নাসির আহমেদ কাবুল ।।
বিয়ের পর পাল্টে যায় নন্দিতার জীবন। জীবন যে কতটা বিচিত্র, নতুন করে উপলব্ধি করতে পারে সে। বাসর রাতে মাছুম ওর কাছে এলে লজ্জায় লাল হয়েছিল নন্দিতা। তখন তার মুখ শুকিয়ে কাঠ। ঠক্ঠক্ করে কাঁপছিল ভীরু কপোতীর মতো। প্রথম রাতটা সে হুঁ-হা ছাড়া আর কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। মাছুম বার-বার ওকে ছুঁতে চেয়েছে। নন্দিতা ‘না’ বলে এড়িয়ে গেছে। মাছুম তার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল বলে হয়ত ধৈর্য ধরেছিল। অথবা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। সে রাতে নন্দিতাকে সে কিছুই বলেনি। তারপর বিছানার এক পাশে গুটিসুঁটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল নন্দিতা।
সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে নন্দিতার। তখন মাছুম চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। কারণ মাছুমের কলেজ খোলা। যাবার সময় বলে গিয়েছিল, ছুটি পেলে আবার আসবে সে।
দু-সপ্তাহ পর মাছুম আবার এসেছিল। বার-বার ছুঁতে চেয়েছিল নন্দিতাকে। সেদিন রাতেও নন্দিতা কাঁপছিল। বার-বার মাছুমের আহŸান প্রত্যাখ্যান করেছিল সে। মাছুম যখন বলল, ঠিক আছে তুমি যখন চাও না, তখন আমি কাল চলে যাবো। যদি কোনদিন আসতে বল, তখন না হয় আসব।
নন্দিতার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে যায়—‘না, যেও না।’
– কেন?
– জানি না।
¬- আমি কি তোমাকে স্পর্শ করতে পারি?
নন্দিতা কোন উত্তর দিতে পারেনি। নন্দিতার এই চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নেয় মাছুম। তখন মাছুম নন্দিতার ঠোঁটে কিস করলে নন্দিতা প্রতিবাদ করে বলে, তুমি আমাকে কিস করলে কেন?
সে কথার উত্তর না দিয়ে নন্দিতাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় মাছুম। নন্দিতা তখন বাধা দিতে পারেনি। তার সমস্ত শরীর কাঁপছিল তখন। সে রাতে নন্দিতার ভালোলাগার তৃপ্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। নন্দিতা নিজেকে পুরোপুরি মাছুমের হাতে সঁপে দিয়েছিল সে রাতে।
এরপর দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। একদিন মাছুমের মা ও আপার সঙ্গে শপিংয়ে যায় নন্দিতা। সে সময় মাছুমের প্রতিবেশী এক মহিলার সঙ্গে দেখা হলে নন্দিতা নিজেকে মাছুমের স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়। মহিলা বলে—কেন, ‘মাছুমের আগের ওয়াইফের সঙ্গে কি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? যাক, ভালোই হয়েছে। ঝামেলা টিকিয়ে না রাখাই ভালো।’
এ সময় মাছুমের আপা মহিলাকে টেনে দূরে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ ফিসফিস করে কিছু বলে। ফিরে এসে আপা বলে, উনি আসলে ভুল বুঝছেন। মাছুমের ওয়াইফ বলে যাকে সন্দেহ করেছে, সে মাছুমের এক ভাইয়ের স্ত্রী। মাছুম বউ পাবে কোথায়?
বিষয়টিকে উড়িয়ে দিতে পারেনি নন্দিতা। এরপর থেকে সারাক্ষণ মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে তার।
রাতে বিষয়টি আবার তোলে নন্দিতা। মাছুম বার-বার ‘কিছু না’ বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। নন্দিতার ভীষণ কান্না পায় তখন। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সে। মাছুম নন্দিতাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, তুমি তা জানো না?
মাছুমের কথায় নন্দিতা যেন কেমন হয়ে যায়। বার-বার মনে হতে থাকে, মাছুমকে সে ভুল বুঝছে না তো? এরপর রাতে আবারও দৈহিক সম্পর্কে জড়ায় দুজনে। শেষ পর্যায়ে মাছুম প্রচÐরকম এক্সাইটেড হয়ে বলে—‘আই লাভ ইউ শ্রাবন্তী।’ সঙ্গে-সঙ্গে নন্দিতা প্রতিবাদ করে বলে, কে শ্রাবন্তী? কাকে কী বলছো তুমি?’
মাছুম বলে, সরি, আসলে এ সময় আমার মাথা একদম ঠিক থাকে না। শ্রাবন্তী নামে কলেজ জীবনে আমার এক বান্ধবী ছিল। আমার মুখে শ্রাবন্তী নামটি ওরই।
নন্দিতা ভাবে হয়ত ভুলেই শ্রাবন্তী নামটা বলেছে মাছুম। কিন্তু নন্দিতার ভুল ভাঙ্গে একদিন দুপুরের পর। দুপুরের খাওয়ার পর মাছুম ঘুমিয়ে পড়লে ওর মোবাইলে একটি কল আসে। বার-বার ফোন আসায় মাছুমের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে বলে নন্দিতা ফোন রিসিভ করে।
নন্দিতা হ্যালো বললে ওপাশ থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে আসে—এটা মাছুমের নাম্বার না?
নন্দিতা বলে, হ্যাঁ এটা মাছুমেরই নাম্বার। আপনি কে?
– আপনি ফোনটা রিসিভ করলেন কেন?
– তাতে আপনার সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
– কী বলছেন! সমস্যা আমার হওয়ার নয়, তো কার হওয়ার কথা? কে আপনি?
– আমি মাছুমের স্ত্রী।
– কী বললেন!
– বললাম তো আমি ওর স্ত্রী।
– আাপনি মাছুমের স্ত্রী! মাথা খারাপ হয়েছে আপনার?
– মাথা খারাপ আমার নয়, আপনার হয়েছে।
– সত্যি করে বলুন তো, আপানি কে?
– বললাম তো আমি মাছুমের স্ত্রী, ও আমার বর। কয়েক মাস হল আমাদের বিয়ে হয়েছে।
– ফোনটা মাছুমকে দিন।
– আপনি কে যে ঘুম ভাঙ্গিয়ে ওকে আপনার ফোন দিতে হবে?
– আমি কে? আমি ওর স্ত্রী।
নন্দিতা দমে যায় না। ফোনের লাইন কাটতে-কাটতে বলে, যত্তসব মাথা খারাপের দল!
নন্দিতা ফোনের সুইচ অফ রাখে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মাছুমের ঘুম ভাঙলে নন্দিতা ফোনের ঘটনা খুলে বললে মাছুম প্রথমে কোন কথারই উত্তর দিতে পারেনি। হাঁ-না বলে কোনরকম পাশ কাটাতে চেষ্টা করেছে।
– তুমি সত্যি করে বলো, তোমার কি বউ আছে?
– বউ! কী বলছো তুমি, বউ আসবে কোত্থেকে?
– না হলে তোমার নাম্বারে যে মহিলা ফোন করল, সে কে?
– আমি কী করে বলব?
– তুমি বলবে না তো কে বলবে? তোমার নাম্বার সে পেল কোত্থেকে?
– তার আমি কী জানি?
– ঠিক আছে। ওর নাম্বারে আমি কল করছি, তুমি স্পিকার অন করে ওর সঙ্গে কথা বলো।
এতে মাছুমের ঘোরতর আপত্তি। বলে, ‘ছেড়ে দাও তো!’
– ছেড়ে দেবো মানে? আমার বরকে আরেকজন মহিলা স্বামী বলে দাবি করবে, আর আমি ছেড়ে দেবো? কী বলছ তুমি?
নন্দিতা নিজের ফোন থেকে ফোন করে স্পিকার অন রাখে। অপর প্রান্ত থেকে আগের সেই মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘কে বলছেন?’
নন্দিতা বলে, আমি মাছুমের স্ত্রী। আপনি কে?
– পাগল নাকি? একটু আগেই তো আপনার সঙ্গে কথা হল। দেখুন ইয়ার্কি করার সময় নয় এটা। ওর মোবাইল বন্ধ। ফোনটা দয়া করে ওকে দিন।
– সত্যি বলছেন আপনি মাছুমের স্ত্রী?
– এসব নিয়ে কেউ আবার ইয়ার্কি করে নাকি?
– আপনার নাম কি শ্রাবন্তী?
– আপনি জানলেন কী করে? মাছুম বলেছে বুঝি? হ্যাঁ, আমার নাম শ্রাবন্তী।
নন্দিতা বলে, প্রমাণ দিতে পারবেন যে মাছুম আপনার স্বামী?
শ্রাবন্তী বলেন, শুনুন, আপনি কে আমি জানি না। তবে এটা জেনে রাখুন যে, মাছুম আমার স্বামী। আমাদের দুই বছরের একটি সন্তানও আছে। আমি প্রমাণ করতে পারব। আপনি না হয় প্রমাণটা আগেই দিন।
– সত্যি প্রমাণ চান?
– সত্যি-মিথ্যের কিছু নেই। আপনি দাবি করছেন মাছুম আপনার স্বামী, আমিও দাবি করছি। আপনি প্রমাণ দিন। আমিও দেবো।
– ওকে ওয়েট, দিচ্ছি।
নন্দিতা মোবাইল থেকে বিয়ের ছবি আপলোড করতে চাইলে মাছুম মোবাইল সেট কেড়ে নেয় ওর হাত থেকে। এতে নন্দিতা ক্ষেপে যায়।
– তুমি ফোনটা কেড়ে নিলে কেন?
– আরে ছেড়ে দাও তো! কোথাকার এক পাগল মহিলাকে নিয়ে পড়েছ তুমি!
– কাকে পাগল বলছ তুমি? ওই মহিলা মিথ্যে কিছু বলেনি। তুমিই মিথ্যে বলেছ আমাকে। তুমি প্রতারক, ঠগ—অত্যন্ত নিচ তুমি। আই হেইট ইউ মাছুম, আই হেইট ইউ!
নন্দিতা ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
আপা, দুলাভাই বেড রুমে ছিলেন। নন্দিতা আপাকে গিয়ে বলে, এ কী করলে তোমরা? আমার জীবনটাকে শেষ করে দিলে!
আপা হতভম্ব হয়ে পড়ে। বার-বার জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে খুলে বলবি তো!
– বার-বার বলেছিলাম, জেনেশুনে তারপর যা কিছু করার করো। কিন্তু তোমরা আমার কথা শুনলে না! আপা মাছুম একটা প্রতারক, জোচ্চোর, ঠগ…
দুলাভাই বলল, মাথা ঠাÐা করো, খুলে বলো কী হয়েছে?
– দুলাভাই, ওই লোকটা আগেও একটা বিয়ে করেছে। ওর একটি সন্তানও আছে।
– কে বলল?
– কে আবার! ওর বউ ফোন করেছিল। আমি রিসিভ করি। আমি মাছুমের স্ত্রী পরিচয় দিলে মহিলা প্রমাণ চায়। আমি প্রমাণ দেয়ার জন্য মোবাইলে আমাদের বিয়ের ছবি পাঠাতে চাইলে মাছুম মোবাইল কেড়ে নিয়ে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে।
– কী বলছ তুমি!
– যা বলছি সত্যি। একটুও মিথ্যে নয়। দুলাভাই, ওর বউয়ের নাম শ্রাবন্তী। শ্রাবন্তীর নাম গত রাতে ওর মুখে ঘোরের মধ্যে শুনেছি। যে মহিলা ফোন করেছিল সেও স্বীকার করেছে যে, ওর নাম শ্রাবন্তী। ওদের দু’বছরের একটি ছেলে আছে।
নন্দিতার কথা শুনে আপা ও দুলাভাই প্রচÐরকম ক্ষেপে যান। বলেন, চলো তো দেখি, যদি সত্যি সে রকম কিছু হয় তো…।
দুলাভাই নন্দিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান মাছুমের কাছে। ওদেরকে দেখে মাছুম দুলাভাইয়ের পায়ের উপর পড়ে বলে, দুলাভাই বিষয়টি আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে।
দুলাভাই বলেন, সে কথা পরে হবে। আগে বলো তুমি কি এর আগেও একটা বিয়ে করেছ? তোমার বউ আছে? ওর নাম কি শ্রাবন্তী? তোমাদের একটি সন্তান আছে?
মাছুম সব স্বীকার করে বলল, এতে আমার কোন হাত ছিল না। মা আর আপা আমাকে এ বিয়েটা করতে বাধ্য করেছে। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি নন্দিতাকেই শুধু বউয়ের মর্যাদা দেবো। শ্রাবন্তীকে ডিভোর্স দেবো।
দুলাভাই বললেন, যথেষ্ট হয়েছে মাছুম। আর নয়। একটা বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করতে বলেছে আর তুমি বিয়ে করে ফেললে?
মাছুম এবার নন্দিতার হাত ধরার চেষ্টা করে বলে, তুমি আমাকে ক্ষমা করো নন্দিতা। কথা দিচ্ছি…
নন্দিতা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, কী কথা দেবে তুমি? কী ভাবছ, তোমার কথা বিশ্বাস করব আমি? ছিঃ মাছুম ছিঃ। তুমি আমাকে এমন করে ঠকালে! তুমি দু-দুটি মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলে! কিন্তু আমি তা হতে দেবো না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। জাস্ট আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ মাছুম। নন্দিতা ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
সে রাতেই সিদ্ধান্ত হয়, নন্দিতা মাছুমকে ডিভোর্স দেবে। মিউচুয়ালি না হলে মাছুমের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে ডিভোর্স মামলা করবে নন্দিতা। তখনই মাছুম তার ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কেউ একবার ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি।
সপ্তাহখানের মধ্যে মাছুমের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যায় নন্দিতার।