নন্দিতার অন্য আকাশ/নাসির আহমেদ কাবুল

[ পর্ব ৫ ] ।।

মাছুম চলে যাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে নন্দিতা। কাউকে কষ্টের কথা বলতে না পেরে একাকী নীরবে-নিভৃতে যন্ত্রণা সহ্য করে সে। আপা-দুলাভাই কিছুদিন ঘরে থাকতে বললেও নন্দিতা যথারীতি ক্লাস করে। বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করে সব যন্ত্রণা ভুলে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু না, কিছুতেই সে মাছুমকে ভুলতে পারে না। আবার মাছুমের অপরাধকেও ক্ষমা করতে পারে না কিছুতেই।

ডির্ভোসের ব্যাপারে নন্দিতা অমত করেনি। বলেছিল, ওই লোকটা প্রতারক। ও দু-দুটি মেয়েকে ঠকিয়েছে। ওর সঙ্গে ঘর করা যায় না। নন্দিতার মা, ভাইবোন ও দুলাভাইয়েরও একই অভিযোগ মাছুমের বিরুদ্ধে। তাই মুসলিম পারিবারিক আইনে মাছুমকে ডিভোর্স দিতে কোন সমস্যা হয়নি নন্দিতার।

ডিভোর্সের এক মাসের মাথায় একদিন মাছুমের দুলাভাই ফোন করে নন্দিতাকে। সেদিন ঘরে আপা-দুলাভাই কেউ ছিল না। মা তার রুমে ঘুমাচ্ছিলেন। তিন-চারবার রিং হলেও নন্দিতা ফোন রিসিভ করতে চায়নি। কিন্তু পারেনি। শেষ পর্যন্ত ফোন রিসিভ করে নন্দিতা। ওপাশ থেকে মাছুমের দুলাভাই বলছিল, কেমন আছো নন্দিতা?

নন্দিতা স্বাভাবিক হতে একটু সময় নেয়। কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলে বলে, ভালো। আপনি?

: আমি ভালো। তবে মাছুম…

: প্লিজ দুলাভাই, ওর কথা বলবেন না।

কথা শেষ করতে পারে না মাজহার সাহেব।

: তোমার ভুল হচ্ছে নন্দিতা।

: ও আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ওকে আমি ক্ষমা করতে পারব না কিছুতেই।

: শোনো নন্দিতা, এ বিষয়টিতে ওর কোন হাত ছিল না। ওর স্ত্রী শ্রাবন্তী মেয়েটা ভালো নয়। বিয়ের আগে ওর একটা অ্যাফেয়ার্স ছিল।

: বিয়ের আগে অ্যাফেয়ার্স ছিল, তাতে কী? বিয়ের পর কী অপরাধ করেছে শ্রাবন্তী?

নন্দিতার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি মাজহার সাহেব। বললেন, ওকে আমরা কেউ পছন্দ করি না।

সহজ-সরল মানুষগুলো যে কোন পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে। যে কোন অবস্থায় নিজের কথাটি খুব জোর দিয়ে বলতে পারে। যদিও সহজ আর সরল মানুষ পদে-পদে ঠকে যায়। নন্দিতাও সেদিন মাছুমের দুলাভাইয়ের কথাগুলো খুব সহজে ও তীর্যকভাবে বলতে পেরেছে। কোনো লজ্জা, ভয়, দ্বিধা তাকে আটকাতে পারেনি।

নন্দিতা বলে, কলেজ জীবনে একটা ছেলে আমাকে ভালোবাসতো। সে কথা তো ওকে বলেছি। ও তো বলল, এটা বিয়ের আগের কথা। এটা কোন সমস্যা নয়। তাহলে শ্রাবন্তীর বিষয়টি সমস্যা হবে কেন? কেন ওকে বিয়ের আগের একটি বিষয় নিয়ে দোষারোপ করা হবে? একদিন তো এই একই কারণে আমাকেও অপছন্দ করতে পারে সে। তখন আমার অবস্থাও যে শ্রাবন্তীর মতো হবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে আমাকে? এসব কথা এখন কেন শুনাচ্ছেন আপনি? এগুলো এখন শুনতে চাই না আমি।

: প্লিজ, তুমি আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করো।

: কী বুঝব? আমি যখন আমার অতীত জীবনের কথা মাছুমকে বললাম, তখন সে কেনো বললো না যে, তার আরো একটি বউ আছে।

: ও তোমাকে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর আপা ও মা বিষয়টি ফাঁস করতে না করেছিলেন। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমার সঙ্গে ডিভোর্সের পর ও খুব কান্নাকাটি করছে।

: সরি দুলাভাই, এগুলো আমি শুনতে চাই না।

মাজহার সাহেব নাছোরবান্দা। বার-বার সে নন্দিতাকে বলতে লাগল, মাছুমকে নিয়ে সে সকালে জিয়া পার্কে অপেক্ষা করবে। মাছুম শেষবারের মতো নন্দিতার সঙ্গে শুধু একবার কথা বলতে চায়। নন্দিতা যেন অবশ্যই সকালে জিয়া পার্কে চলে আসে।

নন্দিতা বার-বার ভেবেছে, না কিছুতেই সে ওই লোকটার সঙ্গে দেখা করতে যাবে না। কেন যাবে? যে তাকে জেনেশুনে ঠকিয়েছে, যার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে, কেন সে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে!

সারাটা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে নন্দিতা। বার-বার মাছুমের চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। নন্দিতা মাছুমের চোখের মধ্যে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায়নি। তারপরও কোথায় যেন একটা টান অনুভব করছে সে। মাত্র ছয় মাসের দাম্পত্য জীবনের অনেক কথা ভাবতে-ভাবতে রাতটা পার করেছে নন্দিতা। কিছুতেই সে মাছুমের সঙ্গে দেখা করতে যাবে না বলে সকালে ক্লাসে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয় সে।

কিন্তু এ কী হলো নন্দিতার! কেন মাছুমের কথা মনে পড়ছে বার বার? কেন মনে হচ্ছে মাছুম ওর জন্য অপেক্ষা করে পার্কে বসে থাকবে। নন্দিতা যদি না যায়, মাছুম কষ্ট পাবে। নন্দিতা আবার ভাবে, তাতে কী আসে যায় তার! এখন তো মাছুম কেউ নয় তার! মাছুম কেউ নয়—নন্দিতা আরেক সত্ত¡া সে কথা মানতে চায় না। ভিতর থেকে কে যেন নন্দিতাকে মাছুমের অপরাধগুলোকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলছে। নন্দিতা দু-হাতে কান চেপে ধরে। না সে শুনতে চায় না কোনকিছু। অনেকটা অন্যমনষ্কভাবে হাঁটতে-হাঁটতে জিয়া পার্কে চলে আসে এক সময়। সেখানে গিয়ে মাজহার সাহেবকে ফোন দেয় নন্দিতা।

মাছুম বার-বার বলছিল সে ভুল করেছে। ক্ষমা চাইছিল মাসুম। মাজাহার সাহেবও নন্দিতাকে বোঝাল যে, মাছুম আগের বউকে ভরণপোষণ দিয়ে অন্য জায়গায় রাখবে। তুমি কী বলো?

শ্রাবন্তীকে ত্যাগ করে নন্দিতাকে বেছে নেয়ার মধ্যেও যে স্বার্থপরতা লুকিয়ে আছে, একজনকে ঠকিয়ে একজনকে জিতিয়ে দেয়ার মধ্যেও যে নিষ্ঠুরতা আছে, নন্দিতা এ মুহূর্তে তা বুঝতে চায়নি। কারণ নন্দিতার স্বার্থ এখানে জড়িত। নিজের স্বার্থ অক্ষুণœ রাখতে মানুষ তার ভেদ-বুদ্ধি হারায়। নন্দিতাও এখানে হেরে যায়!

নন্দিতা মাজহার সাহেবের কথার উত্তর দিতে পারেনি। কারণ নন্দিতাও হয়ত মনেপ্রাণে মাছুমের সঙ্গে থাকতে চাইছে। কিন্তু ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর তা কি করে সম্ভব? নন্দিতা এসব নিয়ে ভাবছিল।

মাজহার সাহেব বললেন, ‘কী ভাবছো নন্দিতা?’

: আমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন তো আর সম্ভব নয়।

: সেটা আমরা বুঝবো। তুমি চাও কিনা বলো?

: বাসায় যদি রাজি করাতে পারেন…তাহলে…।

নন্দিতার কথা শুনে মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠে মাছুমের মুখ। বলল, নন্দিতা আমি তোমাকে ভালোবাসি।

নন্দিতা কিছুই বললো না।

এরপর আর নন্দিতা সেখানে দাঁড়ায়নি। দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে দ্রæত বাসার দিকে রওয়ানা হয় সে। যাবার সময় একবার শুধু পিছন ফিরে তাকায়। নন্দিতা দেখলো মাছুম ওর দিকেই চেয়ে আছে।

নন্দিতা চলে গেলে মাজহার সাহেব নন্দিতার বড় ভাইয়ের কাছে ফোন করে ওদের দুজনের দেখা হওয়া ও নন্দিতার সম্মতির কথা জানায়। মাজহার সাহেবের ফোনের কথা নন্দিতার বড় ভাই দুলাভাইয়ের কাছে জানালে তিনি একবাক্যে না করে দিয়ে বললেন, অসম্ভব! ভÐ-প্রতারকের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। নন্দিতা বাসায় পৌঁছার আগেই বিষয়টি আপা ও মা জানতে পারে।

বাসায় পৌঁছে নন্দিতা কলিংবেল টিপতেই কাজের মেয়ে দরজা খুলে দেয়। ঘরে ঢুকে কেমন একটা থমথমে ভাব দেখেও কিছুই বুঝতে পারে না সে। নিজের রুমে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করতে যাচ্ছিল এমন সময় আপা এসে জিজ্ঞেস করে—নন্দিতা, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

: কেন, ক্লাসে!

আপা নন্দিতার গালে প্রচÐ একটা থাপ্পর মারে। তারপর বলে, ছিঃ মিথ্যা কথা বলতে শিখেছ তুমি! কোথায় গিয়েছিলে বলো?

নন্দিতা তবুও বলল, ক্লাসে গিয়েছিলাম।

এবার আপা ওর হাতের মোবাইল সেট কেড়ে নিয়ে বলে, এই মোবাইলেই বুঝি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তোমার? তোমার আর মোবাইলে দরকার নেই। এখন থেকে তোমার মোবাইল ব্যবহার বন্ধ।

এর মধ্যে বড় ভাই ও দুলাভাই চলে এলে আপা কিছুটা শান্ত হলেও বড় ভাই একচোট নিলো নন্দিতার ওপর। কিন্তু দুলাভাই রাগ করলেন না। নন্দিতাকে বললেন, দেখো বোন, ওদের সঙ্গে যখন একবার ফাইনাল হয়ে গেছে, তখন আর কোনকিছুতেই আগের সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ওখানে ফিরে গেলে সারাজীবন ঠকতে হবে তোমাকে।

মা এসে বললেন, মাথা ঠাÐা কর মা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর এগোস না। দেখা করতে যাওয়া ঠিক হয়নি তোর।

নন্দিতা কোন কথা বলতে পারে না। ওর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছিল। দুলাভাই ওকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, যে লোকটা একটা মেয়েকে ঠকিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে পারে, সে যে তোমাকে ঠকিয়ে আবার একটা বিয়ে করবে না, তার নিশ্চয়তা কী? তার চেয়ে এই ভালো হয়েছে, আল্লাহ তোমাকে সর্বনাশ থেকে বাঁচিয়েছেন।

নন্দিতা কারো কথার কোন উত্তর দিতে পারল না। এক সময় ধীরে-ধীরে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা। নন্দিতা কাঁদতে-কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।

* * *

রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নন্দিতা তখন দরজা খুলে ছাদে চলে যায়। ছাদে পায়চারি করে বেড়ায় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে একা-একা কথা বলে। সারাদিন না খেয়ে থাকায় নন্দিতার খুব ক্লান্তি লাগছিল। তাই ছাদের এক পাশে রকিং চেয়ারে গিয়ে বসে। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে নন্দিতা—কোন এক সকালে অজস্র গোলাপের বাগানে সে একা হেঁটে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ তার সামনে একজন বয়স্ক মানুষ এসে দাঁড়ায়। বয়স্ক হলেও তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না নন্দিতা। বয়সের কারণে এতটুকু পৌরুষ ¤øান হয়নি তার। নন্দিতা জিজ্ঞেস করে, ‘কে আপনি?’

কিছু না বলে নন্দিতার হাতে একটি গোলাপ তুলে দেয় লোকটি। বিস্ময়ে বিমূঢ় নন্দিতা বলে, ‘আমি আপনাকে চিনি না, অথচ আপনি আমাকে গোলাপ দিলেন! কিন্তু কেন?’

লোকটি নন্দিতার কথা উত্তর দেয় না। হঠাৎ বাতাসে শোঁ-শোঁ শব্দ হতে থাকে। আর চারদিক থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠে শুনতে পায় নন্দিতা, ‘ভালোবাসি… ভালোবাসি… ভালোবাসি…’। হঠাৎ লোকটিকে কোথাও খুঁজে পায় না নন্দিতা। পাখির কিচিরমিচির শব্দে স্বপ্নের এখানটায় ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ তুলে দেখে ভোরের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। চেয়ার ছেড়ে আস্তে-আস্তে নিজের রুমে চলে যায় এবং বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ে আবার।