গ্রেচেন হ্যারিংটন : আটচল্লিশ বছর পর ধরা পড়ল খুনি!

আগস্ট, ১৯৭৫। পেন্সিলভ্যানিয়ার মার্পল (Marple) শহর। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দমকলকর্মী, পুলিশ আর স্বেচ্ছাসেবীরা, সংখ্যায় দুইশোর কম হবে না। শহরের কিশোর-তরুণ কেউ বাদ নেই। ন্যামাভং (Joanne Nammavong) নামে এক স্বেচ্ছাসেবীর ভাষায়, সবাই হাতে হাত মিলিয়ে লম্বা সারি করে দাঁড়িয়েছেন, যাতে এক ইঞ্চি জায়গাও খোঁজা বাকি না থাকে!

কিন্তু এত আয়োজন কেন? কারণ হারিয়ে গেছে আট বছরের ছোট্ট গ্রেচেন হ্যারিংটন। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইবেল পড়তে যাচ্ছিল সে। তার পর থেকেই আর কোনো খবর নেই তার। মেয়ের চিন্তায় বাবা-মা’র খাওয়া-ঘুম হারাম হয়ে গেছে! মেয়েকে কি ফিরে পাবেন তারা?

গ্রেচেন হ্যারিংটন

ডেলওয়ার কাউন্টির নির্ঝঞ্ঝাট শহর মার্পল। সেখানকার স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী গ্রেচেন (Gretchen)। তার বাবা স্থানীয় এক চার্চের পাদ্রি, তার চার মেয়ের মধ্যে গ্রেচেন তৃতীয়। চতুর্থজন সবেমাত্রই দেখেছে পৃথিবীর আলো।

গ্রীষ্মের ছুটিতে বাইবেল পড়তে যেত গ্রেচেন আর তার বোনেরা। বাসা থেকে হেঁটে সর্বোচ্চ পাঁচ-সাত মিনিটের দূরত্বে ট্রিনিট্রি চ্যাপেল, সেখানেই ঘন্টাখানেক ক্লাস হতো। এরপর দ্বিতীয় দফা ক্লাসের জন্য সবাই চলে যেতো গ্রেচেনের বাড়ির লাগোয়া প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চে।

ট্রিনিট্রি চ্যাপেলের বাইবেল স্কুলে যেতে বের হয়েছিলে গ্রেচেন; Image Source: nbcnews.com

সাধারণত তিন বোন একসাথেই যেতেন ক্লাসে। কিন্তু আগস্টের ১৫ তারিখে সর্বকনিষ্ঠ বোনটিকে নিয়ে মা যখন বাড়ি ফিরলেন তখন বড় দুজন তার দেখাশোনার জন্য রয়ে যায়। ফলে একাই স্কুলে রওনা দেয় গ্রেচেন।

হারিয়ে গেল মেয়েটি

সকাল সাড়ে ন’টার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল গ্রেচেন। বাবা জানেন বাসার একদম কাছে ট্রিনিট্রি চ্যাপেলে যাবে সে। শহরের সবাই চেনে তাকে, বিপদ আপদ হবার কোনো সম্ভাবনা নেই! কিন্তু মানুষকে বড় বেশি বিশ্বাস করেছিলেন তিনি!

সকাল এগারোটার দিকে গ্রেচেনের কয়েকজন বন্ধু এসে ডাকাডাকি করতে লাগল খেলার জন্য। মিস্টার হ্যারিংটন চিন্তায় পড়ে গেলেন। এতক্ষণে তো ফিরে আসার কথা মেয়েটার। তিনি ট্রিনিট্রি চ্যাপেলে ছুটে যান, কিন্তু সেখানে নেই মেয়ে। এবার বন্ধু  ডেভিড জ্যান্ডস্ট্রাকে (David G Zandstra) ফোন দিলেন তিনি। জ্যান্ডস্ট্রাও পাদ্রি, এবং বাইবেল স্কুলের প্রধান পরিচালকও বটে। কয়েকবার গ্রেচেনদের ক্লাসও নিয়েছেন। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন গ্রেচেন সেদিন চ্যাপেলে আসেইনি। এরপর আর দেরি না করে সাড়ে এগারোটার দিকে পুলিশে ফোন করেন জ্যান্ডস্ট্রা।

যথারীতি পুলিশ এসে পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে কথা বলল। এক প্রতিবেশী ডিটেকটিভ ফ্রেড ব্ল্যাঙ্ককে (Fred Blanck) জানালেন সকালে রাস্তা দিয়ে গ্রেচেনকে হেঁটে যেতে দেখেছেন তিনি। কিন্তু এরপর আর কোনো সূত্র পাওয়া গেল না। পুলিশ চীফ ড্যানিয়েল হেনেসি (Daniel Hennessey) সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামলেন। সার্চ টিমে যোগ দিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক ছাড়াও ছিল দমকল কর্মী, সাধারণ মানুষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর। চীফ হেনেসি রাজ্য পুলিশের সহযোগিতাও কামনা করলেন। তাদের একটি হেলিকপ্টার এসে চক্কর দিতে লাগলো মার্পলের চারদিকে।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ গ্রেচেনকে খুঁজে যায় পুলিশ। হারানো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিলানো হয় বিস্তর লিফলেট আর পোস্টার। অক্টোবরের ১৪ তারিখ এক পথচারী দেখতে পান গ্রেচেনের দেহাবশেষ, বাড়ি থেকে প্রায় সাত-আট মাইল দূরে রিডলি ক্রিক স্টেট পার্কে (Ridley Creek State Park )। ছোট্ট মেয়েটার মাথার খুলি ফেটে গিয়েছিল। পুলিশ অকুস্থল থেক নানা আলামত সংগ্রহ করে। তবে রহস্যের সুরাহা করতে ব্যর্থ হয় তারা।

গ্রেচেনের খোঁজে ছাপানো লিফলেট © Philadelphia Daily News

খুনির সন্ধান

অনেকটা আচমকাই ডেলওয়ার কাউন্টির সরকারি উকিল বা ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জ্যাক স্টলস্টেইমার (Jack Stollsteimer ) ঘোষণা দেন গ্রেচেনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন তার বাবার বন্ধু ডেভিড জ্যান্ডস্ট্রা। তাকে আটক করেছে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের পুলিশ। তাদের কাছে খুনের স্বীকারোক্তি দেবার পরপরই তাঁকে আটক করা হয়।

স্টলস্টেইমার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দেন ৮৩ বছর বয়সী জ্যান্ডস্ট্রাকে জর্জিয়া থেকে ডেলওয়ারে নিয়ে আসা হবে। তার ভাষায়, বাকি জীবনটা জেলেই পচে মরবে জ্যান্ডস্ট্রা। এরপর যে ঈশ্বরকে সেবা করার শপথ নিয়েছেন সে, সেই ঈশ্বর তার মতো নরকের কীটের জন্য কী শাস্তি বরাদ্দ রেখেছেন সেটা দেখার দুর্ভাগ্য হবে তার।

কীভাবে ধরা পড়লেন জ্যান্ডস্ট্রা

আটচল্লিশ বছর পর হঠাৎ করে জ্যান্ডস্ট্রা স্বীকারোক্তি দিলেন কী মনে করে? পুলিশই বা তার কাছে কেন গিয়েছিল? এজন্য ফিরে যেতে হবে বেশ খানিকটা পেছনে। গ্রেচেনের খুনিকে ধরতে না পেরে একসময় মার্পলের পুলিশ তদন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় বটে, কিন্তু গ্রেচেনকে কখনো ভুলে যায়নি তারা। বর্তমান চীফ ব্র্যান্ডন গ্রাফ (Brandon Graef ) কেসের সমস্ত কাগজপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিলেন, যাতে কোনো সূত্র পাওয়া গেলে তদন্ত পুনরায় শুরু করতে সমস্যা না হয়। 

মার্পলেরই বাসিন্দা সাংবাদিক মাইক ম্যাথিস আর জোয়ানা ফ্যালকন গ্রেচেনকে নিয়ে একটি বই লিখছিলেন। এজন্য অনেকের সাথেই যোগাযোগ করেন তারা, কথা বলেন জ্যান্ডস্ট্রার সাথেও। তারা ভিন্ন এক লোকের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিলেন। স্টেট পুলিশকে সেটা জানালে ২০১৭ সালে তারা নতুন করে তদন্ত শুরু করে। সন্দেহভাজন নির্দোষ প্রমাণিত হন। কিন্তু নতুন করে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান ভাবিয়ে তোলে পুলিশকে। সেই লোকের বক্তব্য অনুযায়ী গ্রেচেনকে একটি গাড়িতে উঠতে দেখেছিল সে, এবং সেই গাড়ির বিবরণ মিলে যায় জ্যান্ডস্ট্রার সেই সময়ের গাড়ির সাথে।

এই বছরে জানুয়ারিতে এক মহিলার সাথে যোগাযোগ করে পুলিশ। তিনি গ্রেচেনের সহপাঠী ছিলেন, একইসাথে জ্যান্ডস্ট্রার মেয়ের বান্ধবী। ছোটবেলায় বান্ধবীর বাড়িতে কয়েকবার থেকেছেনও। পুলিশের কাছে মহিলা দাবী করেন সেই সময় অন্তত দুবার জ্যান্ডস্ট্রা তার স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়েছেন। এই ঘটনার প্রমাণ হিসেবে ছোটবেলায় লেখা নিজের ডায়রি পুলিশের কাছে তুলে দেন তিনি।

পুলিশ তার ডায়রি থেকে দেখতে পায় জ্যান্ডস্ট্রার কু-অভ্যাস সম্পর্কে গ্রেচেনের অনেক সহপাঠীই সন্দেহ করতো। তাদের ক্লাসের এক মেয়েকে দু’বার নাকি অপহরণের চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। গ্রেচেনের ব্যাপারেও তার ব্যাপারে খচখচানি ছিল তাদের মনে। কিন্তু শহরের একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে জ্যান্ডস্ট্রার বিরুদ্ধে কোনোকিছু বলাটা বাচ্চাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

মাইক আর জোয়ানা ২০২২ সালে গ্রেচেনকে নিয়ে বই প্রকাশ করেন। তবে জ্যান্ডস্ট্রাকে সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখেননি তারা। এমন নয় যে জ্যান্ডস্ট্রার সাথে পুলিশ আগে কথা বলেনি। তিনিই কিন্তু তাদের ডেকে এনেছিলেন। তবে গ্রেচেনের হত্যার বছরখানেকের মাথায় মার্পল ছেড়ে চলে যান টেক্সাসে। এরপর ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু শহরে কাজ করে ২০০৫ সালের দিকে বাসা বাধেন জর্জিয়ার ম্যারিয়েটাতে। সেখানেও চার্চের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।

জুলাইয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা জর্জিয়ার পুলিশের সাহায্য নিয়ে জ্যান্ডস্ট্রাকে জেরা করেন। তাদের তথ্যমতে একপর্যায়ে খোলাখুলিভাবে গ্রেচেনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন জ্যান্ডস্ট্রা। তিনি নাকি এই পাপের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন!

বাড়ি থেকে বের হবার পর কী হয়েছিল খুলে বলেন জ্যান্ডস্ট্রা। গ্রেচেনের ওপর তার নজর ছিল আগে থেকেই। সেদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে তাকে একা হাঁটতে দেখেই মাথায় বদমতলব খেলে যায়। নির্জন এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে গ্রেচেনকে ক্লাসে পৌঁছে দেবার কথা বলে উঠিয়ে নেন তিনি। স্বভাবতই বাবার বন্ধু আর নিজের শিক্ষককে অবিশ্বাস করেনি মেয়েটা।

ওদিকে জ্যান্ডস্ট্রার মাথায় তখন রাজ্যের কুচিন্তা। নিষ্পাপ মেয়েটিকে নিয়ে তিনি চলে যান শহরের বাইরে। এরপর নিজের বিকৃত কামনা চরিতার্থ করার চেষ্টা করেন। তবে গ্রেচেন সহজে হার মানেনি, প্রাণপণে বাধা দেয় তাকে। এতেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় জ্যান্ডস্ট্রার। রাগের চোটে গ্রেচেনের মাথায় আঘাত করেন তিনি। তখনই খুলি ফেটে মারা যায় সে।

রিডলি ক্রিকে মৃতদেহ ফেলে দিয়ে সভ্য মানুষের মুখোশে আবার মার্পলে ফিরে আসেন জ্যান্ডস্ট্রা। গ্রেচেনদের পারিবারিক বন্ধুর দায়িত্ব পালন করতে থাকেন নিষ্ঠার সাথে! বলা হয়, গ্রেচেনের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার পরিচালকও ছিলেন তিনি। লাশ পাবার পর তার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিতেও ভুলে যাননি! স্টলস্টেইমার তো তাকে সাক্ষাৎ শয়তান বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, ফুলের মতো মেয়েটার জীবন নিয়েও ক্ষান্ত হয়নি এই লোক, আলগা দরদ দেখিয়ে বন্ধু সেজে তার পরিবারকে ধোঁকা দিয়ে গেছে বছরের পর বছর!বিচার নিয়ে জটিলতা

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী জ্যান্ডস্ট্রা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। সুতরাং তার অপরাধ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সেটা তো আদালতের রায় থেকে আসতে হবে। গ্রেচেনকে হত্যা করা হয়েছে পেনসিলভ্যানিয়াতে, সুতরাং জ্যান্ডস্ট্রার বিচার করতে হবে এখানেই।  এজন্য তাকে নিয়ে আসতে হবে জর্জিয়া থেকে। সমস্যা হলো- মার্কিন অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব আইন আছে। জর্জিয়া থেকে পেনসিলভ্যানিয়াতে জ্যান্ডস্ট্রাকে আনা এক দেশ থেকে আরেক দেশে বন্দি হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মতো। জর্জিয়ার আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত এক্ষেত্রে নারাজি দিতে পারবেন, তখন তাকে হস্তান্তর করতে গভর্নরের অনুমতি লাগবে।

জ্যান্ডস্ট্রা হস্তান্তরে আপত্তি জানিয়েছেন কিনা সেটা পরিষ্কার নয়। তবে স্টলস্টেইমার সেটা হবে ধরে নিয়ে আগে থেকেই কাজ শুরু করেছেন। তাকে প্রথমে পেনসিলভ্যানিয়ার গভর্নর জর্জ শ্যাপিরোর কাছে আবেদন করতে হবে। শ্যাপিরো সেটা পাঠাবেন জর্জিয়ার গভর্নর ব্রায়ান কেম্পকে (Brian Kemp)। কেম্প আবেদনে স্বাক্ষর দিলেই কেল্লাফতে। জ্যান্ডস্ট্রার শত আপত্তিও কাজে আসবে না।

শেষকথা

গ্রেচেন হ্যারিংটনের হত্যাকান্ড মার্পল শহরের জন্য ছিল ভূমিকম্পের মতো। পুলিশ চীফ ব্র্যান্ডন বলেছেন, নিরাপদ শহর হিসেবে মার্পলকে নিয়ে যে গর্ব ছিল অধিবাসীদের, এই ঘটনার পর সেটা ধুলোয় মিশে গেছে। ছেলেমেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে কাবু হয়ে গিয়েছিলেন বাবা-মায়েরা।

পুলিশের সন্দেহ জ্যান্ডস্ট্রা এমন কান্ড অনেক ঘটিয়েছেন। অভিযুক্তের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করেছে তারা। এই নমুনা দিয়ে করা হবে অধিকতর তদন্ত। তিনি যে যে জায়গায় ছিলেন বা গিয়েছেন, সেখানে গ্রেচেনের মতো আর কোনো হতভাগ্য আছে কিনা জানতে চান তদন্তকারীরা।

জ্যান্ডস্ট্রার আটকের মধ্য দিয়ে সম্ভবত হ্যারিংটন পরিবারের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো। গ্রেচেনের বাবা বেঁচে নেই। তবে তার পরিবারের অন্যান্যরা একটি বিবৃতি দিয়ে পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাদের ভাষায়, মাত্র আট বছরে থমকে যাওয়া মেয়েটার স্মৃতি এখনো জাগ্রত মানুষের মনে, কারণ তাকে ভুলে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।