অলোক আচার্য
অভিনয় জগত থেকি বিদায় নিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। একজন মানুষ দেশের মানুষের কাছে কিভাবে মূল্যায়িত হবে তা নির্ভর করে তার কর্মের ওপর। যে যে কাজে নিয়োজিত বিশেষ করে সৃজনশীল কাজ সেখানে তিনি কতটা দক্ষতার ছাপ রাখছেন বা নিজস্বতা সৃষ্টি করছেন তার ওপর নির্ভর করে তিনি কিভাবে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেবেন। এটিএম শামসুজ্জামান একেবারেই নিজস্বতা বা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে অভিনয় করে গেছেন নাটক বা চলচ্চিত্রে। তার সেইসব নিজস্বতা এতটাই জনপ্রিয় যে তা জনগণের চোখ জুড়িয়েছে। অভিনয়ে স্বার্থকতা এনেছে। দর্শক তার মুখের সংলাপ শুনে আনন্দ পেয়েছে। সেই সংলাপ নিজেরা বলার চেষ্টা করেছে।
এটিএম সাদা কালোর যুগ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাদুকরের মতো মন্ত্রমুগ্ধ রেখেছেন দর্শকদের। চলে যাওয়ার রাস্তায় সবাই থাকে। তবে যতদিন এসব সৃষ্টিশীল জাদুকর আমাদের মাঝে থাকেন ততদিন সেই ক্ষেত্র উপকৃত হয়। যা এতদিন হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগত বা নাট্যজগত তার কাছ থেকে বহুকিছু পেয়েছে। যার অভিনয় দেখে দশকের পর দশক ধরে মুগ্ধ থেকে দর্শককুল সেই জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, যিনি কি না বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটিএম শামসুজ্জামান নামেই পরিচিত। তার চলে যাওয়ার সাথে সাথে দর্শক হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল শূন্যতা। আর কোনোদিন সেই অভিনয়শৈলী দেখার সৌভাগ্য আমাদের হবে না। যে শূন্যতা আর কোনোদিনই পূরণ হবার নয়। সৃষ্টিশীল কাজ আসলে এমন একটি অভ্যন্তরীণ শক্তি তার বিকল্প কোনো শক্তি দিয়ে পূরণ করা যায় না।
কৌতূক অভিনেতা দিলদার বা নায়ক মান্নার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেমন আজ অভিনয় জগত শূন্য তেমনি আরও একটি শূন্যতা বৃদ্ধি পেলো তার বিদায়ের মধ্যে দিয়ে। একজন লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠককে কাছে টানেন। আবার সেই পাঠক যখন দর্শক হয়ে টিভি সেটের সামনে বসে অভিনয় দেখে তখন তাকে কাছে টানে একজন অভিনেতা।
অভিনয়ের সাফল্য দর্শককে কাছে টানার মাধ্যমে। খুব কম সংখ্যক এমন প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেতা থাকেন যারা এটিএম শামসুজ্জামানের মতো দর্শককে নিজের অভিনয় জাদুতে মুগ্ধ রেখেছেন বছরের পর বছর। তার শুরু থেকে শেষ অবধি সেই জনপ্রিয়তা। কোনো নাটক বা সিনেমায় তিনি থাকা অর্থই হলো সেই অভিনয় দেখার সুযোগ পাওয়া যা দেখার জন্য দর্শক অপেক্ষা করে থাকে। তার এ অভাব আর কোনোদিন পূরণ হবে না। অভিনেতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার এবং লেখকও। তবে তার বড় পরিচয় হলো অভিনেতা। ১৯৬১ সালে বিষকন্যা চলচ্চিত্রে সহকারি পরিচালক হিসেবে তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের দিকে অভিনেতা হিসেবে তার অভিনয় জীবন শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে খল চরিত্রে অভিনয় করলেও তিনি এই চরিত্রে আলোচনায় আসেন ১৯৭৬ সালে নয়নমণি চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। খল চরিত্র এবং কৌতুক দুই ধারাতেই তিনি ছিলেন শক্তিশালী। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ আজীবন সম্মাননাসহ বহু পুরুস্কার পেয়েছেন। ২০১৫ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মানুষের ভালোবাসা। এই যে বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে তিনি এটিএম শামসুজ্জামান হয়ে হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছেন তার থেকে বড় কোনো পুরস্কার হতে পারে না। কোনো লেখক বা অভিনেতার কাছেই সবচেয়ে প্রিয় হলো মানুষের ভালোবাসা। তা তিনি পেয়েছেন সারাজীবন। তিনি যেমন তার দক্ষতার সবটুকু দিয়ে বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্রকে উজাড় করে দিয়েছেন, দেশের নাটক,চলচ্চিত্রকে যেমন প্রাণ দিয়েছেন সেভাবেই বাংলার মানুষ তাকে ভালোবেসেছে উজাড় করে। তাই তার চলে যাওয়া কষ্ট দেয়। তার প্রস্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভিনয় জগত এক মহামূল্যবান অভিনেতাকে হারিয়েছে। তার অভিনয় করা চার শতাধিক চলচ্চিত্রের বহু খল ও কমেডি চরিত্রকে তিনি অমর করে গেছেন যেখানে তিনিই রাজা।
তার সাথে তুলনা করার কেউ নেই। কোনোদিন হবেও না। অভিনয় যে মানুষের কাছে পৌছানোর একটি শক্তিশালী মাধ্যম তা তিনি তার দীর্ঘ ছয় দশকের ক্যারিয়ারে অভিনয়ের মুগ্ধতা দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। নিজেকে তার অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যেখানে আজ তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার অসংখ্য অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে রামের সুমতি, রাজলক্ষী শ্রীকান্ত, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, অজান্তে, স্বপ্নের নায়ক,্ বড় বউ, অবুঝ মন, অভাগী, লাঠিয়াল, মলুয়া, যাদুর বাঁশিসহ আরও অনেক চলচ্চিত্র। টিভি নাটকেও তার অভিনয় ছিল সমান জনপ্রিয়।
ছোট পর্দায়ও তিনি রেখেছেন অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর। বিভিন্ন ধারাবাহিক নাটকে তার চরিত্র ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। অন্যতম হলো রঙের মানুষ, ভবের হাট ইত্যাদি। বস্তুতপক্ষে কাজের ক্ষেত্র এতটা বিশাল যে নামগুণে শেষ করতে বেগ পেতে হয়। এমন গুণী এক অভিনেতাকে আমরা আজ হারিয়েছি। বাংলা অভিনয় শিল্প হারিয়েছে এক সত্যিকারের মানুষকে যিনি অভিনয়কে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে।