জলপুত্র হরিশংকর জলদাস

মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। চেষ্টা থাকলে নিজের ভেতরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো শুধু মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তার উদাহরণ হরিশংকর জলদাস। অন্য দশজন লেখকের মতো সুন্দর স্বাভাবিক জীবন পাননি তিনি। জেলে পিতামাতার ঘরে জন্ম নেয়া হরিশংকর সমুদ্রের স্রোতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বড় হয়েছেন। তবে শুধুমাত্র জেদ ও আত্মসম্মানকে কাজে লাগিয়ে বাঁচতে শিখেছেন, অর্জন করেছেন নিজের প্রাপ্যটুকু।হরিশংকর জলদাসদের বসত চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায়। তার বাবা ছিলেন জেলে। দাদা কখনো জেলে, কখনো সুইপার। ছিল টানাপোড়েনের সংসার। তার ঠাকুরদা চন্দ্রমণি পাতরের মৃত্যু হয়েছে সমুদ্রে। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস তখন পণ করেছিলেন, যেভাবেই হোক ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন। যেই কথা সেই কাজ। হরিশংকর জলদাস যখন বিসিএস (শিক্ষা) করলেন তখনও তার পরিবারের অভাব কাটেনি। রাতভর মাছ ধরে দিনে কলেজে যেতেন পরিপাটি হয়ে। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরতে হয়েছে তাকে। তবে এত লড়াই-সংগ্রামের পরও পিছু ছাড়েনি জাওলার পোলার (জেলের ছেলে) অপবাদ। ৫৫ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লিখে হৈচৈ ফেলে দেন হরিশংকর। তার পরের ইতিহাস বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে যোগ করে এক নতুন মাত্রা।হরিশংকর জলদাসের জন্ম যে পাড়ায়, সেখানে কেউ স্কুলে গেছে – সেটা ছিল অবাক করার মতো। তার উপর স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়া ছিল স্বপ্নাতীত। তাঁর পিতা বলতেন, তোকে পশ্চিম ছেড়ে পূর্বদিকে আলোর পথে যেতে হবে। অর্থাৎ আমাদের পাড়ার পশ্চিমে সমুদ্র, পূর্বে স্কুল।’কঠিন বাস্তবতায় তাঁর পিতা পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়তে পারেননি। পরিবারের সবার মুখে ভাত তুলে দিতেই হিমশিম খেতেন। পিতার মৃত্যু এবং সমুদ্রের সাথে নিজের নিরন্তর লড়াইয়ের কারণেই হয়তো সমুদ্রের বিরুদ্ধে তার পিতার অলিখিত একটা যুদ্ধ ছিল। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার জীবন সমুদ্র সংগ্রামে কাটাবেন কিন্তু ছেলেকে তিনি সমুদ্রে পাঠাবেন না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য তাকে বারবার সমুদ্রে যেতে হয়েছে। তার নিরক্ষর দিদিমা পরাণেশ্বরী দেবীর অনুপ্রেরণা এবং পিতা যুধিষ্ঠিরের সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধটাই তাকে পড়া চালিয়ে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে।নিজের জীবনের তিক্ত স্মৃতি ছিল তার চলার পথের প্রেরণা। কলেজে শিক্ষকতা শুরু করার পর চট্টগ্রাম শহরে বাসা ভাড়া চাইতে গিয়ে তিনি বিপাকে পড়েন। অনেকে তাকে বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। পরে বুঝলেন, তার পদবি ‘জলদাস’। এজন্য কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। তখন অনেক শুভাকাংখী তাকে পরামর্শ দিলেন পদবি পরিবর্তন করার জন্য। কেউ কেউ বললেন, জলদাস এর পরিবর্তে শুধু ‘দাস’ লিখলেও কোন সমস্যা হয়তো হবে না। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এটা তার পূর্বপুরুষের পদবি। তিনি কেন তার শেকড় ছিঁড়ে ফেলবেন?হরিশংকর জলদাস অপমান ও লাঞ্ছনাকে শক্তি হিসেবে নিজের ভেতর কাজে লাগিয়েছেন। তিনি মনে করেন, মানুষতো ভালোবাসায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখে। বাংলাদেশে বোধকরি তিনিই একমাত্র, যে অপমানিত হয়ে লিখতে বসেছিলেন। চাকরি করতে গিয়ে তিনি চরম সাম্প্রদায়িকতার শিকার হলেন।পিএইচডি হোল্ডার হিসেবে তাদের বিভাগীয় প্রধানের বেশ অহঙ্কার ছিল। একই সঙ্গে তার ভেতর প্রবল সাম্প্রদায়িকতা কাজ করতো। তিনি তাকে জাত-পাত তুলে অপমান করতেন। বলতেন, জাওলার ছাওয়ালটা কই? তার তো ক্লাস ছিল। জেলে সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই কী গালিটা সারাজীবন বয়ে যেতে হবে তাকে? তখনই ভাবলেন, তার শেকড়ের সন্ধান করা প্রয়োজন। তখন থেকেই তার ভেতর একটা অভিমান চাপলো। জানার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, জেলেরা আসলেই নিন্দিত কিনা।’এরপর তিনি প্রফেসর ড. ময়ুখ চৌধুরীর কাছে তার পিএইচডি করতে যান। গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন, তাদের আদি কবি ব্যাসদেব হলেন জেলেনীর সন্তান।মানে ব্যাসদেব তাদেরই পূর্বপুরুষ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিনয়বাঁশি জলদাসদের কথা জানলেন। তারপর বসে গেলেন লেখার টেবিলে।হরিশংকর জলদাস অল্প সময়ে প্রচুর লিখেছেন। বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা দীর্ঘদিনের ঘা গুলো যেমন তার কলমে ধরা দিয়েছে তেমনি তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো ফুটে উঠেছে পাতায় পাতায়।তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলোঃ(উপন্যাস) দহনকাল, কসবি, জলপুত্র, মহীথর, রাসগোলাম, মোহনা, হৃদয়নদী, আমি মৃণালিনী নই, হরকিশোরবাবু, প্রতিদ্বন্দ্বী, এখন তুমি কেমন আছ, কোন এক চন্দ্রাবতী। (গল্প) মাকাল লতা, জলদাসীর গল্প, লুচ্চা। (প্রবন্ধ) লোকবাদক বিনয়বাঁশি, ধীবর জীবন কথা, কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ এবং ছোটগল্পে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, বাংলা সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ। তার বিখ্যাত আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কৈবর্তকথা’ ‘নিজের সঙ্গে দেখা’।বাংলা সাহিত্যের এই জলপুত্র ইতোপূর্বে পেয়েছেন আলাওল পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি। ২০১২ সালে তিনি পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। আর ২০১৯ এ অর্জন করেন একুশে পদক। আজ ৩ মে হরিশংকর জলদাসের জন্মদিন। ১৯৫৫’ র এই দিনে তিনি পৃথিবীতে আসেন।—-মেসবা খান