নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একগুচ্ছ কবিতা

অন্তিম শ্রাবণসন্ধ্যা

——-
বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে জলের গন্ধ রয়েছে এখনও।
আকাশের ভাবগতিক দেখে মনে হয়,
খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে সে আবার কাজে লেগে যাবে।
পাখিরা তা জানে, তাই কোনো
উৎসাহ তাদেরও নেই এই মুহূর্তে ডানা ছড়াবার।
দিকচিহ্নহীন
যে-বিশ্বে রঙের স্পর্শ এতক্ষণ কোথাও ছিল না,
মেঘের আড়াল থেকে সূর্যদেব বিদায়ের ক্ষণে
সেখানে সামান্য রঙ ছড়িয়ে দিলেন।
জানালায় বসে দেখি শেষ হল আরও একটি দিন
অন্তিম শ্রাবণে।

মৃত্যুর পরে

——-
দু’ দণ্ড দাঁড়াই ঘাটে। এই স্থির শান্ত জলে তার
আয়ত দৃষ্টির মৌন রহস্য বিম্বিত হয় যদি।
দু’ দণ্ড দাঁড়াই এই আদি অন্ধকারে। বলি, ‘নদী,
কে তার ব্যর্থতাগুলি ক্ষিপ্ত হাতে নিয়েছে কুড়িয়ে
সন্ধ্যার আকাশ, অস্ত-সূর্য আর নিঃসঙ্গ হাওয়ার
বিষণ্ণ মর্মর থেকে, শীতের সন্ন্যাসী বনভূমি
থেকে? তুমি নাকি? তার আকাঙ্ক্ষার ক্লান্ত পথ দিয়ে
কে ফিরে এসেছে এই অপরূপ অন্ধকারে,–তুমি?’
দু’ দণ্ড দাঁড়াই ঘাটে। তরঙ্গের অস্ফুট কল্লোলে
কান পাতি। যদি তার কণ্ঠের আভাস পাওয়া যায়।
যদি এই মধ্যরাতে শীত-শীত সুন্দর হাওয়ায়
নদীর গভীরে তার কান্না জেগে ওঠে। হাত রাখি
জলের শরীরে। বলি, ‘নদী, তোর নয়নের কোলে
এত অন্ধকার কেন, তুই তার অশ্রুজল নাকি?’

 

অমলকান্তি

——-
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
.
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
.
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

 

একদিন এইসব হবে, তাই

——-
একদিন সমস্ত যোদ্ধা বিষণ্ণ হবার মন্ত্র শিখে যাবে।
একদিন সমস্ত বৃদ্ধ দুঃখহীন বলতে পারবে, যাই।
একদিন সমস্ত ধর্ম অর্থ পাবে ভিন্ন রকমের।
একদিন সমস্ত শিল্পী কল্পনার প্রতিমা বানাবে।
একদিন সমস্ত নারী চোখের ইঙ্গিতে বলবে, এসো।
একদিন সমস্ত ধর্মযাজকের উর্দি কেড়ে নিয়ে
নিষ্পাপ বালক বলবে, হাহা।
একদিন এইসব হবে বলেই এখনও
সূর্য ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, এবং কবিতা লেখা হয়।

 

মন্তব্য করুন