নীল বৃষ্টি/সঞ্জয় মুখার্জ্জী


বইমেলা চলছে।
বাঙলা একাডেমির বাইরে বিশাল লাইন।
পাঠক-ক্রেতারা বইমেলার ভিতর ঢুকবে বলে লাইন দিয়ে অপেক্ষায় আছে। পুরুষ ও নারীদের প্রবেশপথ আলাদা। সেই বিকেল তিনটে বাঙলা একাডেমির প্রবেশপথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি। এখনও নীলের দেখা নেই! আশপাশে তাকালো সে। নাহ! কোন ঝালমুড়ি বিক্রেতাও নেই। নেই কোন চা-কফির ব্যবস্থাও। মেজাজ একটু-একটু করে চড়ছে বৃষ্টির। তাকে অপেক্ষায় থাকতে বলে নিজেই নিরুদ্দেশ! সেলফোনটাও ধরছে না! কী করবে ভাবছে সে। ভিতরে গিয়ে কফিশপে বসবে, নাকি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকবে।
চোখ পড়লো পুরুষ প্রবেশপথের দিকে।
প্রত্যেককে সময় নিয়ে তল্লাশি করছে পুলিশ।
বাইসেপ, কোমর, তারপর পকেটে তল্লাশি। চাবি থাকলে দেখাতে বলছে। ব্যাগ থাকলে খুলে দেখছে।
অন্যদিকে নারী প্রবেশপথের দিকে তাকালো বৃষ্টি।
নারী পুলিশ আছে।
ব্যাগ তল্লাশি করছে।
কিন্তু না। দেহ তল্লাশি নেই। শুধু ব্যাগ চেক করেই ছেড়ে দিচ্ছে।
পাশেই চোখ পড়তে দেখলো মাটির উপর পলিথিন শিটে যেন সিগারেটের মেলা বসেছে।
পুরুষের পকেট তল্লাশি করে লাইটার, সিগারেট সব একজায়গায় জড়ো করা হয়েছে।
যাদের পকেট থেকে এগুলো পাওয়া গেছে তারা কেউ-কেউ এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
যদি অন্তত সিগারেটগুলো ফেরত পাওয়া যায়।
চমকে উঠলো বৃষ্টি নারী কণ্ঠের আওয়াজে।
কী হলো প্যাকেটটা ফেরত দিন। একটা সিগারেটের দাম দশ টাকা।
আপনি সিগারেট নিয়ে ঢুকতে পারবেন না।
অসুবিধা আছে ম্যাডাম। পুলিশের সাথে কথা কাটাকাটি করছে এক তরুণী।
কেন পারবো না?
আমার কাছে কী লাইটার পেয়েছেন? লাইটার না থাকলে তো সিগারেট খাওয়ার কোন প্রশ্ন আসে না। সিগারেটের প্যাকেট কী খোলা আছে? তাও না। তো অসুবিধা কোথায়?
আপনি এটা নিয়ে ভিতরে যেতে পারবেন না। নির্বিকার কণ্ঠে জানালো এক নারী পুলিশ।
ঠিক আছে, ঢুকবো না বইমেলায়! দিন প্যাকেট ফেরত দিন।
পরে ঢুকবো বইমেলায়।
ঠিকই তো।
দুশো পনের টাকা এক প্যাকেট সিগারেটের দাম। কে জানে তার কপালে কী আছে।
সেও কিনেছে এক প্যাকেট। শয়তান নীলটার জন্য।
বারবার করে বলেছে।
এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসিস। যন্ত্রণার আর শেষ নেই। কোথায় যে আছে পাজিটা! একবার সামনে আসুক। আজ ওর একদিন কী আমার একদিন। সিগারেট খাবি নিজের টাকায়। অন্যের দানের উপর নির্ভর করতে হয় কেন? মনে মনে এটাও ভাবলো নীলের মুখে সিগারেট দেখতেও ভালো লাগে তার।
তরুণীকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে বৃষ্টির।
একটু চিন্তা করতেই মনে পড়লো উনি একজন লিখিয়ে। মানে লেখালিখিও করেন।
লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে একাধিকবার দেখেছে তাকে।
সিগারেটের অভ্যাস আছে তার।
বৃষ্টি ভাবলো, আজ একটা সিগারেট খেয়েই দেখবে কিনা কেমন লাগে।
পর মুহূর্তেই চিন্তাটা বাতিল করলো সে।
মনে পড়লো নীল একবার জোর করে সিগারেট খাইয়েছিলো ওকে। সে কী অবস্থা। না, না, আর কখনই নয়।
উফফ্ এখনও নীলের খোঁজ নেই!
এরপর আর কোনদিনও ওর কথার উপর ভরসা করবো না। ওকে আজ একটা উচিত জবাব দিতে হবে। মাথার ভিতর নানারকম চিন্তা জট বাঁধে তার। বাসায় ফিরবে কখন। ঘড়ির দিকে তাকায় সে। বইমেলায় ঢুকবে কি না, ভাবতে থাকে বৃষ্টি।

রাস্তার দুপাশে নানা রকমের লিফলেট বিলি হচ্ছে।
বইমেলার ঢোকার লাইন টিএসসিতে এসে ঠেকেছে।
কারণ একটাই। আজ শুক্রবার।
নিয়ম মেনে আজ লাইনে দাঁড়িয়েছে নীল।
এখন পৌনে চারটা বাজে। বৃষ্টিকে গেটে থাকতে বলেছে তিনটার সময়।
এখনও পর্যন্ত টিএসসি পার হতে পারলো না। সেলফোনটা ভুলে রেখে এসেছে।
আজ কপালে খারাবি আছে।
একটা জটলা চোখে পড়লো নীলের। একটু পরেই বুঝলো কেউ একজন ডেস্ক ক্যালে-ার বিলি করছে।
এখন আর কেউ লিফলেট নিচ্ছে না। সকলেরই লক্ষ্য ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে।
পাশ থেকে একজন দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো একটা ক্যালেন্ডার।
নীল দেখলো এই বছরেরই।
মজাই লাগলো দেখতে।
পহেলা বৈশাখের মতো বইমেলাতেও উপহারের উদ্যোগ বইমেলায় আসতে আগ্রহী করে তুলবে নিশ্চিত।
কিন্তু এ কী! লাইন যেন আর এগোয় না।
চারটা বাজে।
এরপর আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই উচিত হবে না।
অগত্যা লাইন ছেড়ে জোর কদমে গেটের দিকে হাঁটা শুরু করলো।
যাহোক আগে বৃষ্টির সাথে দেখা করা দরকার।
হাঁটাপথেও থামতে হলো বেশ কয়েকবার।
সৌজন্য বিরতি।
রাস্তাজুড়ে সেলফি তোলার হিড়িক।
একসাথে দলবেঁেধ দাঁড়িয়ে হাত লম্বা করে সেলফি-স্টিককে আরো একটু দূরে রেখে মুখের অভিব্যক্তিকে যতটা আকর্ষণীয় করে রাখা যায় তার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। পায়েচলা পথটাকে অন্যের জন্য প্রতিকূল করে তোলাই যেন এর লক্ষ্য। মনে মনে নিজেকেই শাপ-শাপান্ত করতে লাগলো নীল। কেন লাইন ছেড়ে আগেই আসলো না।
গেটের কাছে আসতেই পাশ থেকে কেউ সামনে হাত বাড়াতেই বিরক্তিতে মন ভরে উঠলো। অবশ্য সেদিকে খুব একটা খেয়াল না করেই নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো উফফ্।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই নীলের চোখে পড়লো অসম্ভবরকম শান্ত একটি মুখশ্রী। হ্যাঁ বৃষ্টিই তো! দুচোখে আগুন নিয়ে তাকিয়ে আছে। অথচ মুখে তার কোন প্রভাবই পড়েনি!
নীল জানে এই লক্ষণ মোটেই ভালো নয়।
হঠাৎ করেই যেন আগুনে মোম গলতে শুরু করলো।
মুখে উদ্বেগ নিয়ে তাকালো নীল। বললো এই! তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে খুঁজছি সেই কখন থেকে।
বলেই বুঝলো কী ভুল করেছে।
কেন এমন বললো সে।
সত্যি কথাই তো বলতে পারতো।
কিন্তু না। কোন রকম খারাপ কিছুর আভাস পাচ্ছে না সে।
বরং বৃষ্টির চোখে কী যেন একটা ইশারা। বুঝতে পারছে না সে।
এবারে বৃষ্টি ডাকলো। এদিকে এসো।
নীলের কানে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বললো, তোমার সিগারেট এনেছি কিন্তু গেটে তো ঢুকতে দেবে না।
হাফ ছেড়ে বাঁচলো নীল।
ভাবলো, যাক এ যাত্রা বেঁচে গেলো সে।
বৃষ্টিকে বললো, তুমি স্মার্টলি ঢুকে যাও। আটকালে তারপর দেখা যাবে।
দুজনেই আলাদা গেট দিয়ে ঢুকলো।
দরজা দিয়ে ঢুকছে নীল। পুলিশি নিয়ম মেনেই তাকে তল্লাশি করা হলো।
ওদিকে বৃষ্টিও তল্লাশি শেষে ভিতরে ঢুকেছে। ব্যাগ থেকে এটা ওটা দেখার পর ছেড়ে দিয়েছে ওকে।
নাহ। সিগারেটের প্যাকেট চোখে পড়েনি। কারণটা কী। জানতে হবে।
বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করতেই চমৎকার র‌্যাপিংয়ে একটা গিফট বক্স বের করে দিলো বৃষ্টি।
জিজ্ঞাসা করতেই বললো, এটা তোমার সিগারেট।
এতক্ষণে বুঝতে পারলো নীল কেমন করে পুলিশের চোখ এড়িয়ে বেনসন সুইচ তার হাতের মুঠোয় এলো।
বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে নীল। হঠাৎ করেই আবার থমকে গেলো সে।
শান্ত মুখশ্রী কিন্তু আগুন ঝরে পড়ছে দুচোখে।
বুঝতে পারলো, আজ কপালে দুঃখ আছে তার।
আমি কফি খাবো। বললো বৃষ্টি।
অন্যদিন হলে নীল বলতো, পয়সা নেই। তুমি খাওয়াও।
কিন্তু আজ সাথে-সাথেই রাজি হয়ে গেলো নীল।
বললো, চলো। আমারও কফি খেতে ইচ্ছে করছে।
আজ নজরুল মঞ্চে একাধিক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে।
লেখক তার বই সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে পরিচিতজনেরাও। ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করছেন অনেকেই। একজন উপস্থাপকের ভূমিকায় বলে যাচ্ছেন, লেখক কী করেছেন, এই বই লিখতে গিয়ে তিনি কী ভেবেছেন? পাঠক এই বই পড়ে কী বেনেফিট পাবে, এইসব। একইসাথে মঞ্চে পাশাপাশি তিনটি জটলা। মিডিয়া ব্যক্তিত্বও আছেন। তারা হাসি-হাসি মুখে মাইক্রোফোনের সামনে নতুন লেখক সম্পর্কে অনর্গল বলে চলেছেন। লক্ষ্যণীয় এটাই, কেউই কিন্তু কারো কথা শুনছেন না। এবারের বইমেলায় ঠাসাঠাসি গাদাগাদি যদিও একটু কম, তারপরও পায়ে পায়ে লোকজনের আনাগোণা।

বৃষ্টির হাত ধরে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর ধরে পুকুর পাড়ে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো নীল।
এদিকটাতে বসবার জায়গা আছে বেশ। কিন্তু কখনই খালি পাওয়া যায় না।
ক্যান্টিনে ঢোকার মুখেই কফি বিক্রি হচ্ছে। ছেলেটা বলে চলেছে—কফি, কফি, নেসকফি খান। নেসকফি—মাত্র তিরিশ টাকা। নেসকফি নেন, নেসকফি। নীল ছেলেটার কাছে গিয়ে বললো, দুটো কফি দাও।
কফি দুটো নিয়ে একটা বৃষ্টির হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকালো ছেলেটার দিকে।
ছেলেটা বলে চলেছে নেসকফি—নেসকফি নেন। তিরিশ টাকা, মাত্র তিরিশ টাকা।
নীল তাকে ডেকে বললো, এই শোনো। তুমি একটা কাজ করো। ছেলেটা তাকালো। নীল বললো শুধু বলো নেসক্যাফে! আর কিছু বলতে হবে না।
ছেলেটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নীল আর বৃষ্টির দিকে। তারপর বললো, এই যে এদিকে—নেসক্যাফে!
মাত্র তিরিশ টাকায়—নেসক্যাফে। নীলের সাথে চোখাচোখি হলো ছেলেটার। একটা অন্যরকম দ্যুতি দেখলো ছেলেটার চোখে। দুজনেই হাসলো। বৃষ্টিকে নিয়ে ক্যান্টিনের সামনের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো নীল।
কানে আসছে, এই যে এদিকে—নেসক্যাফে! মাত্র তিরিশ টাকায় নেসক্যাফে।
শুনতে ভালোই লাগছে নীলের।
বৃষ্টির রাগ কিন্তু অনেকটাই পড়ে এসেছে।
নীলের এইসব ছোট-ছোট কর্মকা- দেখে ওর বেশ মজাই লাগছে।
তারপরও নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার, আজ ওর একটা শিক্ষা দেয়া দরকার।
বিশেষ করে কাউকে সময় দিয়ে সেটা না রাখার জন্য।
কফি শেষ হতেই কাপদুটো নিয়ে ওয়েস্ট বিনে ফেললো বৃষ্টি।
তারপর বললো, চলো অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে যাই।
আজ কোন কিছুতেই বাধা দিচ্ছে না নীল।
লিটলম্যাগ চত্বরে অনেক বইয়ের স্টল। কাছাকাছি আসতেই একটা বইয়ের স্টলে দাঁড়ালো দুজনেই।
একটা-দুটো বই নাড়াচাড়া করলো ওরা। বেশিরভাগই কবিতার বই।
বৃষ্টি একটা বিষয় নিয়ে ভাবছে বেশ কয়েকদিন ধরেই।
আজকাল কবিতা লিখিয়েদের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। যদিও কবিতা কেউই আর পড়তে চায় না। তবুও চুম্বকের ধর্ম মেনে লেখক-পাঠকের সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে বেশ। তবে এটাও ঠিক, সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক ও ব্লগ সূচনার পর থেকে মানুষ তার মনের কথা লেখার মত একটা প্লাটফর্ম পেয়েছে বৈকি। এটাও বা কম কীসের। প্রত্যেক মানুষের মাঝেই নাকি এক-একজন কবি বাস করেন। তা না হলে মানুষের কর্মজীবন, সাংসারিক জীবন এতো মধুময় কখনই হতো না। তবে হ্যাঁ, কবিতা লেখা যদি নেশা না হয়ে পেশা হয়, তবে তা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিটা মানুষের জীবনই তো এক-একটা কাব্য। শুধু তা শব্দে সাজিয়ে প্রকাশ করতে পারলেই হলো। তবে তার জন্য কবি বা লেখক পরিচিতি পেতে হবে কেন? তবে যারা নতুন লিখিয়ে সাহস করে লিখছে, তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা উচিত। বিশেষ করে তাদের প্রকাশিত বই কিনে।
কথাটা মনে হতেই নীলকে বললো, নতুন লিখিয়েদের কয়েকটা বই নাও তো।
‘প্রথমে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী’ নিয়ম অনুসরণ করে দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ দেখে গোটাপাঁচেক বই কিনলো নীল।
তারপর হাতে নিয়ে চললো অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে।
বৃষ্টি ভাবছে, ব্যাপার কী?
আজ কোন কিছুতেই নীল বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু কেন?
ভাবছে, এটার শেষ দেখতে চায় আজ সে।
আজ মঞ্চে পারফর্ম করবে ‘জলের গান’। জানতে চাইলো নীল কতক্ষণ থাকবে বৃষ্টি।
চোখে আগুন নিয়েই উত্তর করলো বৃষ্টি, যতক্ষণ না পর্যন্ত মেলা শেষ হচ্ছে।
নীলের এবার অবাক হবার পালা।
আজকের বৃষ্টিকে সে কিছৃুতেই মেলাতে পারছে না।
অন্যদিন সাতটা বাজতেই বাসার দিকে ছুট লাগায়। কিন্তু আজ থাকতে চায় সারাক্ষণ! যা হোক, মন্দ লাগছে না নীলের। কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝতে পারছে সে। সে-ও চাইছে কিছু একটা ঘটুক।
তা না হলে ভাবতে-ভাবতে তার মাথা খারাপ হবার জোগাড় হয়েছে এই সময়ের মধ্যে।
হায় নারী! কত রহস্য জানো তুমি। আর ভাবতে পারছে না নীল।

নীলের অবস্থা বুঝতে পারছে বৃষ্টি। আর মনে-মনে ভাবছে, এটাই ওর শাস্তি। যতক্ষণ না পর্যন্ত ‘সরি’ বলছে নিজের থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে এভাবেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করবে সে। অনুষ্ঠান মঞ্চে চার বছরের সামি একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেয়া শেখ মুজিবুরের ভাষণ উপস্থাপন করছে। দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে শুনছে সেই ভাষণ। বৃষ্টিও শুনছে একমনে। ভাবছে, এতটুকু ছেলে কেমন করে আয়ত্ব করেছে এসব! ভাষণ শেষে হয়েছে। করতালিতে মুখর বইমেলা অনুষ্ঠান চত্বর। নীলের দিকে তাকাতেই বুঝলো, সে ভাষণ শুনছে না।

এবার একটা চরম সিদ্ধান্ত নিলো বৃষ্টি। ঠিক করলো নীলের সাথে আগামী এক সপ্তাহ কোনরকম যোগাযোগ রাখবে না সে। আজকের পর কোন কথাও বলবে না তার সঙ্গে। দেখি অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায়। যেই কথা, সেই কাজ।
নীলকে ডেকে বললো, বাসায় যাবো। ভালো লাগছে না।
নীল বললো, এই না বললে থাকবে?
বাসায় যাবো। থাকবো না।
কী হলো তোমার আবার?
কিছুই না। বাসায় যাবো।
নীল বুঝতে পারছে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছে বৃষ্টি। তাই পরিবেশ হালকা করার জন্য বললো, সিগারেট চলবে? বেনসন সুইচ?
বৃষ্টি ভেবেছিলো এতটা সময় গেলো নীল নিশ্চয়ই একবার সরি বলবে।
কিন্তু তা না করে বরং আরো রাগিয়ে দিচ্ছে তাকে।
নীল আবারও বললো, কী হলো? খাবে একটা সিগারেট? ধরিয়ে দেই? লাইটার খোঁজ করবো?
এবার বৃষ্টি সরাসরি নীলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, আজকের পর থেকে আমার সাথে কক্ষণো যোগাযোগ করবে না। তোমার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না। তারপর নীলকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সোজা বইমেলা থেকে বেরিয়ে গেলো।
নীল হতবাক।
এটা কী হলো!
পিছন-পিছন ছুটতে-ছুটতে ভাবলো আবারও ভুল করছে না তো।
বৃষ্টি একবারেই এগুলো পছন্দ করে না।
ফিরে এলো আগের জায়গায়।
কপাল খারাপ। আজ সেলফোনও আনেনি। কাজেই কথা বলার উপায়ও নেই।
যাক, বইয়ের প্যাকেটটা ওর সাথেই আছে।
কী করবে এখন, সেটাই ভাবছে নীল।
বাসায় ফিরবে, নাকি অপেক্ষা করবে?
বৃষ্টি কী সত্যিই চলে গেলো!
মনস্থির করলো শেষ পর্যন্ত থাকবে।
তবে বৃষ্টির জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব। বাইরে এলে সবসময়ই একসঙ্গে যায় ওরা।
মনের মধ্যে খচ-খচ করছে বিষয়টা।
সন্ধ্যা সাতটা।
ধ্যাত! কিছুই ভালো লাগছে না নীলের।
চুপ করে বসে আছে সে।
অনুষ্ঠান মঞ্চে গান চলছে। একটু পরেই গান করতে আসবে লোক ব্যান্ড ‘জলের গান’।

বইমেলার বাইরে এসে অনেকটা পথ হেঁটে টিএসসি থেকে সিএনজি নিয়েছে বৃষ্টি। শাহবাগের দিকে চলেছে। পাশেই সিটের উপর নীলের কেনা নতুন লিখিয়েদের বই। শাহাবাগের মোড়ে সিগন্যালে অপেক্ষা করছে সিএনজি। কতক্ষণ পর মুক্তি পাবে কে জানে। কিছু একটা মনে হতেই সিএনজি চালককে তার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে একটা কফিশপে ঢুকলো বৃষ্টি। কফির অর্ডার দিয়েই বইয়ের প্যাকেট থেকে বইগুলো বের করে দেখতে লাগলো। প্রত্যেকটা বইয়ের প্রচ্ছদই সুন্দর। নীল আবার প্রচ্ছদ মনে না ধরলে বই পড়তে চায় না। এখন আর কবিতা পড়তে ইচ্ছে করে না বৃষ্টির। এক সময় আবৃত্তি করতো চমৎকার। লেখালিখিও।
এখন আর কিছুই ভালো লাগে না তার।
কর্মজীবন সত্যিই পাল্টে দেয় মানুষকে।
কেন জানি হঠাৎ করেই মন খারাপ লাগছে বৃষ্টির।
আপা কফি। কফি দিয়ে গেলো ওয়েটার। ব্ল্যাক কফি। চিনি ছাড়া।
এটাতেও অভ্যস্ত সে বেশ কয়েক বছর হলো।
নীলের সাথে পরিচয় ঠিক যতটা বছর।
ও-ই তো শিখিয়েছে, চিনি ছাড়া কফি খেতে।
বলেছে, কফির মজা যদি পেতে চাও, তবে শুধু কফি খাও। নো মিল্ক-নো সুগার।
প্রথম-প্রথম খুব বিস্বাদ লাগতো।
এখন আর লাগে না।
কারণটা বোধ করি নীল।
অভ্যাস মানুষকে সত্যিই অভ্যস্ত করে তোলে।
ঘড়ির দিকে তাকালো বৃষ্টি। মাত্র পৌনে এক ঘন্টা হলো বেরিয়েছে সে। নীল ছাড়া।
অথচ এর মধ্যেই তার মন খারাপ করতে শুরু হয়েছে।
আচ্ছা, নীল কী করছে?
ওরও কী আমার মতো মন খারাপ হয়? আমাকে ছাড়া।
বৃষ্টির সামনের সিটটা খালি। কেউ বসছে না।
নিজের অজান্তেই একটা বইয়ের পাতা উল্টে চলেছে সে।
নতুন লিখিয়েদের কাব্যচর্চা।
চোখ আটকালো না কোন চেনা শব্দে।
আরও একটা পৃষ্ঠা উল্টায় বৃষ্টি।
থমকে যায় তার চিন্তা। আটকে যায় চোখ। মাত্র কয়েকটি শব্দমালায়।
‘যখন মন খারাপ লাগে
তখন আকাশে
মেঘেরাও থেমে যায়,
নীলমেঘ জুড়ে শুধুই
নীলাভ যন্ত্রণা।
এক বুক শূন্যতায়
প্রশ্বাসে থেমে যাওয়া সুখ
নিঃশেষ হয় দীর্ঘশ্বাসে।
তোমার সাথে
কথা না বলার শূন্যতা
পূরণ হয় না কখনই।’
এ কী! এতো তার মনের কথা। নতুন লিখিয়েরা যে শব্দমালা সাজিয়েছে সেখানে যে সেও অংশী। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত বদল। কফির দাম মিটিয়ে রাস্তা পার হয়ে রিকশা নিয়ে সোজা টিএসসি। তারপর পায়ে হেঁেট আবারও বইমেলার গেট। এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। গেটে তেমন কোন ভিড় নেই। অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে এগুতেই চোখ পড়লো নীলের উপর। একটা চেয়ারে বসে আছে। মঞ্চে গাইছে ‘জলের গান’। কানে বাজছে ‘এমন যদি হতো, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়ায় সারাক্ষণ…’। হঠাৎ করেই পাখির মতো স্বাধীন হতে ইচ্ছে করলো বৃষ্টির। পিছন থেকে গিয়ে চেয়ারে বসে থাকা নীলের গলা জড়িয়ে ধরলো বৃষ্টি।
না, চমকে ওঠেনি নীল।
কী এক পরম মমতায় দুচোখ বন্ধ করে রইলো। বুঝতে পারলো বৃষ্টি ফিরে এসেছে। বললো, ফিরে এলে তাহলে। বৃষ্টি তখনও একটা ঘোরের মধ্যে। মাথার মধ্যে অনন্ত শূন্যতা তার। নীলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে চলেছে-
‘তোমার সাথে
কথা না বলার শূন্যতা
পূরণ হয় না কখনই ॥’

মন্তব্য করুন