পর্ব ৩
সকাল আটটার দিকে দরজায় ঠক্-ঠক্ শব্দ শুনে চোখ মেলে নন্দিতা। বাইরে আপার কণ্ঠ—‘দরজা খোল নন্দিতা। এখনও ঘুমাচ্ছিস?’
নন্দিতা উত্তর দেয় না। উঠে দরজা খুলে দেয়। আপা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছছে। বোঝা যায় রান্নাঘর থেকে এসেছে। তার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম চক-চক করছে। আপা বলে, ‘এত বেলা পর্যন্ত ঘুমালি! ওরা তোকে দেখতে আসবে দশটায়। আর তুই কি না…!’
: দেখতে আসবে মানে কী?
: এর আবার মানে হয় না কি?
: দেখো আপা, ঘটা করে দেখাদেখি পছন্দ নয় আমার। তাছাড়া ওই লোকটা তো আমাকে দুবার দেখেছে। কথা বলেছে।
: ওমা! লোকটা দেখলেই হয়ে গেল?
: হবে না কেন?
: ওর গার্জিয়ান দেখবে না?
: আমাকে কি গার্জিয়ান বিয়ে করবে?
: ওদেরও তো একটা মতামত আছে। আচ্ছা তুই বল, আমরা ছেলেটাকে না দেখে তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো? আমাদেরও তো দেখতে হবে।
: তোমার কথা বুঝতে পারছি। পাত্রীপক্ষের ছেলেকে দেখা আর পাত্রপক্ষের মেয়ে দেখা এক নয়।
: কেন এক নয়?
: আচ্ছা, আমাকে বলো, তোমরা ছেলেটার কী-কী দেখেছ?
: আমি তো দেখিনি, তোর দুলাভাই দেখেছে। ও যা বলেছে তা হচ্ছে¬—ছেলেটি স্মার্ট, ভদ্র, শিক্ষিত।
: তাহলে তুমি দেখনি, শুনেছ। দেখা আর শোনা এক কথা নয় আপা। আচ্ছা তুমি কী শুনেছ বলো তো?
: আর কী বলব?
: ছেলেটার চরিত্র কেমন, কোনো অ্যাফেয়ার্স আছে কি না। এটা কত নাম্বার বিয়ে। এসব জানো?
নন্দিতার কথা শুনে আপা হাসে আর বলে, ‘কত নাম্বার বিয়ে আর হবে! তোর মত একটা ভার্জিন মেয়েকে দুই নাম্বারের বউ বানানোর জন্য কেউ আসে নাকি?’
: আসতেও তো পারে। দেখো আপা, ভালো করে খোঁজ-খবর নাও। সবকিছু বিশ্বাসের ওপর ছেড়ে দিও না। তোমাদের কথা আমি ফেলবো না, কথা দিলাম। বাবা মারা যাবার পর আমার সব দায়িত্ব তোমরাই নিয়েছ। তোমাদের মতামতকে উপেক্ষা করার মত মানসিকতা আমার নেই। শুধু ছেলেটা স্মার্ট বললে চলবে কেন? আমি কি কম স্মার্ট? এসএসসি ও এইচএসসি-তে গোল্ডেন পেয়েছি। ভার্সিটিতে ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছি, আশা করছি ফার্স্টক্লাস পাবো। আমাকে তো শিক্ষিতাও বলা যায়, এতে কোন অমত আছে তোমার?
আপা হেসে বলে, ‘না, তা থাকবে কেন? আমার বোনটাকে আমি চিনি না! তোর মতো স্মার্ট, শিক্ষিতা আর গুণী মেয়ে এই তল্লাটে কটা পাওয়া যায়?’
: তাহলে তো হয়েই গেল। ছেলেটা মত দিলে আর আমার মত থাকলে বিয়ে হবে। না হলে হবে না।
: শোন, মাছুমের আপা-দুলাভাইয়ের আসার সময় হয়ে এলো। ওদের জন্য চা-নাস্তা যোগাড় করতে হবে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। নটা বাজে। দশটার মধ্যে ওরা চলে আসবে।
নন্দিতা হঠাৎ খিল-খিল করে হেসে ওঠে।
আপা জিজ্ঞেস করে, আবার হাসার কী হলো?
: কী নাম বললে? মাছুম?
: হুঁ। ছেলেটির নাম।
: ওঃ মাছুম—কচি খোকা বুঝি!
আবারও হেসে ওঠে নন্দিতা। নন্দিতা বলে, শোনো আপা, ওরা কোরবানীর গরুর মতো যদি আমাকে দেখতে চায়, তাহলে কিন্তু খবর আছে! হুঁ।
: মানে?
: মানে বুঝলে না?
: না। বুঝিয়ে বলো?
: এই ধরো, ওরা বলল—এই যে মেয়ে, তোমার চুলগুলো একটু খুলে দেখাও তো। এটা গরুর লেজ দেখার মতো। যদি বলে একটু হাঁটো—তার মানে আমি খোঁড়া কিনা! এসব মানব না আমি।
: আমরা তো মেয়ে!
: মেয়ে বলে যা ইচ্ছে তাই করবে নাকি! আর মেয়ে বলে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হবে?
আপা কথা না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। যেতে-যেতে বলল, শাড়ি পরবি কিন্তু…
: নন্দিতা উচ্চকণ্ঠে বলে, না পরব না। আমি কি বউ, যে শাড়ি পরতে হবে? স্যালোয়ার-কামিজই পরব। সবচেয়ে খারাপটা পরব। আর সাজগোজও করব না। ওরা আমাকে খারাপভাবে দেখে যদি মত দেয় দেবে। না দেয় দেবে না। ব্যাস।
এর মধ্যে দুলাভাই এসে আপার মতো বললেন, এখনও তৈরি হওনি? ওরা তো এসে পড়বে এখনি!
: তৈরি মানে কি দুলাভাই? আমি তো তৈরি হয়েই আছি।
: এভাবে কেন? একটু সাজগোজ করবে তো। নাকি?
: আমি কি তোমাদের বোঝা হয়ে গেলাম দুলাভাই?
: কেন, ও কথা বলছ কেন?
: তাহলে আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য এতো অস্থির হচ্ছো কেন তোমরা? আমি তো চেয়েছিলাম পড়াশুনাটা শেষ করি। তারপর না হয়…
: আমিও তাই চেয়েছিলাম। তবে কিনা হঠাৎ ছেলেটার খোঁজ পেলাম। ভালো ছেলে, হাতছাড়া করতে চাই না। তাছাড়া তোমার যদি পছন্দ না হয় তো বিয়ে হবে না। তুমি কেন বোঝা হতে যাবে? আচ্ছা বলতো, সে ধরনের কোন কিছু তোমার আপা বা আমার কাছ থেকে পেয়েছ কখনও?
: না, তা পাইনি।
: তাহলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমি একটা ফোন করে নিচ্ছি। দেখি ওরা কতদূর এলো।
দুলাভাই চলে গেলে নন্দিতা ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ নিজেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে আয়নায়। হঠাৎ সাগরের কথা মনে পড়ে নন্দিতার। সাগর একদিন বলেছিল, ‘তোর চোখ দুটি বেশ সুন্দর!’
: কী বললি?
নন্দিতার এই কৈফিয়তটার মধ্যে একটু ঝাঁঝ ছিল হয়ত। হঠাৎ একটি ছেলের মুখে প্রশংসা শুনলে সব মেয়েই একটু রোমাঞ্চিত হয়। নন্দিতাও হয়েছিল। তাই কৈফিয়তটার সুরটা একটু অন্যরকম হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা ইচ্ছেকৃত নয়। সাগর ওর কথায় ভয় পেয়ে যায়। বলে, ‘না, তেমন কিছু না।’ সাগরের কথা নন্দিতা শোনেনি তা নয়, তবে আবারও শুনতে চায় নন্দিতা। বলল, ভয় পাচ্ছিস কেন? বল না, কী বলছিলি? এবার ওর কণ্ঠ শান্ত-ধীর। সাগরের মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে জানতে চাওয়ার ব্যাকুল আগ্রহ নন্দিতার দুই চোখে। সাগর তা বুঝতে না পেরে বলে, ‘না থাক।’
: থাকবে কেন? বল কী বলছিলি?
: বাদ দে তো!
: বাদ দেবো কেন? যা বলছিলি, আবার বল না শুনি।
: বলছিলাম…
: এত দ্বিধা করছিস কেন?
: তোর চোখ দুটির কথা বলছিলাম।
: কী বলছিলি?
: খুব সুন্দর তোর চোখ।
নন্দিতা খিলখিল করে হেসে বলে, দূর বোকা! এটা বলতে তোর এতো দ্বিধা?
: কিছু মনে করিসনি তো?
: এতে মনে করার কী আছে?
নন্দিতার কাছে সাগর অন্য পাঁচজন বন্ধুর মত। অন্য পাঁচজন থেকে মেধাবী সাগরকে স্যাররা একটু বেশি পছন্দ করে। এটা অনেকেই মেনে নিতে পারে না। তবে নন্দিতার এতে কিছু যায়-আসে না। এটা হয়ত সাগর বুঝতে পারে। এ জন্য হয়ত ও নন্দিতার কাছে একটু বেশি ঘেঁষে। এতদিন এটাই মনে করত নন্দিতা। কিন্তু আজ নন্দিতার যেন কী মনে হল, সবকিছু এলোমেলো মনে হল আজ তার। তাহলে কি সাগর ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ভালোবাসতো নন্দিতাকে? না হলে একাকী এই কথাটি বলার মানে কী ছিল?
নন্দিতা বলল, হঠাৎ চোখ সুন্দরের কথা মনে হল কেন তোর?
: এমনিই। তুই কিছু মনে করিস না।
: আমি কী আর মনে করব? আচ্ছা, আমার কি শুধু চোখই স্ন্দুর, আর কিছু না?
: না, থাক।
: থাকবে কেন? বল না, আর কী সুন্দর মনে হয় তোর?
: রাগ করবি না তো?
: কেন, রাগ করব কেন? তোর মত ব্রিলিয়ান্ট একটি ছেলের মুখে প্রশংসা শুনতে সব মেয়েরই ভালো লাগবে। আমারও লাগে।
এ কথা শোনার পর সাগর নন্দিতার চোখের দিকে তাকায়। কিন্তু চোখ স্থির রাখতে পারে না। বলে, তোর সবই সুন্দর…
কথা শেষ হয় না ওদের। কথার মধ্যে অন্যবন্ধুরা এসে পড়লে কথার ছেদ পড়ে সেখানেই।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজ এতদিন পর সাগরের কথা খুব মনে পড়ছিল নন্দিতার। সাগরের বিরুদ্ধে স্যারদের কাছে নালিশ করার বিষয়টি কিছুতেই ভুলতে পারছে না আজ সে। এ জন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে করে নন্দিতা।
এরই মধ্যে আপা এসে তাড়া দেয় নন্দিতাকে। শাড়ি বেছে দিয়ে যায়। তার সঙ্গে বøাউজ, পেটিকোট সব। কিন্তু নন্দিতার এক কথা—সে বউ নয়, সুতরাং ওগুলো পরার প্রশ্নই ওঠে না।
শেষমেশ নন্দিতা স্যালোয়ার-কামিজই পরলো। ওর প্রিয় নীল রঙের কামিজের সঙ্গে কালো রঙের পাজামা পরলো নন্দিতা। ওড়নাও পরলো কালো। নিজেকে আয়নায় দেখে ফিক করে হেসে উঠে বলে: বুদ্ধু কোথাকার!
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ শুনতে পায় নন্দিতা। বুঝতে পারে ওরা এসে গেছে। ওদেরকে দেখার এতটুকু আগ্রহ নেই নন্দিতার। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতেই ভালো লাগে তার।
প্রায় মিনিট দশেক পর আপা এসে নন্দিতাকে নিয়ে যায় ড্রইংরুমে। নন্দিতা ওদেরকে দেখে সালাম দেয়। মহিলাকে প্রথম দর্শনে ভালো লাগেনি নন্দিতার। দ্বিতীয় দর্শনেও ভালো লাগবে বলে মনে করল না সে।
মহিলা নন্দিতাকে বসতে বলে। নন্দিতা বসে।
মহিলা জানতে চায়, নন্দিতা কী পড়ছে, লেখাপড়া করে কী করতে চায়, রান্না করতে জানে কিনা, এসব। মহিলা নন্দিতার আঙুলের আংটি পরায়। আংটিটি দিকে একনজর তাকায় নন্দিতা। পছন্দ হয়নি আংটি। সোনার তৈরি, কিন্তু বেশি খাঁদ মেশানো দেশী স্বর্ণের আংটি। নন্দিতা কম দামী কিছু পছন্দ করে না।
ওরা চলে গেলে নন্দিতা কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মনমরা হয়ে ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটতে থাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর সে বাসায় ফেরে।
দুপুরে খেতে বসে দুলাভাই জিজ্ঞেস করেন, তুমি তো ছেলেটিকে দেখেছ। ওদের আপা-দুলাভাইকেও দেখলে। আমরা কি এগুতে পারি?
নন্দিতা কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল, আমি তো আগেই বলেছি, আপনাদের সিদ্ধান্তকে মেনে নেব আমি।
নন্দিতার কথা শুনে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।
পনের দিনের মধ্যে নন্দিতার বিয়ে হয়ে যায় মাছুমের সঙ্গে।
চলবে