রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা /হুমায়ুন কবীর

একেশ্বরবাদের উপর ভিত্তি করে রাজা রামমোহন রায় এক ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন — নাম ব্রাহ্মধর্ম।রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখের সহায়তায় তিনি ব্রাহ্মসমাজও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তান। কলকাতা জোড়াসাঁকোর এই বিখ্যাত রবি- পরিবার মেধা-মননে সামসময়িক হিন্দুদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এই পরিবার হিন্দু থেকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় —” আমি হিন্দু সমাজে জন্মিয়াছি এবং ব্রাহ্ম সম্প্রদায়কে গ্রহণ করিয়াছি।”হিন্দু থেকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তিনি বা তার পরিবার হিন্দু ধর্মের প্রচলিত অনেক আচার-অনুষ্ঠান বর্জন করেন।উল্লেখ্য যে,স্বদেশের হিন্দুদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে ভালোবাসা,সেটা হিন্দু ধর্মের কারণে না,দেশ প্রেমের কারণে, স্বাজাত্যবোধের কারণে। কবির মনে যে হিন্দুত্ব,সেটা অনেকটা পূর্ব পুরুষের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হিন্দু জাতীয়তাবোধজাত স্বজাতি – প্রেম থেকে উদ্ভূত। এই স্বজাতি বোধে উজ্জীবিত হয়ে তিনি হিন্দু দেব – দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে দ্বিধা করেননি। 

অন্যদিকে, হিন্দু পূর্ব পুরুষের ধর্মানুষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীনতা রবীন্দ্রনাথের মেধা- মননের অগ্রসরতার প্রমাণ। কবির এক কবিতায় দেখি–

“মুগ্ধ, ওরে,স্বপ্ন ঘোরে

যদি প্রাণের আসন- কোণে

ধূলায় গড়া দেবতারে

লুকিয়ে রাখিস সংগোপনে

চিরদিনের প্রভু তবে

তোদের প্রাণে বিফল হবে

বাহিরে সে দাঁড়িয়ে রবে

কত না যুগ – যুগান্তরে।”

শান্তি নিকেতনে মূর্তি রাখার পক্ষে ছিলেন না কবি।সামনে এক অবয়ব দাঁড় করিয়ে দেবতা- ভক্তি প্রদর্শন কবি- মনের অসীমতার পক্ষে না,বিপক্ষে। বস্তুতান্ত্রিকতা ছাপিয়ে কবি অসীমের পানে হেঁটেছিলেন।সসীমে আটকে থাকার মন তাঁর ছিল না।সসীমে মন আড়ষ্ট হয়, সজীব সত্তা হিসেবে থাকে না। কবি একটা গানে বলেছেন :

“তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই—–

কোথাও দুঃখ,কোথাও মৃত্যু কোথা বিচ্ছেদ নাই।”

ব্রাহ্মসমাজের সভায় কবি বসতেন।প্রার্থনা সংগীত রচনা করে দিতেন; বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসা পেতেন,কখনও বা পুরস্কারও পেতেন।

যৌবনে জমিদারি দেখাশোনা করতে কবি মাঝে মধ্যে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে যেতেন, থাকতেন। ওখানকার বাউল সাধুগুরুদের সংস্পর্শে এসেছিলেন কবি।গোরা উপন্যাসে কবি লিখেছেন : আলখাল্লা- পরা একটা বাউল নিকটে দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া গান গাহিতে লাগিল—-

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়, 

ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়।

এই বাউলরা অসাম্প্রদায়িক- মানবিক চেতনা ধারণ করতেন।এদের ধর্মমত ও মানবিক দর্শনে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হয়েছিলেন। লালন শাহ’র অধ্যাত্মবোধের সাথে পরিচয় ছিল কবির।লালনের গান ও রবীন্দ্রনাথের গান পাশাপাশি রাখলে এ কথার প্রমাণ মেলে।

এক সময় বাউলদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজের স্বাজাত্য খুঁজে পেয়ে বলেছিলেন:

আমি ব্রাত্য,আমি মন্ত্রহীন, 

রীতিবন্ধনের বাইরে আমার আত্মবিস্মৃত পূজা।

তবে এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, রবীন্দ্রনাথ বাউলের মরমি ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন বটে,তবে অন্ধ অনুকরণ করেন নাই। 

দিনে দিনে কবির কবি- খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কবিত্বের একটা ধর্ম আছে,সেই ধর্মে তাকে পেয়ে বসে।একটা বক্তৃতায় এক সময় কবি বললেন,আমার ধর্ম কবির ধর্ম। আমার সঙ্গীতের অনুপ্রেরণার মতো অদেখা এবং অচিহ্নিত পথ তা আমাকে স্পর্শ করে। আমার কবি জীবন যে রহস্যময় পথ ধরে গড়ে উঠেছে,আমার ধর্মীয় জীবনও তা-ই অনুসরণ করেছে। 

একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে গ্রহণ – বর্জনের মধ্য দিয়েই তার ধর্মীয় চেতনা অগ্রসর হয়েছে। উপনিষদের প্রভাব রবীন্দ্র চেতনায় স্পষ্ট হলেও তাঁর ধর্মীয় চেতনা মাঝে মধ্যেই বাঁক পরিবর্তন করেছে।শাস্ত্র- নির্ভরতা কবির প্রকৃতি বিরুদ্ধ ছিল, সেজন্য ব্রাহ্ম সমাজের সাথে তাঁর সখ্যতা আগাগোড়া অটুট না থেকে ফিকে হয়ে গেছে। কখনো তিনি আচার অনুষ্ঠান পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন আবার কখনও বিশ্লেষনাত্মক দৃষ্টিতে বিচার করেছেন।

ধর্মীয় চেতনার বিবর্তনের এক পর্যায়ে কবি কোন ধর্মের বন্ধনে নিজেকে আটকে রাখেননি। 

ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে শাস্ত্র- ধর্মের বাইরে আপন হৃদয় কেটে ধর্মপথ নির্মাণের বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি বলেন, বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম পাই সে কখনই আমার ধর্ম হয়ে ওঠে না।তার সঙ্গে কেবলমাত্র একটা অভ্যাসের যোগ জন্মে।ধর্মকে নিজের মধ্যে উদ্ভুত করে তোলাটাই মানুষের চিরজীবনের সাধনা।

রবীন্দ্রনাথের একটা স্বভাবজাত মানব ধর্ম ছিল।এক উদার মানব তন্ত্র তিনি হৃদয়ে পুষে বেড়াতেন। এই দিক থেকে তিনি কবীর, লালন, রমানন্দ প্রমুখ মুক্তমনাদের সমগোত্রীয়। স্মর্তব্য যে,জগতের মানবকূলের এক বৃহৎ অংশ ঐশী প্রত্যাদেশকে ধর্মের প্রধান উৎস হিসেবে গন্য করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের অনুসারী হিসেবে গন্য না। ইসলাম, ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম। এদের বিশ্বাসগুলো প্রায় কাছাকাছি, প্রচলিত মানব ধর্ম থেকে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ ভারতের প্রধান ধর্ম হিন্দু ধর্মের কাছাকাছি—– ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে না,ধর্মীয় সংস্কৃতির দিক থেকে। আর্যগণ যখন ভারত বর্ষের দিকে অগ্রসর হয়েছে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বিশ্বাসের সাথে পরিচিত হয়েছে, তখন বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বিশ্বাসের সংমিশ্রণ ঘটেছে এই হিন্দু ধর্মে।এই মিশ্রিত সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করেছে রবীন্দ্রনাথ। 

আকিদা- বিশ্বাসের দিক থেকে প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্মের নিকট না,দূর সম্পর্ক রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রেরিত পুরুষদের ‘পর অহি নাজিল করে মানুষের করনীয় – বর্জনীয় বিষয়গুলো স্পষ্ট করেছেন। স্রষ্টার প্রত্যাদেশ অনুযায়ী চলাকেই প্রেরিত পুরুষের অনুসারীরা ধর্ম মনে করেন।প্রেরিত পুরুষদের শিক্ষা আর রেখে যাওয়া কেতাব অনুসারীদের ইহকাল পরকালের পাথেয়, তাদের পালনীয় ধর্ম।তাদের কাছে ধর্ম হলো ওহী বা প্রত্যাদেশ থেকে প্রাপ্ত ঐশী বিধান। এখানে দীন আর ধর্ম (Religion) বিষয়ের পার্থক্য স্মরণে না রাখলে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অবশ্য করণীয় নির্দেশাবলি যার প্রতি আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হয় তা হচ্ছে দীন।এখানে সৃষ্টিকর্তার বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ নেই।ধর্ম বা Religion ঠিক তা না;ধর্ম বলতে কোন কিছুর অস্তিত্বকে ধারণ করা বোঝায়।দীন শব্দে ধর্মের চেয়ে ব্যাপকতাকে নির্দেশ করে। বাহ্ম ধর্ম, মানব ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত ধর্ম না। প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের সাথে হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে জন্মগ্রহণকারী রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

রবীন্দ্রনাথ নিজের ধী- শক্তি দিয়ে নিজের মধ্যে একটা আপন ধর্ম স্থির করেছিলেন। ১৯০৪ সনের একটা চিঠিতে কবি নিজের ধর্ম- ধারণা সম্পর্কে লিখেছিলেন।সেটা এমন—-

‘ ঠিক যাকে সাধারনে ধর্ম বলে,সেটা যে আমি আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢরূপে লাভ করতে পেরেছি, তা বলতে পারিনে।কিন্তু মনের ভিতরে ভিতরে ক্রমশ যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট উঠছে,তা অনেক সময় অনুভব করতে পারি। বিশেষ কোন একটা নিদৃষ্ট মত নয়,—- একটা নিগূঢ় চেতনা,একটা নতুন অন্তরিন্দ্রিয়। ‘

কবির এই নিগূঢ় চেতনা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়।কবি যখন বলেন, আমার ধর্ম কবির ধর্ম ; তখন আমরা অ-কবিরা কবির ধর্ম যে কী পদার্থ তা বুঝতে পারিনা।

কবি আপন শক্তি বলে পরম সত্ত্বার সন্ধান করেছেন। কিন্তু শুধুই কবির মনে হয়েছে —-” কেন মেঘ আসে হৃদয়- আকাশে,তোমারে দেখিতে দেয় না…..

এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ,তোমারে হৃদয়ে রাখিতে?”

 গীতাঞ্জলিতে অথবা নৈবদ্য কাব্যে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর বিশ্বাস প্রবল। গীতাঞ্জলিতে প্রভূ সম্পর্কে কবির আকুতিটা এমন —-“প্রভূ, তোমা লাগি আঁখি জাগে;

দেখা নাই পাই,

পথ চাই,

সেও মনে ভালো লাগে। “

 উপনিষদে রবীন্দ্রনাথের ভক্তি ছিল সত্য, কিন্তু তাঁর দার্শনিক মন উহার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে কবি- কল্পনার অতিশয়োক্তি আছে। ব্রাহ্ম ধর্মের ঈশ্বরের ধারণার সাথে কবির ঈশ্বর – ধারণা যে হুবহু এক তাও বলা শক্ত।সত্য বলতে কি, এই সৃষ্টিশীল কবি আপন হৃদয়ে পথ নির্মাণ করে চলেছেন। কিন্তু আপন শক্তি বলে পরম শক্তির সন্ধানে বেশ বাধা। সেই বাধার কথাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এভাবে —-“তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে। “ঈশ্বরচিন্তা বলি,ধর্মচিন্তা বলি আর আত্মচিন্তা বলি সসীম মানুষ আপন চেষ্টা বলে কি খুব বেশি দূর এগুতে পারে? না,পারে না। ব্যক্তিবিশেষের পরম সত্ত্বাকে খুঁজে ফেরার ব্যর্থতা কি রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও সত্য হয়েছিল? তাঁর শেষ লেখায় কি সেই ব্যর্থতার ইংগিতই রয়েছে? রোগ শয্যায় অসুস্থ কবির মুখে উচ্চারণ ছিল—প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নতুন আবির্ভাব — কে তুমি

মেলেনি উত্তর। 

বছর বছর চলে গেল

দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল

পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় — কে তুমি?

পেল না উত্তর। 

রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি অথবা নৈবদ্য কাব্যে প্রার্থনার নৈবদ্য সাজিয়েছিলেন। ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়ার দারুণ ব্যাকুলতা দেখি গীতাঞ্জলি অথবা নৈবদ্যে।জীবনের উপসংহারে কি সেই সমর্পিত প্রকৃতিতে ভাটা পড়লো? কবি বলেছিলেন সকল মানুষেরই ” আমার ধর্ম ” বলে একটা বিশেষ জিনিস আছে। রবীন্দ্রনাথের ” আমার ধর্ম” একজন সৃষ্টিশীল কবির ধর্ম। 

  বাউলদের জীবন জিজ্ঞাসা কবিকে মুগ্ধ করেছে। জীবনের প্রথমভাগে ব্রাহ্ম ধর্মের একেশ্বরবাদে হয়েছেন দীক্ষিত। উপনিষদের দর্শনে আস্থা রেখেছেন। আবার বলেছেন, “আমার ধর্ম কবির ধর্ম।

একদা সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখে বিরক্ত হয়ে” নাস্তিকতার আগুনে “ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি নাশ করার কথা বলে খেদ প্রকাশ করেছেন। রোগ শয্যায় উচ্চারণ করেছেন— তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী! মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে। কেউ কেউ বলে জীবনের শেষ প্রান্তে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর বিশ্বাস কিছুটা টলে গিয়েছিল।