করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় শিক্ষা ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি /খায়রুজ্জামান খান সানি

দীর্ঘ এক বছর হয়ে এলো শিক্ষাঙ্গনে নেই কোলাহল। ভোর হলে শোনা যায় না জাতীয় সংগীত, হয় না পাঠ শপথ বাক্য। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কর্মস্থল যেন থমকে গেল কোভিড-১৯-এর কারণে । অর্থনীতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, চাকরিচ্যুত হয়েছেন অনেকে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে শুরু করে অফিস, আদালত, ব্যাংক, মার্কেট, যানবাহন, কলকারখানা চালু করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা পিঁছিয়ে পড়েছে অবর্ণনীয়ভাবে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনা মহামারি নতুন রূপ নিয়েছে। আক্রান্তের হার, মৃত্যুর হার প্রতিদিন বিগত দিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সীমিত পরিসরে লকডাউন চলছে। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। অসচেতনতা পরিলক্ষিত সর্বক্ষেত্রে।
করোনার কারণে ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। জীবনের তাগিদে অন্য সব খাত স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল, পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। জাতির ভবিষ্যত্ রক্ষায় শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে খোলা হচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৩০ মার্চ সব মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় খোলা হয়নি। গত বছরের ১ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনার কারণে এ পরীক্ষাসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনিশ্চয়তায় দিন পার করছিল প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থী। তখন অটোপাশ দেওয়া হয় তাদের। কিন্তু এ বছরের শিক্ষার্থীদের কী হবে? প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। এ বছরের এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদেরও যেন নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আরো একটি প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কতটুকু হচ্ছে? তাদের সেমিস্টার ফাইনাল হচ্ছে না। ক্লাস রুমে ফিরতে পারছেন না। পরবর্তী সময়ে সেমিস্টারে উত্তীর্ণ কবে নাগাদ হবেন? সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। সব থেকে পিছিয়ে পড়ছে অনার্স প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। সেশন জটের আশঙ্কায় দিনপার করছেন তারা। দেশের সর্বমোট সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে। কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে এ বিষয় যেন নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করে তুলছে নতুন করে আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাওয়াতে।
অধিকাংশ শিক্ষার্থী আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে না। ইউজিসি কর্তৃক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ঋণ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। সেখানে ২৩ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কথা কী ভাবা হয়েছে? তারা অবহেলায় পড়ে যাচ্ছেন নাতো? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সব থেকে বেশি পিছিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো নাহলে এই এক বছর পিছিয়ে পড়াতে তাদের নতুন দুঃখ গাঁথা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রযুক্তির চেয়ে প্রয়োজন হলো দক্ষ পদ্ধতি। আমাদের জিনে ঢুকিয়ে দেওয়া আছে, ক্লাসে সশরীরে উপস্থিত থেকে পড়া। সেই জিনিসকে রাতারাতি ভার্চুয়াল করে ফেললে একটা বিশাল মানসিক প্রস্তুতি দরকার দুপক্ষেরই। মানসিক ভাবে আমরা প্রস্তুত নই। ক্লাসে উপস্থিত হলেও ক্লাস শেষে দেখা দিচ্ছে মাথা, কান, চোখ ব্যথা। মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে অনলাইন ক্লাস কতটুকু হচ্ছে? এটা ভাবার বিষয়। ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এই জরিপে বলা হয়, মহামারির সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতনের জন্য সরাসরি তিনটি কারণকে উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক চাপ এবং পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া। শতকরা ৭১ ভাগ শিশু ও তরুণ বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে তারা নিজেদের শিক্ষাজীবন নিয়ে চিন্তিত। তারা বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ অনুভব করছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩০ এপ্রিল ১৯৭২ সালে মে দিবস উপলক্ষ্যে বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘সমৃদ্ধির পথে কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই’। এই বক্তব্যটির চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় এখনই। শিক্ষায় সমৃদ্ধি আনতে হলে পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয় নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অনলাইনে পাঠদান শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে ব্যাহত হচ্ছে। ‘সেশনজট’ নামক অভিশাপ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে । সেশনজট শব্দটি অভিধান থেকে মুছে ফেলতে করোনাকালীন সময় এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আগামী ২৪ মে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু খোলা হবে কি না বর্তমান পরিস্থিতি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। এক্ষেত্রে দুইটা পদ্ধতি অবলম্ব্বন করতে হবে। যদি খোলা হয় তাহলে একরকম পরিকল্পনা করতে হবে, যদি খোলা না হয় তাহলে ভিন্ন রকমের পরিকল্পনা করতে হবে। যদি খোলা হয় তবে সিলেবাস কমিয়ে এনে নতুবা সেমিস্টার ভিত্তিক কোর্সের সময়সীমা কমিয়ে এনে সেশনজট নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ করতে হবে। অথবা, একেক সেশন ভিত্তিক সাপ্তাহিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। প্রতিদিন ক্লাস না নিয়ে সপ্তাহে দুই বা তিন দিন ক্লাস নিতে হবে। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আর যদি খোলা না হয় তবে ভিন্ন পথ খুঁজতে হবে। দেশের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে তারা যেন শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত না হন সে কথা ভাবতে হবে। সর্বোপরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না হলেও সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে হবে, তাদের হতাশা, মানসিক চাপ দূর করতে হবে। চাকরির বয়স সময় সীমা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের সব প্রতিষ্ঠানের চাকরির নিয়োগ থেকে শুরু করে সব বিষয় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প পথ ভাবতে হবে, নতুবা ঝরে পড়বে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী।

লেখক :শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,

মন্তব্য করুন