রিনির ডায়েরিঃ কান্না ঝরা চেরি গাছটি

মাহমুদা রিনি

রাস্তার ধারে ফুলে ফুলে ভরা চেরি গাছটি আজ মাথা নত করে দাড়িয়ে আছে, সাদা সাদা ফুল ভর্তি মাথায় অন্যদিন কেমন ঝলমল করে, আজ বড় ম্লান,নতমুখি।
আমারর আসা যাওয়ার পথের পাশে, যাওয়ার সময় জানতে চাইলাম— কি রে মন খারাপ?
টুপ করে দুটো ফুল পাতা খসে পড়লো, বুঝলাম খুব মন খারাপ, তাড়া ছিল শোনার সময় হলো না।
ফেরার সময় দাড়ালাম, জানি– না শুনলে অভিমান করবে, জানতে চাইলাম, কি হয়েছে বলতো?
এবার ঝর ঝর করে ফুল পাতা ঝরে পড়লো, কাঁদো কাঁদো গলায় যা বললো:—–
এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন একটি মেয়ে সকাল বেলায় কাজে বের হতো, শ্যামলা রং, ছিপছিপে গড়ন, ১৬- ১৭ বছর বয়স, হাতে দুপুরের খাবার টিফিন কৌটো।
সারাদিন কারখানায় করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত, ফেরার সময় এখান থেকে দু একটা ফুল কুঁড়িয়ে নিত, আর ওর নিজের গল্প করতো। ছোট বেলায় বিয়ে হয়েছিল,কয় বছর বয়সে মনে নেই, সেই বর টাকার জন্য মার-ধোর করে ওকে বের করে দিয়ে আবার বিয়ে করেছে। ওর মা’র স্বামীকেও মেয়েটি দ্যাখেনি, ও পেটে থাকতেই সে কোথায় চলে গেছে, মা’ও আবার বিয়ে করেছে, মেয়েটির তেমন কেউ কোথাও নেই।
একদিন দেখলাম মেয়েটির সাথে একটি ছেলে—
বেশ শক্ত সামর্থ চেহারা, দুজন খুব গল্প করতে করতে এসে দাঁড়ালো, বেশ হাসি খুশি, আমি কিছু ফুল দিলাম, মেয়েটি খোঁপায় পরলো, এত খুশি ওকে আর দেখিনি।
এরপর মাস খানেক গেল, আবার দেখি বেশ দ্রুত গতিতে চলা ফেরা করে, ভীত সন্ত্রস্ত চেহারা, ও আর দাঁড়ায় না, ভাবলাম একদিন জেনে নেব।

এমনি একদিন সকাল বেলা ওকে যেতে দেখলাম,
তেমনি টিফিন বাটি হাতে, ব্যস্ত– কাজে যাচ্ছে—-
ভাবলাম আজ ও ফেরার সময় জিজ্ঞাসা করবো, কিন্তু রাত গড়িয়ে গেল মেয়েটি ফিরলো না।
চিন্তা হতে লাগলো, এমন তো কখনো হয় না।
তারপর আরো দুদিন কেটে গেল কোন খবর নেই।

হঠাৎ আজ সকাল থেকেই শুনছি, সবাই বলাবলি করছে— এই পথ ধরে এগিয়ে যে কারখানা, তার পিছনে ঝোপের ধারে আধা ছেড়া একটি মেয়ের লাশ পড়ে আছে, ক্ষত বিক্ষত, একটি স্তন কেটে ফেলা,যৌনাঙ্গে এসিড ঢালা, সারা শরির রক্তাক্ত, মানুষ নাকি চোখে দেখতে পারছে না।
আমি অবাক হয়ে ভাবছি— মানুষ যদি চোখে দেখতেই না পারে তাহলে এমন কাজ করলো কিভাবে!
যাইহোক মন খারাপ নিয়েই ভাবছি তখনো মেয়েটির কথা—- এমন সময় দেখি কজন পুলিস আর কিছু সাধারণ মানুষ ভ্যানের উপর চাটাই জড়ানো একটি লাশ নিয়ে এদিকে আসছে,
বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠলো, পা দুটো বেরিয়ে আছে– এই পা তো আমার চেনা, রক্ত পচা গন্ধ মেশানো হলেও ওর গায়ের গন্ধ তো আমি চিনি।
এই তো সেই যাকে আমি ফুল দিতাম, গল্প করতাম।
ও যেন চাটাই এর ভিতর থেকে বলে উঠলো ——–
“ভাল থেকো, আমি আর আসবো না”
তোমরা মানুষ— তোমরা কত রকমের?

এই পর্যন্ত বলে গাছটি ঝর ঝর করে ফুল পাতা ঝরিয়ে দিল। আমি এতক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে আছি, সেই অশ্রু ফুল দুগালে চেপে ধরে লজ্জায় মাটিতে মিশে গেলাম মানুষ হয়ে জন্মানোর অপরাধে——–

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়