, ২০১৯

তোমাকে কত কী বলার আছে

আজ এই ফাল্গুনে যখন বিরহী কোকিলের আর্তনাদে

রমনার বাতাস কাঁদে অলক্ষ্যে, তখন কে যেন

হেঁটে চলে যায় নিঃশব্দে,

তখন আমার বারোয়ারি সুখ গলে পড়ে মোমের মতোন।

জেগে উঠি সবুজ পাতার মতো একাকী,

তাকিয়ে দেখি নবীন কিশলয় থেকে উঁকি দেয়া

ঘুমন্ত কোনো ফুলের কোরক, চোখে তখন দারুণ তৃষ্ণা-

সেই ছেলেবেলায় প্রথমবার তোমাকে দেখার মতো!

আজ এই ফাল্গুনে-কোকিলের আর্তনাদের দারুণ দিনে

তোমাকে খুব মনে পড়েছে আমার, চোখে অস্থির তৃষ্ণা

নিয়ে পাতার বনে খুঁজে ফিরছি একটি মোহন সকাল

প্রথম প্রহরে রজনীগন্ধার মতো বিষণ্ন বিমূর্ত অনুরাগে।

আজ খুব ইচ্ছে করে ডেকে বলি কোকিলের মতো করে

আমার চোখ গেছে-হৃদয় বনে আজ এসেছে ফাল্গুন,

দাবানলের মতো জ্বলছে পলাশের রঙ, শিমুলের লাল;

এই সময়ে তোমাকে কত কী যে বলার আছে আমার!

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বাসস, পুরানা পল্টন

তোমাকে খুঁজে ফিরি

আজ কতদিন জানালায় জোছনার উচ্ছ্বাস নেই, বসন্ত বাতাসে

কেবলই মর্মান্তুদ বিলাপ শুনি, সেতারের তার বেসুরে কাঁদে,

মেঘের পাহাড় জমে বুকের গহিনে; দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে-কেঁপে ওঠে

শুকনো পাতা—এমন নির্জীব জীবন আমার যখন, তোমাকে

পাই না খুঁজে, কোথাও পড়ে না তোমার ছায়া! অথচ

তুমি ছিলে একদিন রাতের আকাশে তারার মিছিল

অন্ধকারে সকালের রোদ্দুর;

সেসব এখন স্মৃতি—শুধুই কষ্টের পাহাড়!

ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের করিডোরে তোমার পায়ের শব্দ শুনে

জেগে উঠি ব্যাকুল তৃষ্ণা—নিক্কণ শুনি চেতনার ক্যাসেটে,

ছায়াচিত্র দেখি তোমার, দাঁড়াও প্রতিদিন, বাড়াও দুই হাত

আমি ছুটে যাই—ছুটে যাই ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনায়, অলক্ষ্যে

মায়া-মরীচিকা করে বিদ্রুপ।

গুটিয়ে যাই নিজের ভেতর লজ্জায়!

আজ কতদিন তোমাকে দেখি না আমি, কতদিন কফির পেয়ালা হাতে

নিষেধের তর্জনি দেখে করুণ মিনতিতে বলি না—

‘প্লিজ, এইটুকু শেষ, আজ আর হবে না আরো এক কাপ!’

আমার কথা শুনে মৃদু হাসিতে তোমার অলক্ষ্যে চলে যাওয়া

দেখি না আমি—কতদিন তোমার আঁচলে হাত মুছে দিয়ে

ক্ষেপাতে পারি না তোমাকে!

কতদিন, কতটা বছর শেষে আজ এইসব স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত

তোমাকে খুঁজে ফিরি এখানে-ওখানে—

বুক ভেদ করে হাহাকার ওঠে—কোথায়, কোথায়—

কোথায় তুমি—কোথায়, কোনখানে?

কাব্যগ্রন্থ : ভালো থেকো নন্দিতা

তৃষ্ণা

‌দেখ‌তে দেখ‌তেই চো‌খের সাম‌নে পুর‌নো হ‌য় দৃশ্যপট,

‌শি‌শি‌রের প্র‌তি কৃতজ্ঞতা ভু‌লে গাছ-লতা-গুল্ম

ঝি‌মি‌য়ে প‌ড়ে; ফুল-পাতা শু‌কি‌য়ে বিবর্ণ হয়,

আমরাও অ‌চেনা হ‌য়ে যাই দি‌নের পর দি‌ন!

পা‌য়ের চিহ্ন ধু‌লোর চাদ‌রে ঢাকা প‌ড়লে

ঘা‌সের জ‌মি‌নের স্বপ্ন‌ নি‌য়ে ব্যাকুল আ‌মি তোমার দরজায় কড়াঘাত ক‌রি; তু‌মি শুন‌তে পাওনা ব‌লে

তৃতীয়ার চাঁদ বিষণ্ন বাতা‌সে ফে‌লে দীর্ঘশ্বাস!

এক‌দিন দুই কান উৎকীর্ণ ক‌রে তু‌মি শুন‌তে যে

পদাবলী, নি‌জের অল‌ক্ষ্যে অবগাহন ক‌রতে কর‌তে

‌শি‌শি‌রের সমু‌দ্র থে‌কে তু‌লে আন‌তে যে শালুক,

এখন সেসব উ‌চ্ছিষ্ট, পচা, বা‌সি, দুর্গন্ধ ছড়ায়

জীব‌নের পর‌তে পর‌তে!

এ‌তোসব জে‌নেও হেঁ‌টে চ‌লি তু‌মিহীন বিরান ভূ‌মি‌তে

‌তোমার শরীর থে‌কে ঝ‌রেপরা স্মৃ‌তির রেণুর সন্ধা‌নে

আ‌মি এখন ক্লান্তপ্রাণ, তোমার সমু‌দ্রে অবগাহ‌নের

‌নেশায় বুঁদ হ‌য়ে প‌ড়ে থা‌কি জীয়নকা‌ঠির স্প‌র্শের

তৃষ্ণা বু‌কে নি‌য়ে।

বই‌মেলা ২০২০

২৮ ফেব্রুয়া‌রি

খুব অবুঝ তু‌মি

তু‌মি যখন ডু‌বে যা‌চ্ছি‌লে গহীন অন্ধকা‌রে

অর‌ণ্যের শ্বাপদ বন্ধুর প‌থে দিশাহীন যখন,

তখনই হাত বা‌ড়ি‌য়ে‌ছিলাম আ‌মি,

‌তোমার হলুদ দুই চো‌খে অ‌াস্থাহীনতার কা‌লো‌মেঘ

‌দে‌খেও তোমার প‌থের কাঁটা সরা‌তে সরা‌তে

‘বন্ধু’ ব‌লে দুহাত প্রসা‌রিত ক‌রে‌ছিলাম আ‌মি, অথচ

‌বিদ্রুপ তা‌চ্ছি‌ল্যে তু‌মি বল‌লে ‘গেট লস্ট’!

আ‌মি স‌রে যাই‌নি তবু, মুখ বন্ধ ক‌রে তোমার

স্খলন মে‌নে না নি‌য়ে ছুঁ‌ড়ে দি‌য়ে‌ছিলাম ক‌বিতার তীর,

তু‌মি আহত হও‌নি সেই আঘা‌তে, রক্ত ঝ‌রে‌নি,

সূ‌চি হও‌নি এ‌তোটুকু প‌বিত্র রক্তস্না‌নে!

উদ্ধত গ্রীবায় তোমার অশ্লীলতার পালক,

‌তোমার শোভন অধ‌রে বিশ্বাসঘাত‌কের নীল দংশন

বিষ বৃ‌ক্ষের ছায়ায় শয়ন তবু তোমার, খুব বেপ‌রোয়া

তু‌মি নিয়ত গি‌লে যা‌চ্ছো বিষাক্ত গরল! আর আ‌মিনিরুপায় শ্বেত পায়রা ওড়া‌তে বদ্ধপ‌রিকর!

তাজমহল রোড, মো:পুর

৮ মার্চ, ২০২০

মন্তব্য করুন