একজন গুলতেকিন এবং একচোখা সমাজ/ ম্যারিনা নাসরীন

বেশকিছুদিন আগে আফতাব আহমেদ এবং গুলতেকিনের খুব কাছের একজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম তাঁরা ডিসেম্বরের দিকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। কিন্তু যতদূর মনে হয় আফতাব আহমেদের অসুস্থতার কারণে (অন্য কোন কারনেও হতে পারে) বিয়েটা এগিয়ে আসে। যেহেতু কাউকে বলা নিষেধ তাই বর ছাড়া কারো সাথে বিষয়টি আমি শেয়ার করিনি। তবে শুনে প্রথমেই যে কথাটি বলেছিলাম সেটি হলো,বাহ! খুব ভালো হবে।
তিনি বিয়ে করেছেন এই নিয়ে তার পক্ষে বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত। যদিও পক্ষে বেশি। কিন্তু যারা বিপক্ষে বলছেন তাদের কিছু অংশের মত তিনি রিভেঞ্জ নিতে বিয়ে করেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন সেই এককথা, বুড়ি বয়সে নাতিপুতি নিয়ে থাকবেন স্বামী লাগে কেন? গুলতেকিন কি ছিলেন কি করেছেন সে খবর সবার কমবেশি জানা। তবে সত্যি যদি তাঁর রিভেঞ্জ নেবার ইচ্ছে হতো হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকতেই নিতে পারতেন ।
বাঙালী সমাজে একসময় স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে সহমরণে যেতে হতো । এরপর বিধবা হলে তাকে সকল সাজসজ্জা শখ ত্যাগ করে রঙহীন শাড়িতে রঙহীন জীবন যাপন করতে হতো। স্বামীকে কখনো কিছু করতে হয়নি। ধীরে ধীরে সবকিছু বদলালো কিন্তু বদলের এখনো অনেক বাকী। আজো বাঙালী সমাজ নারী বান্ধব নয়। আমাদের সমাজে সাধারনত স্ত্রীর তুলনায় স্বামীর বয়স কয়েকবছর বেশি হয়ে থাকে । ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্ত্রীর আগে স্বামী পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব একজন নারী স্বামীর মৃত্যুর পর যে কতটা একা হয়ে যান, অসহায় হয়ে যান সে ভুক্তভোগী জানে। অথচ তার এই একাকিত্বের প্রতি সহমর্মি এই সমাজের কেউ নেই। তারা ভাবেন স্বামী মরেছে ছেলে মেয়ে নাতী পুতির সাথে আমোদে থাকবেন। তার আর কি পাওয়ার আছে? নাতীপুতির কথা বাদ দিলাম। কজন ছেলে মেয়ে আজকের এই ব্যস্ত সময়ে মায়ের খেয়াল রাখতে পারে? শখ আহল্লাদ দেখে? মর্যাদা দিতে পারে? অনেক ছেলে মেয়েই মনে করে মায়ের হাতে অফুরান সময় নাতিপুতির দেখভাল করতে পারবে। তারপর নানা ইস্যুতে নিত্য খিটিমিটি মানসিক টানাপড়েন। ঠিক এই জায়াগায় যদি একজন পঞ্চাশঊর্ধ্ব পুরুষের স্ত্রী মারা যায় তখন প্রশ্ন আসে, লোকটা একা কিভাবে থাকবে। তাকে বিয়ে দেওয়া হোক। কেউ না চাইলেও তিনি নিজেই ভাবেন, আমার একটা বিয়ে করার দরকার। সেবা তো করতে পারবে! করেও ফেলেন। অথচ ভাবুন তো কত নারী স্বামী মারা যাবার পর একাকী জীবন যাপন করছেন? তিনি কতটা সেবা পান চারপাশ দেখে বলবেন?
এসব সবই সামাজিক নিয়ম ! আর এই নিয়মের ব্যত্যায় হলেই সমাজ সংসার সব শেষ হয়ে গেলো। বলে হইহই রইরই।
গুলতেকিন ৫৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছেন বলে যাদের চুলকানি তাদের উদ্দেশ্যে বলি, ৫৬ বছরের একজন বুড়ো যখন বিয়ে করে তার নাতিপুতির চেয়ে বউয়ের দরকার হয় বেশি। ৫৬ বছরের বুড়ির কেন নয়? ষাট বছর বুড়ার সাথে ২০ বছরের ছুড়ির বিয়ে হলে দোষের কিছু নাই আর প্রিয়াংকা দশ বছরের ছোট কাউকে বিয়ে করলেই মহাভারত অশুদ্ধ ?
আজ থেকে পনেরশ বছর পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ২৫ বছর বয়সে ১৫ বছরের বড় ৪০ বছরের খাদিজা (রাঃ)কে বিয়ে করেছেন। অথচ এই সময়ে এসেও কোন নারী যদি নিজের চেয়ে বয়সে ছোট কাউকে বিয়ে করে ছি ছি ঢি ঢি জাত গেল কুল গেলো সমাজ পচে যায়? মিয়ারা! বুড়ি থেকে ছুড়ি একুনে চার বউ যখন ঘরে তুলছেন তখন সেটা সুন্নত মানেন, আর ২৫ /৪০ এর হিসেব মানবেন না? এতোটা একচোখা ? আপনারা পারেন বটে।
যাকগে, ধান ভানতে শিবের গীত । আমি বলছি না স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর কাউকে বিয়ে করতেই হবে। কেউ একাকী বাকী জীবন থাকতে চাইলে থাকুন। কিন্তু কেউ যদি বিয়ে করতে চান তাতে নাক সিঁটকানোর কিছু নেই। বরং এইভেবে খুশি হওয়া উচিত তাঁরা আর একা নন। শেষ বয়সে নারী পুরুষ উভয়েই সঙ্গীহীন অবস্থায় অসম্ভব একা আর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সে নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য যদি কেউ সংগী ( নারী বা পুরুষ) বেছে নেন তাতে কারো চুল পড়ার কিছু নেই । আর যাদের চুলটুল পড়ছে তারা বরং সার্ফ এক্সেল দিয়ে ব্রেণ কয়েকবার ওয়াশ করে নেন । আপনাদের মগজে হিব্রু সভ্যতার ময়লা আটতলার ফাউন্ডেশন নিয়ে রয়ে গেছে ।
হুমায়ুন আহমেদ ছেড়ে যাবার পর দীর্ঘ ১৬ বছর গুলতেকিন একা সন্তানদের লালন পালন করেছেন । তিনি কখনো কারো কাছে কোন অভিযোগ করেন নাই। ছেলে মেয়েরা এখন যার যার মত প্রতিষ্ঠিত । তিনি সেই একাই। এই একা একজন মানুষ যদি সঙ্গী হিসেবে আরেকজন একা মানুষকে বৈধভাবে জীবনে যোগ করেন আপনাদের তাতে খাওজায় কেন? হুমায়ন আহমেদ যখন শাওনকে বিয়ে (মনের বিরুদ্ধে অশান্তি করে সংসার করার থেকে বিয়ে করাই ঠিক ছিল) করেছিলেন তখন যেমন আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি তেমন এখনো গুলতেকিনের বিয়ে আমার কাছে স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমার অত্যন্ত আনন্দ লাগছে এই ভেবে যে নুহাশের মত ছেলে মায়ের একাকিত্ব বুঝেছে স্বার্থপরের মত আচরণ করেনি ।
যতদূর জানি আফতাব আহমেদ অত্যন্ত ভাল এবং মেধাবী একজন মানুষ। দোয়া করি তাঁদের যুগল জীবন সুখে কাটুক ।

মন্তব্য করুন