প্রবীণ পরিচর্যার প্রচলিত প্রথা এবং তা পরিবর্তনের ভাবনা/হুসনুন নাহার নার্গিস

                                                                        

জন্মের পর আমাদের জীবন চলার পথ আরম্ভ হয় । প্রথমে শৈশব ক্রমান্বয়ে কৈশোর , যৌবন , মধ্য বয়স তারপর সর্বশেষ বার্ধক্য । বাচ্চাদের সামনে বিরাট ভবিষ্যৎ থাকে আর তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা অনেক আশা করতে থাকি । কিন্তু বার্ধক্য যখন চলে আসে আর কিছু তাদের কাছ থেকে আশা করার থাকে না ।

বৃদ্ধরা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চিরাচরিত ভাবে উত্তর না পাওয়া সেই একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয় আর তা হল “ জীবন মানে কী ?”

বেশীর ভাগ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, পাক-ভারত উপমহাদেশে, চায়না এবং আফ্রিকার দেশ গুলতে এই ধারনাই প্রচলিত যে বুড়ো হলে সন্তানরাই তাদের বুড়ো বাবা-মাদের দেখাশুনা করার দায়িত্ব নেবে ।

কিন্তু বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় এটা আর হয়ে ওঠে না । দেখার ইচ্ছা থাকলেও হয় না । তার পেছনে অনেক বাস্তব কারণ আছে।

প্রধান কারণ হলো আগে নারীদের কাজ ছিল বাড়ীর ভিতরে । যেমন রান্নাবান্না ,বাচ্চা জন্ম দান আর তাদের দেখাশুনা এবং বয়স্কদের দেখভাল করা ।

তা ছাড়া চাকুরীর ব্যাপারে সন্তান দূরে থাকে বা বিদেশে থাকে । অনেক গরীব পরিবারের পক্ষে টাকার অভাবে ভালো যতœ নিতে পারে না ।

তা ছাড়া প্রায় পত্রিকা তে দেখা যায় বয়স্ক দের প্রতি অবহেলার খবর ।

যেহেতু মেয়েরা এখন সংসারের ইনকাম-এর জন্য অর্থনৈতিক দিকটার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে ,নিতে বাধ্য হয় বা নিতে বলা হয় সরকার থেকে বা পরিবার থেকে , তখন তাদের জন্য দুই দিক সামলানো কঠিন হোয়ে পড়ে ।

অনেক সময় বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা থাকে বয়স্কদের যা করার জন্য স্কিল নার্স দরকার । যা বাড়ীর সদ্যসদ্যের দ্বারা সম্ভব নয় ।

অনেকের ধারনা ওয়েস্টার্ন দেশগুলো ম-বাবা ক বুড়ো বয়েসে দেখে না । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি নার্সিং হোমগুলো এত ভালো সেবা দেয় বয়স্কদের সেই জন্য তাঁরা সেখানেই থাকতে পছন্দ করেন । স্বাধীনতা আর সন্মানের সাথে কার্য-কারণ সম্পর্কযুক্ত” ।

এই সমস্ত দেশ গুলোতে দেখা যায় আরও কিছু সুন্দর ব্যবস্থা প্রবীণদের জন্য । যেমন যারা বাড়ীতেই থাকতে চান কিন্তু কিছু সময়ের জন্য কতগুলো যায়গা থাকে যেখানে সকলে তাঁরা একসাথে বসেন, গল্পগুজব করেন তার সাথে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে । থাকে বেড়ানর ব্যবস্থা । হালকা ব্যায়ামের ব্যবস্থা ।

প্রবীণদের জন্য থাকে হোম ডেলিভারি খাবার সরবরাহর ব্যবস্থা ।

তা ছাড়া তো আছেই নানা রকম যন্ত্রপাতি যা তাদের চলাচলের ব্যাপারটাকে সহজ করে দেয়। যেমন ৎবপষরহবৎ পযধরৎ, হুইল চেয়ার , সড়নরষরঃু বয়ঁরঢ়সবহঃ। রাস্তাতে চলাচল, বাসে, ট্রেনে আর এম্বুলেন্সে সহজে চলাচল আর উঠা নামার সুন্দর বাবস্থা ।

সব চেয়ে ভালো ব্যবস্থা একটা যা কিনা মৃত্যু যন্ত্রণাকে সহজ করতে সাহায্য করে। যাকে বলে চধষষরধঃরাব পধৎব. মৃত্যু আসবেই এবং সেটাকে মেনে নিতেই হবে । জীবনের শেষ সময়টিতে দরকার হাতে-নাতে সাহায্য আর বসড়ংড়হধষ সাহায.। উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালগুলোতে তার সুন্দর ব্যবস্থা আছে । যাকে বলা হয় যন্ত্রণাহীন মৃত্যু ।

আমাদের দেশে আছে নানা রকম সীমাবদ্ধতা । এখনো আমরা উন্নত দেশের সাথে তুলনা করতে পারব না । যেহেতু আমরা উন্নত দেশের দিকে যাচ্ছি তাই আমাদদেরকেও এসব নিয়ে ভাবতে হবে ।

চায়না , জাপান এ একই ব্যাপার । বাড়ীতেই যতদিন পারা যায় থাকে । বেগতিক হলে নার্সিং হোমে যায় । সেদিনই এই দেশদুটোতে আমাদের দেশের মতোই নিয়ম প্রচলন ছিল । সন্তান দেখবে বাবা মাকে । কিন্তু ঐ একই ব্যাপার ছেলেমেয়ে কাজ নিয়ে দূরে থাকে বাব-ামাকে দেখভাল-এর সময় দিতে পাে না । বাবা-মাকে ভালবাসে না বা তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না তা কিন্তু না ।

এমন একটা সময় আসে যখন কিনা ২৪ ঘণ্টা দেখভালের দরকার হয় । ডাক্তার-এর দরকার হতে পারে যখন তখন ।

প্রয়োজন হতে পারে নিয়মিত থেরাপিস্ট ।

এই সব কাজ সামলানোর জন্য শ্রম ভাগাভাগির দরকার । একলা কেউ সামলাতে পারবে না ।

এখন সময় এসেছে ভাবনা-চিন্তা বদলানোর । আগের চিন্তা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না । বুড়ো বয়সটা সবার আসবে । বুড়ো বয়স টা সন্মানের মধ্যে পাড়ি দেয়া দরকার । আমদের দরকার সবকিছুর সুবিধা সম্পন্ন ভালো নার্সিং হোম এর বাবস্থা । যেখানে থাকলে সন্তানও স্বস্তিতে থাকতে পারবে আর বয়স্করাও ভালো দেখভালের মধ্যে থাকবে ।

তার জন্য দরকার টাকা পয়সা । তা দেয়ার বা যোগাড়ের বাবস্থা আমরা কেই করতে হবে । যদি প্রথম থেকে উপার্জন করার পর থেকেই তা থেকে ইন্সুরেন্স এর মাধ্যমে বা ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে এর ব্যাবস্থা করা যায়, তবে তার সমাধান করা যায় ।

সরকারের সমাজ কল্যাণ দফতরকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।আমাদেরকেও পুরানো ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ।

যেমনভাবে বাচ্চাদের দেখাশুনা করার জন্য নার্সারি এবং সবার চিকিৎসার জন্য হেলথ সেন্টার থাকে তেমনভাবেই বয়স্কদের দেখাশুনার জন্য নার্সিং হোমের প্রয়োজন এখন সময়ের দাবী ।

বেসরকারি ভাবেও নার্সিং হোম খোলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে । যা কিনা থাইল্যান্ড আরম্ভ করেছে । পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো এই দেশের নার্সিং হোমে গিয়ে বুড়ো বয়সে থাকে ,কারণ ভালোভাবে দেখাশুনার জন্য নাম আছে থাইল্যা- এর মানুষদের । থাইল্যান্ড যেমন হলিডে করার জন্য একটা সুন্দর গন্তব্য স্থান , ঠিক এই দেশটা নার্সিং হোম করেও সুনাম অর্জন করেছে ।

থাইল্যান্ড ,ভারত মানব সেবা বিষয়টিকে ব্যাবসাতে পরিণত করেছে । চিকিৎসা করা তার সঙ্গে হলিডে, এ ব্যাবসা যেমন চলছে তেমন নার্সিং হোমের ব্যাবসাটাও ভালো । আমাদের দেশের মানুষ এটা ভেবে দেখতে পারে ।

আমাদের দেশের মানুষ সম্পত্তি করে ছেলে মেয়েদের জন্য রেখে যায়। এই প্রথা তেমন প্রচলন নয় পাশ্চাত্য দেশে। সন্তানরা নিজেদের সম্পত্তি নিজেরাই করে নেয় । নার্সিং হোমের খরচ দরকার মতো সেই বাড়ী দ্বারা চালানো হয় অনেক সময় ।

এই ব্যবস্থা আমাদের দেশে করা যায় কিনা দেখা যেতে পারে ।

ধনী দেশগুলোতে দরিদ্র প্রবীণরা নার্সিং হে মে বিনা পয়সাতে থাকতে পারে । তাছাড়া প্রবীণ হলেই যে কেউ ফ্রি মেডিসিন, ফ্রি বাস আর ট্রেন পাস পায়, পায় শীতের সময় ঘর গরম করা এলাউন্স । আমাদের দেশেও এই সুযোগ দেয়া এখন সময়ের দাবী ।

বয়স্কদেরও অধিকার আছে সন্মানের সাথে শেষ দিনগুলো গুজরান করা । এটা তাঁদের প্রতি হবে মানবিক সুবিচার । সরকার ,সমাজ পরিবার সবার এ দিকটাতে নজর দিতে হবে ।