সাইমন ড্রিং; বাংলাদেশের বন্ধু, মানুষের বন্ধু




সাইমন ড্রিং, একজন সাংবাদিক এই পরিচয়ের চেয়ে এদেশের মানুষের কাছে তার বড় পরিচয় হলো বন্ধু পরিচয়টি। তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। বাঙালির গর্বের ইতিহাস ১৯৭১ সালের পাকিস্থানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে বিজয় লাভ। যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে এই মহান মানুষের নাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্থানী বাহিনীর নির্মম নির্যাতন চালায় নিরীহ বাঙালির ওপর। সেই নির্মম নির্যাতনের খবর প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন যা ’ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ’ট্র্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিসস্থান শিরোনামে প্রকাশিত হয় এবং এর জন্য ২০১২ সালে ’ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার অর্জন করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আল্লাহর নামে আর অখন্ড পাকিস্থান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত্র এক নগর। তাকে পাকিস্থান সরকার জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল এবং তিনি পুনরায় কলকাতায় ফিরে সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর পাঠাতেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং শেষ অর্থাৎ বাঙালির বিজয়ের দিনের স্বাক্ষিও তিনি। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশে চালানো পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী। নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি পাকিস্থানী বাহিনীর এই নির্মমমতার খবর সংগ্রহ করেন এবং বিশ্বকে জানান এবং সাথে সাথে বাঙালির পক্ষে বিশ্বে একটি জনমত ও পাকিস্থানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জন্মে ভূমিকা পালন করে। তারপর বিশ্ব বাংলাদেশের ওপর চালানো এই নির্মমতার খবর জানতে পারে। সাংবাদিকতার অসীম শক্তি সত্য প্রকাশের। সেই সত্য প্রকাশে যে মারাত্বক ঝুঁকি থাকে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত একজন সাংবাদিক তা জানেন। বিশেষ করে সেই পরিস্থিতি যদি হয় কোনো যুদ্ধাবস্থা,আগ্রাসন বা এরকম কোনো পরিস্থিতি যেখানে শাসকগোষ্ঠীর চালানো বন্দুকের গুলিতে নিরীহ মানুষ মারা যায়।
আজ যুদ্ধাক্রান্ত বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হত্যা,নির্যাতন এবং গুমের মতো চূড়ান্ত পরিণতি বরণ করছেন। সাংবাদিকতা মানেই সাহসী পদক্ষেপ। আর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যেকোনো পরিণতি স্বীকার করেই সাংবাদিকতা করতে হয়। সায়মন ড্রিং পৃথিবীর বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাংবাদিকতা করেছেন বিশ্বখ্যাত সব গণমাধ্যমের হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সেই সময়ে সাইমন ড্রিং সেই পরিণতির চিন্তা না করে সত্য প্রকাশ করেছিলেন। যা একজন সত্যিকারের বন্ধু, প্রকৃত মানুষের পরিচয় দেয়। প্রকৃত বন্ধুর বৈশিষ্ট্য হলো বন্ধুর দুঃসময়ে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা। নিজের বিপদের সম্ভাবনা থাকলেও তা স্বীকার করে নেওয়া। একজন মানুষ মানুষের কাছে কিভাবে মূল্যায়িত হবে তা নির্ভর করে তার কর্মের ওপর। কর্মই তার মূল্যায়নের একমাত্র উপায়। সাইমন ড্রিং কেবল বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন না তিনি ছিলেন পৃথিবীর মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের জনগণকে সহায়তার জন্য তিনি একটি দাতব্য তহবিলের ধারণা তুলে ধরেন। এই তহবিল সৃষ্টির ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল যেখানে ১২০ টি দেশে ২০ মিলিয়ন মানুষ এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি দুটি দাতব্য তহবিল গড়ে। এই তহবিলে পূর্বের চেয়েও বেশি দেশের বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে। মানুষের জন্য সায়মন ড্রিং এভাবেই প্রচেষ্টা করেছেন। তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধু ইংল্যান্ডের নরফোকের ফাকেনহাম নামক ছোট্র শহরে ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর তখন তিনি ঘর ছাড়েন। তার কর্মজীবন শুরু হয় পত্রিকার সাথে এবং সেই থেকে আজীবন তিনি একাধিক পত্রিকায় বিশ্বের বহু দেশে দায়িত্ব পালন করেন। সংবাদ সংগ্রহে তিনি ঝুঁকি নেওয়ার সাথে সাথে দু বার আহতও হয়েছিলেন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার তুর্কিদের আগ্রাসনে। এরপরও তিনি থেমে থাকেননি। ১৯৬৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রের ’প্রুফ রিডার (সম্পাদনা সহকারি) হিসেবে কাজে যোগ দেন। এরপর তিনি নিউইয়র্ক টাইমস ও রয়টার্সের মতো খ্যাতমান গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদপত্র এবং বিবিসি টেলিভিশন নিউজের বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে সারা বিশ্বে কর্মরত ছিলেন। সাইমন ড্রিং ৭৬ বছর বয়সে রোমানিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী ফিয়োনার কর্মস্থল রোমানিয়া। বাংলাদেশ তার প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়েছে।

ছবি- alchtron.com

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য