রিনির ডায়েরিঃ আমি কবি নই

মাহমুদা রিনি

আমি কবি নই!
কবিদের বই থাকবে, ভাব থাকবে,
কাঁধে ঝোলা ব্যাগ থাকবে।
আকাশের মেঘ দেখে ষোড়শীর কালো চুল মনে হবে।
বৃষ্টির শব্দ ছমছম নূপুরের নিক্কণ ভেবে
মন ছন্দে দুলে উঠবে!
আমি নিরেট বাস্তববাদী সাদামাটা বাঙালি।
সারাদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও
চুলের ঢাল দূরে থাক–
একগাছি চুলের আঁশও দেখতে পাই না।
কবিদের মন থাকবে, সেই মনে টইটম্বুর ভালোবাসা থাকবে।
মনের পরতে পরতে ভালোবাসার সুগন্ধি থাকবে।
উথাল পাথাল নদীর মত স্রোত থাকবে,
ভাটির টানও থাকবে দুর্দান্ত বিরহের মত।
ভাটিয়ালি গানের সাথে মন ছুটে যাবে দূরে বহুদূরে।
আমি বাজারের থলে হাতে ফিরি,
মাছওয়ালার সাথে দামদর করি,
শাকভর্তা, ডালমাখা ভাত চেটেপুটে খাই,
মুদি দোকানে মাসকাবারি বাকিতে তেল-নুন কিনি,
দিনশেষে দুপয়সার হিসেব মেলাই।
পায়ের দিকে তাকিয়ে পথ চলতে চলতে
আকাশের রঙটাও ভুলে গেছি।
সেই কবে সূর্য ওঠা সোনালী ভোর দেখেছি
এখন আর মনেও পড়ে না।
কবিদের ঘর হবে রমনা, রেসকোর্স ময়দানের মত বিশাল– সেখানে গাছ থাকবে,
সেখানে উত্তর দক্ষিণ হাওয়া থাকবে।
ঝরা পাতার মতো, ঝরা ফুলের মতো,
শনশন বাতাসের সাথে নেমে আসবে কবিতা,
যেন ঐশ্বরিক কোন বার্তা।
আবার কখনো বঙ্গবন্ধুর মতো আঙুল উঁচিয়ে
বজ্রকণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসবে স্বরচিত কবিতা;
ছয়দফার মতো, গণ-আন্দোলনের মতো,
মুক্তিযুদ্ধের মতো, স্বপ্ন দেখা স্বাধীনতার মতো,
উত্তাল গণজোয়ারের মতো ফুঁসে উঠবে কবিতা।
কবি সেখানে নায়ক, কবি তখন বীরযোদ্ধা,
কবি তখন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন দেবদূত।
কী মোহনীয় তাঁর অবয়ব! কী অসাধারণ সেই ক্ষমতা!
যেন হ্যামিলনের বাঁশির সুরের মতো কবিতার
ছন্দে বিমোহিত জনপদ!
আমি তখন ধুলিমাখা পায়ে হেঁটে যাচ্ছি ঝরা পাতা মাড়িয়ে।
অর্ধ-উলঙ্গ অথবা ছেঁড়াফাটা জামাকাপড়ে শরীরটাকে
লুকিয়ে আধমরা উদ্বাস্তু শিশুরা পায়ের তলা থেকে
পাতা কুড়িয়ে নেয়,
সেই পাতা কুড়ানোর শব্দ আমার কাছে কবিতা মনে হয়!
খোলা আকাশের নিচে পলিথিন ঝুপড়ির একপাশে,
ছেঁড়া কাগজ জ্বালানো চুলোয় যখন ভাতে বলগ ওঠে
সেই শব্দকেও আমার কবিতা মনে হয়।
তখন, সেই সময় আমিও যেন কবির মতো উদাস পায়ে
পলিথিন ঝুপড়ির পাশ দিয়ে,
পাতা কুড়ানি শিশুদের ঝরাপাতা মাড়িয়ে হেঁটে যাই!
সেই মর্মর শব্দ, ভাতে বলগ ওঠা শব্দের ছন্দ আমাকে
ক্ষণিকের জন্য বিমোহিত করে তোলে।
আমিও কিছুক্ষণের জন্য কবি হয়ে উঠি।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়