প্রায়শ্চিত্ত ।। আরাফ করিম

 কত হলো বয়স? এবছর চৌষট্টি হবে বোধয়। এখন আর ওসব মনে থাকে না। মনে রেখেই বা কি লাভ? জীবনের সকল হিসেবেই যখন গড়মিল তখন বয়সের হিসেব করা অর্থহীন।
নদীর ধারে আসেননি বহুদিন। আজ অফিস না থাকায় চলে এলেন। অফিস বলতে কোচিং; একটা কোচিঙে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে চাকরী করেন তিনি। সকালের এসময়টায় নদীর ধারে মানুষজন কম থাকে। ভালোই হয়েছে। তিনিও চাইছেন না এখন মানুষের মধ্যে থাকতে। একটু একা থাকতে চান। ভাবতে চান।স্ত্রী সারাজীবন বিনা অভিযোগে পাশে থেকেছেন। ভালোমন্দ কত সময় গেছে, সব সময় মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। অনেকসময় পারেননি অসুস্থতার কারনে। বেচারি সাড়া জীবন বিভিন্ন অসুখবিসুখেই কাটিয়ে দিল। কেনাকাটা খুব পছন্দ তার। একসময় যখন সংসারের অবস্থা ভালো ছিল তখন সপ্তাহে অন্তত দুবার যেতেন শপিঙে। আর এখন…কত বছর হয়ে গেল তেমন করে শপিঙে যান না। কখনো যদিও যান, তিনি খেয়াল করে দেখেছেন প্রয়োজনীয় জিনিসটার দোকানে ঢুকে কিনে চলে আসেন। সাড়ি, গয়না, জুতা, ক্রোকারিজের দোকানের দিকে পারতপক্ষে তাকান না, যেটুকু দেখেন তা আড়চোখে যেন তিনি বুঝতে না পারেন।

বড় ছেলেটা কিছুই করে উঠতে পারছেনা এখনো। কয়েকটা টিউশনি করে, ঐ দিয়েই চলে। কখনো চায় না কিছু। কিছু বলেও না। বাসায় থাকলেও বোঝা যায় না ও ঘড়ে আছে কি না। ছোটবেলায় কিন্তু ও এরকম ছিল না। অন্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু চুপচাপ ছিল বটে কিন্তু অনেক কথা বলতো। কত প্রশ্ন ছিল ওর – এটা কি, ওটা কি, এটা ওরকম কেন, সেটা ওরকম না কেন? উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে শেষে ধমক দিয়ে চুপ করাতে হতো। তাতে কিছুক্ষণ চুপ থাকতো তারপর আবার শুরু হয়ে যেত। সেই ছেলেটা এখন কথাই বলে না। শ্মশানের মতো শান্ত হয়ে গেছে।
লেখাপড়াটাও শেষ করতে পারল না। মাঝে সংসারের অবস্থা এত খারাও হয়ে গিয়েছিল যে ওকে লেখাপড়াটা ছেড়ে দিয়ে একটা দোকানে কাজ নিতে হলো। এখন টিউশনি করে চলছে। একটা ভালো চাকরীর চেষ্টা ও করছে কিন্তু তিনি কোন আশার আলো দেখছেন না কারণ ছেলেটা পর্যাপ্ত লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি আর ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্যও তার নেই।

মেয়েটা ছেলেটার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। ভাইবোনে বেশ মিল ওদের। একদিন হঠাৎ বলে দিল – ‘লেখাপড়া করবো না’। ছেলেটা বলেছিল করতে কিন্তু বেশি চাপ দেয়নি, হয়তো শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যেতে না পারার ভয়ে। সেই থেকে ঘড়ে বসে আছে। বিয়ের ব্যবস্থাও করে উঠতে পারছেন না অথচ মেয়ের বয়স থেমে নেই।

একটা সময় ছিল যখন তিনি প্রচুর রোজগার করতেন ব্যবসা করে। তখন ভাইদের অবস্থা বেশ খারাপ। আজ ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা যারযার মত করে গুছিয়ে নিয়েছে। বলতে গেলে সবাই অবস্থাই বেশ ভালো। ওদের দুর্দিনে তিনি পাশে দাঁড়াননি। আসলে মাথায়ই আনেননি তাদের কথা। মাঝে মাঝে বাড়ীতে গেলে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে আসতেন মাত্র। আজ যখন তার ছেলেমেয়েরা তার সামনে সদ্য জনাই কারা কোরবানির পশুর মত ছটফট করতে দেখেন তখন তিনি বুঝতে পারেন সেদিন তার ভাই আর ছেলেমেয়েদের কষ্ট।

ছোটবেলায় তিনি যে মিশন স্কুলে পড়তেন তার দেয়ালে নানান উক্তি লেখা থাকত। একটা উক্তি তার এখনো মনে আছে – ‘মানুষকে তার পাপের শাস্তি কিছুটা হলেও জীবদ্দশায় ভোগ করতে হয়’।

মন্তব্য করুন