ভারতীয় সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ সলিল চৌধুরী

নাসির আহমেদ কাবুল ll

সলিল চৌধুরী দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজিপুরে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে ১৯ নভেম্বর ১৯২২ জন্মগ্রহণ করেন  এবং তিনি ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ বাহাত্তর বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী, আসামের লতাবাড়ি চা বাগানে ডাক্তারি করতেন। বাবার কাছেই সলিল চৌধুরীর সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি। পিতৃব্য নিখিল চৌধুরীর কাছেও সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন তিনি। মূলত নিখিল চৌধুরীর ঐক্যবাদন দল ‘মিলন পরিষদ’-এর মাধ্যমেই গানের জগতে শৈশবেই সম্পৃক্তি। তাঁর শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আসামের চা বাগানে। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষগ্রামে, (পুরাতন নাম কোদালিয়া) মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাস করেন। এরপর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি তার পিতার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তাঁর পিতা চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে মঞ্চ নাটকের জন্য সুখ্যাতি সম্পন্ন ছিলেন। তিনি কলকাতায় অবস্থিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এ সময়েই তার সঙ্গীত জ্ঞানে পরিপক্বতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত তার রাজনৈতিক ধারণা জন্মায়। তিনি দারুণ মেধা সম্পন্ন ছিলেন।

সলিল চৌধুরী সবিতা চৌধুরীকে বিয়ে করেছিলেন। তার দুই কন্যা এবং এক পুত্র রয়েছে।

১৯৪৪ সালে যখন তরুণ সলিল তাঁর স্নাতক পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন, তখনই ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-এ (Indian Peoples Theater Association) যোগ দেন। এ সময় তিনি গান লিখতে এবং এর জন্য সুর করা শুরু করেন। আইপিটিএ এর সাংস্কৃতিক দলটি বিভিন্ন শহর এবং গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতে থাকে, যা এই গানগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। বিচারপতি, রানার এবং অবাক পৃথিবীর মত গানগুলো তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

চল্লিশের দশকের শেষ দিক। গণসঙ্গীতের জোয়ার বাংলায়। নতুন কয়েকটি গণসঙ্গীত নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গেছেন গীতিকার ও সুরকার। শুনে তারিফ করলেন হেমন্ত, কিন্তু বললেন ‘এ সব গান তো রেকর্ড করা যাবে না, অন্য গান থাকে তো দাও।’ কথা শুনে ফিরেই আসছিলেন, সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে হঠাৎ মনে হল আর একটা গান শোনানো দরকার। আধখানা লেখা হয়েছে তখনও অবধি। আবার উঠে গিয়ে কবিতার খাতা খুলে সুর শোনালেন। হেমন্তের কথায়, “আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম এ এক আশ্চর্য কীর্তি।” বলা যায় সেই মুহূর্তেই জন্ম নিল রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলার সেরা কাব্যগীতি: ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’। সেদিন রাত্রে ফিরে এসেই বাকি অংশটা লিখে ফেললেন সলিল চৌধুরী। পুজোর গানের রেকর্ড বেরোল। বাকিটা ইতিহাস।

Image result for সলিল চৌধুরী

এরপর হেমন্ত-সলিলের ঝুলিতে একের পর এক সোনার গান- ‘রানার’ ‘পাল্কীর গান’ ‘পথে এবার নামো সাথী’ ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ ‘শোনো কোনও এক দিন’…

আধুনিক বাংলা গানের নতুন ধরার প্রবর্তন হয়েছে তাঁরই হাত ধরে। তাঁর কবিতা অসামান্য সুরে কথা বলে উঠেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরের মিশেলে, ঘন স্ট্রিংস আর বাঁশির বুনিয়াদে সঙ্গীতের প্রাসাদ গড়েছেন তিনি।

বাংলা গানে নতুন দিগন্ত নিয়ে এসেছিল সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীত! পঞ্চাশের মন্বন্তরে সলিল সৃষ্টি করলেন একের পর এক গান, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’,‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’। তাঁর লেখা গণসংগীত অনুপ্রেরণা দিল ছাত্র-মজুর-কৃষকসহ সব অধিকার বঞ্চিতদের। ‘এদেশ তোমার আমার/ আমরা ভরি খামার/ আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনায়’ কথা ও সুরের আবেদনে আর হেমন্ত মুখোপাধ্যেয়ের কন্ঠে সকলের গান হয়ে উঠল। গণসঙ্গীতের সর্বজনীন আবেদন বার বার এসেছে তাঁর গানের কথা আর সুরের মূর্ছনায়। ‘মর্জিনা আবদাল্লা’র বাণিজ্যিক ছবির গ্ল্যামারাস গল্পেও কাঠুরিয়াদের গানে মাটির মানুষের টান- ‘ও ভাইরে ভাই/ হে হে, আয় রে আয়/ আয়রে কুড়ুল করাত নিয়ে/ পোড়া বরাত নিয়ে/ জঙ্গলে জঙ্গলে আয় রে/ আয় রে কাটি কাঠ, কাটি কাঠ, কাটি কাঠ।’ চাঁদ ফুল জোছনা ছাড়াই, ‌প্রেমের গুন গুন গুঞ্জন বাদ দিয়েও, যে পথে নেমে মানুষের হাতে হাত রেখে বলা যায় ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি,’ দেখালেন সলিল চৌধুরী। আরও পরে ব‍‌লেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি না তো, পথ মোরে খোঁজে।’ তাঁর সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় গলায় ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ কিংবা ‘উজ্জ্বল, এক ঝাঁক পায়রা/ সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে/ চঞ্চল পাখনায় উড়ছে’ শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। সলিল চৌধুরীর সুরে- ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা/ আমার হয় কি গো ভরসা/ আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে’-তে খুঁজে পাই যেন অন্য ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে।

গান আর সুর নিয়েই জন্মেছিলেন সলিল চৌধুরী। পৃথিবী তাঁকে মনে রাখে তাঁর সুরের জন্য। কিন্তু তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল নানা ধারায়। সেই অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন চর্চা হয় না। ‘সুরকার’ সলিল চৌধুরীর প্রতিভার দীর্ঘ ছায়ায় বারবার ঢাকা পড়ে যান কবি সলিল, গল্পকার সলিল, চিত্রনাট্যকার সলিল। মুম্বই যাওয়ার ডাকও কিন্তু এসেছিল গল্পকার সলিলের কাছে। সলিল চৌধুরীর ‘রিকশাওয়ালা’ গল্প নিয়ে ছবি করবেন বিমল রায়। ডাক পড়ল তাঁর। বন্ধু হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বিমল রায়কে বললেন, সলিল তো মূলত গান-বাজনারই লোক। ওকেই যদি ‘দো বিঘা জমিন’-এর সঙ্গীতের দায়িত্ব দেওয়া হয়! খুব কম মানুষই জানেন ‘দো বিঘা জমিন’-এর গল্পটি তাঁর লেখা। সূচনা হল সলিল চৌধুরীর নতুন যাত্রা। সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি’ আজও জনপ্রিয়। বিমল রায়ের ছবি ‘পরখ’-এর গান। কিন্তু ক’জনই বা জানেন, এ ছবির গল্পটিও সলিলেরই? তাঁর কলমের জোর এতটাই ছিল যে মুম্বইয়ের মতো বিনোদনসর্বস্ব ফিল্ম জগতে ‘দো বিঘা জমিন’, কিংবা ‘পরখ’-এর মতো জীবনধর্মী কাহিনী ছবির পটভূমি হয়ে উঠেছিল। একটি হিন্দি ছবি পরিচালনাও করেছিলেন সলিল চৌধুরী। ছবির নাম ‘পিঞ্জরে কে পঞ্ছি’। অভিনয়ে মেহমুদ আর মীনাকুমারী। সেবার আর একটি ছবির গান তৈরি। পিকচারাইজেশনও শেষ। বিশিষ্ট কিছু মানুষের জন্য স্পেশাল স্ক্রিনিং হচ্ছে। ছবি শেষে শচীন দেব বর্মন এগিয়ে এসে বিমল রায়কে বললেন, “সলিলের এই গানগুলান ইতিহাস হইব, দেইখ্যা রাখেন।” ছবিটি ‘মধুমতী।’ এর পরের ঘটনা তো সকলের জানা। সুপারডুপার হিট হয়েছিল ‘মধুমতী’র গান। বিমল রায় বলতেন, ‘সলিলের সুর তো ছবি আঁকে।’ সেসময় বিমল রায়ের সহকারী ছিলেন গুলজার। তিনি বলেছেন, সলিলদার লেখা বড়ই সিনেম্যাটিক। আসলে গল্প বলার একটা অসামান্য দক্ষতা ছিল ওঁর। কখনও তার প্রকাশ হত গানের কথায়, আবার কখনও বা গল্পে, কবিতায়। এ ব্যাপারে সলিল চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে নিজে বলেছেন, “আমি জানি না, কোনটা নিয়ে চলব: কবিতা, গল্প লেখা, অর্কেস্ট্রেশন, না ফিল্মের গান কম্পোজ করা। ক্রিয়েটিভিটি নিয়েই আমার কাজ। যখন যেটা সেই মুহূর্তটায় বা আমার মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খায়, সেটা নিয়ে কাজ করি।”

‘আনন্দ’-এ সলিলের সুরে ‘কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’ গেয়ে মুকেশ হয়েছিলেন সেরা জাতীয় গায়ক।

তার সঙ্গীত প্রতিভা মূলত ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। তিনি একজন আয়োজক ছিলেন এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন বাঁশি, পিয়ানো, এসরাজ ইত্যাদি বাজাতে জানতেন। তার মৌলিক কবিতাগুলোর জন্যে তিনি ব্যাপকভাবি নন্দিত এবং প্রশংসিত।

চলচ্চিত্র কর্মজীবন
তার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র “পরিবর্তন” মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। তার ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল “মহাভারতী” যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়।

১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত দো ভিঘা জামিন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। সলিল চৌধুরীর ছোট গল্প “রিকসাওয়ালা” অবলম্ভনে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটি তার কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়।

বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল দা ১৯৬৪ সালে চিম্মিন দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক সলিলদার মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

তিনি প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪০টির বেশি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র, এবং বেশ কিছু মারাঠী, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

গ্রন্থতালিকা
কবিতা
প্রান্তরের গান
সলিল চৌধুরীর গান (১৯৮৩)

পুরস্কার এবং স্বীকৃতি

১৯৫৮ মধুমতি ফিল্মফেয়ার সেরা সঙ্গীত পরিচালক
১৯৮৮ — সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার

 

সূত্র : উইকিপিডিয়া

বাংলা একাডেমি

ছবি : গুগল

 

মন্তব্য করুন