ভাষা আন্দোলনে নারী।। সুপ্রিয়া বিশ্বাস

বাংলার ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দু’টি গৌরবোজ্জল ঘটনা হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দুটি মহান আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছি। আজ সেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলনে এ দেশের সর্বস্তরের নর-নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হয়েছিলেন। আমাদের বাহান্নর এই মহান ভাষা আন্দোলনে বিপ্লবের সঙ্গী ছিলেন নাম জানা-অজানা অনেক নারী।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্রীরা। পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে ছিলেন তারা সামনের কাতারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে ভাষার দাবির বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত পোস্টার এঁকেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নারীরাই পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙে। আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা। আহতদের চিকিৎসা সাহায্যের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েরা চাঁদা তুলে আনে। পুলিশের তাড়া খাওয়া ছাত্রদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখে। আন্দোলনের খরচ চালানোর জন্য অনেক গৃহিণী অলঙ্কার খুলে দেন। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে জেলও খাটতে হয়েছে। কেউ হারিয়েছেন সংসার। কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছেন বহিষ্কৃত। সে সময়ের ঘটনা নিয়ে আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণা এবং দলিল ও বইতে এর প্রমাণ রয়েছে।ভাষা আন্দোলনের এই সব বিপ্লবী নারীদের নাম বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকের নাম হয়তো আমরা সবাই ভুলে যেতে বসেছি অথবা কারো কারো নাম হয়তো কেউ কখনো শুনিনি। এখানে ভাষা আন্দোলনের অমর সেই সব নারীদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি-

রওশন আরা বাচ্চু : জন্ম ১৯৩২ সালে মৌলভী বাজার জেলায়। ১৯৪৭ সালে বরিশাল বি.এম. কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ স্থানটিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে আহত হন রওশন আরা বাচ্চু। তিনি কুলাউড়া গালর্স স্কুল, ঢাকার আনন্দময়ী গালর্স স্কুল, নজরুল একাডেমীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সাথে।

কল্যানী রানী: ১৯১৬ সালের ২০ মে জন্ম গ্রহণ করেন কলকাতায় ।পরে বৈবাহিক সূত্রে তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং মমতাজ বেগম হন। ভাষা আন্দোলনের মমতাজ বেগমের নাম কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণের দায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ ও কোর্টের কাছে তিনি মুচলেকা দিয়ে মুক্তির বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করেন ও পরবর্তীতে জেলে নিজ কর্মকান্ডে অবিচল থেকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

সুফিয়া আহম্মদ : জাতীয় অধ্যাপিকা সুফিয়া আহম্মদ এর জন্ম ফরিদপুর জেলায়। তিনি রাজমোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা হিসাবে যোগদান করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠির আঘাতে সুফিয়া আহম্মদ আহত হন। পরবর্তীতেও তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

ডঃ শাফিয়া খাতুন : জন্ম ১৯৩১ সালে উত্তর বঙ্গের লালমনিরহাটে। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চিরকুমারী কৃতি কন্যা ড. শাফিয়া খাতুন ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সময় সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিয়োগ হন। ১৯৫১-৫২ সালে ছাত্রী অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে তিনি উইমেন্স স্টুডেন্টেস ইউনিয়নের ভিপি ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাস, চামেলি হাউজের ছাত্রীদের নিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে এক দূর্জয় প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার আহ্বান ছিল তাঁর মতো তেজী নেত্রীর। তিনি তৎকালীন রোকেয়া হলের প্রভোষ্টের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। ড. শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ও একজন সদস্য ছিলেন।

হামিদা রহমান : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভাষা সাব কমিটিতে হামিদা রহমান সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হামিদা রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের হয়। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনীতে মুখরিত করেছিলেন চারদিক। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোওনা জারি হয়। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতে যশোর কলেজের বৈঠকে তিনি ছেলেদের পোশাক পরে সভায় যোগ দেন। পুলিশের ওয়ারেন্টের অত্যাচারে তিনি সে সময় আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।

ডা. কাজী খালেদা খাতুন : জন্ম পিরোজপুর জেলার স্বরূপ কাঠিতে। ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনের সময়ে ডা. কাজী খালেদা খাতুন ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। তিনি সে সময় মিছিল, সমাবেশ ও অবরোধে সক্রীয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। পরবর্তী ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতেও রাষ্ট্রভাষা দাবির পক্ষে মিছিল করেছেন।

জুলেখা হক ঃ ১৯৫২ সালের প্রথম থেকেই উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জুলেখা হক সে সময় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনতার সমাবেশে জুলেখা হক অংশ গ্রহণ করেন।

গুলে ফেরদৌস ঃ রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে উত্তাল দিনে গুলে ফেরদৌস ছিলেন ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী। ইডেন কলেজ হোস্টেলের মিছিলে ও সমাবেশগুলো ফেরদৌস সক্রিয়ভাবে নিয়মিত অংশগ্রহণ ও বক্তব্য রেখেছেন। ইডেন কলেজের মেয়েরা তার সান্নিধ্যে এসেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সে সময় জোরালো ভূমিকা পালন করে। তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছেলেদেরকেও সে সময় সহযোগিতা করেছিলেন।

দৌলতুন্নেসা খাতুন ঃ জন্ম ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার সর্ব প্রথম রাজনীতিবিদ। ১৯৫৪ সালে ও ১৯৫৬-৫৭ সালে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের এমএলএ নির্বাচিত হন। সংগ্রামী এই নেত্রী বহুগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন।

চেমন আরা : ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক চেমন আরা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও অধ্যাপক শাহেদ আলীর সহধর্মিণী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে চেমন আরা ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী হয়ে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের হয়, সে মিছিলে চেমন আরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

শামসুন নাহার আহসান : জন্ম ১৯৩২ সালে ১১ মে বরিশাল জেলার আলোকান্দায়। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে সহপাঠীদের প্রায় সব ছাত্র মিছিলে ও পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে যে সব মিছিল ও সমাবেশ হয়েছিল প্রায় সব মিছিলেই শামসুন নাহার অংশগ্রহণ করেন। তিনি বহু বছর সিদ্ধেশ্বরী গালর্স কলেজে অধ্যাপনা করেন।

ড. হালিমা খাতুন : জন্ম ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে বাগের হাট জেলার বাদেকা পাড়া গ্রামে। ১৯৫১ সালে বাগেরহাট প্রফুল্ল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন লাভের পর সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই সময়ই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লক্ষ্যে তিনি প্রস্তুতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং একুশের সকালে তার দায়িত্ব ছিল পিকেটিং করা। আহত ভাষা সৈনিকদের চিকিৎসা ব্যায় বহন এবং সে সময় সহকর্মীদের নিকট থেকে তিনি চাঁদা তুলেন। ভাষা আন্দোলনের পুরো সময় তিনি এভাবেই কাজ করেন। কর্মজীবনে তিনি খুলনা গালর্স কলেজ, রাজশাহী কলেজ ইনস্টিটিউটে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। ড. হালিমা খাতুন শিশু-কিশোরদের জন্য বহু বই লিখেছেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সেই সংগ্রাম মূখর দিনগুলোতে নারী সমাজের সক্রিয়ভাবে আরো যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-
বেগম সুফিয়া কামাল, সানজিদা খাতুন, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, রাণী ভট্টাচার্য, নুর জাহান বেগম, মাহমুদা খাতুন, বেগম জাহানারা মতিন, সারা তৈফুর, সোফিয়া খাতুন, জোবেদা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, মিসেস কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দা শাহরে বানু চৌধুরীসহ আরো অনেক নাম না জানা নারী। এসব নারীর সক্রিয় আন্দোলনে আজ আমরা আমাদের মায়ের মধূর ভাষায় কথা বলতে পারছি।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি-বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। আর এ দিনে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যা ও নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিধান পরিষদে বলেন-মিঃ স্পীকার ঘটনা দেখে মনে হয় আহূত আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাইনি। তার প্রমাণ এ পুলিশী জুলুম। এ অত্যাচার থেকে মেয়েরা পর্যন্ত রেহাই পায় নাই।… যে জাতি মাতৃজাতির সম্মান দিতে জানে না সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। এ অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়… মিলিটারীরা মেয়েদের গাড়ি করে নিয়ে কুর্মিটোলায় ছেড়ে দিয়েছে…আমি তাদের দুজনার নাম দিচ্ছি-যারা আহত হয়েছে-একজন হলো ঢাকা হাইকোর্টের জাস্টিস ইব্রাহিম সাহেবের মেয়ে মিস সুফিয়া ইব্রাহিম। আর একজন মিস রওশন আরা…”।

এসময় তিনি কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন-প্রস্তাবগুলো হচ্ছে ১. ভাষা আন্দোলন সূত্রে বন্দি ব্যক্তিদের শর্তহীন মুক্তি ২. হতাহতদের ক্ষতিপূরণ ৩. হত্যা নির্যাতন ও অপকর্মের জন্য দায়ী অফিসারদের প্রকাশ্য বিচার ৪. সরকারের কোন শাস্তি গ্রহণ না করা।

ভাষা আন্দোলনে নারী সমাজের অবদানের কথা বলতে হলে আর একটু পেছনে যাওয়া যাক-১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার অনুরোধ সম্বলিত একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে-আর সেই স্মারকলিপিতে বরেণ্য ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষর করেছিলেন ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার সম্পাদিকা লীলা রায় এবং মিসেস আনোয়ার চৌধুরী।

সিলেট জেলার নারীদের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেওয়া হল তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব নিশতারের কাছে সিলেটের রাজকীয় বালিকা বিদ্যালয়ে ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি।

এতে স্বাক্ষর করেছিলেন মহিলা মুসলিম লীগের জেলা কমিটির সভানেত্রী জোবেদা খানম, সহকারী সভানেত্রী সৈয়দা শাহের বানু চৌধুরী, সম্পাদিকা লুৎফুন্নেসা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, জাহানারা মতিন, রোকেয়া বেগম, সামসি কাইসার রশীদ, নুরজাহান বেগম, সুফিয়া খাতুন, মাহমুদা খাতুন প্রমুখ।

ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীর মহিলাদের ভূমিকা অপরিসীম। রাজশাহীতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-ড.জাহানারা বেগম রেনু, মনোয়ারা বেগম,ডা.মহসিনা বেগম, ফিরোজা বেগম ফুনু, হাফিজা বেগম টুকু, হাসিনা বেগম ডলি, রওশন আরা, খুরশীদা বানু খুকু, আখতার বানু প্রমুখ। বগুড়ার কবি আতাউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় বাংলাভাষা সংগ্রাম কমিটি। এতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন রহিমা খাতুন ও সালেহা খাতুন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সকল দাবি নাকচ করে দিলে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হল ছাত্র আন্দোলন ১১ মার্চ ডাকা হল সাধারণ ধর্মঘট আর এখানেও সম্পৃক্ত ছিলেন জাগ্রত নারী সমাজ যাদের মধ্যে অন্যতম নিবেদিতা নাগ, নাদেরা বেগম, লিলি খান, লায়লা সামাদ প্রমুখ- আর সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য গ্রেফতার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়ুয়া ছাত্রী নাদেরা বেগম।

বরিশালের বি এম কলেজের ছাত্রী রওশন আরা বাচ্চু শিক্ষার্থীদের নিয়ে ধর্মঘট, সভা ও মিছিল করেন। ঐ সময়ে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বাইরে বের হওয়া নিষেধ থাকলেও তিনি রাজপথে অন্যান্য ছাত্রীদের সাথে নেতৃত্বে ছিলেন।

যশোরে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ঐ দিন হরতাল ডাকা হলে যশোরের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বি,এ, পড়ুয়া ছাত্রী হামিদা রহমান- সে সময় প্রায় প্রত্যেক স্কুল কলেজের ছাত্রীরা ধর্মঘটে যোগ দিলেও শোমিন গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্কুল কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞায় মিছিলে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু হামিদা রহমান তার দৃঢ় নেতৃত্বে ওদের বের করে নিয়ে আসেন। আর এই ধর্মঘটের মিছিলে নেতৃত্বের কারণে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী হয়। কিন্তু এরপরেও তিনি সভায় যোগ দেন।

বাগেরহাট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্রী হালিমা খাতুন, রাবেয়া বেগম,সেলিমা খাতুনসহ অনেক ছাত্রী সে সময়ে ছাত্রদের সাথে থেকে পুরো শহরে পিকেটিং করেন।

১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ কর্তৃক আয়োজিত প্রথম সম্মেলনে নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী-এ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন।

তিনি বলেন ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য আবশ্যক হলে মেয়েরা রক্ত বিন্দু পর্যন্ত বিসর্জন দেবে।’

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা নাগাদ হাজারো ছাত্র-ছাত্রীর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-স্লোগানে মুখরিত চারদিক। এ সময়ে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করে মুক্তি পেয়েই ভাষা আন্দোলনে আবারো সক্রিয় হন নাদেরা বেগম।

১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত হলে ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের সভাপতিত্বে মিছিল বের হতে শুরু করে- প্রথম মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান-এবং চতুর্থ মিছিলের চার লাইনে চারজন করে অংশগ্রহণে রাজপথে নেমে আসেন মেয়েরা।

সাদিয়ার নেতৃত্বে সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, হালিমা খাতুন, নাদেরা বেগম,ফিরোজা বেগম, বেগম শামসুন্নাহার, সোফিয়া করিম, সারা তৈফুর, জোহরা আরা, ডা. শরিফা খাতুন,সুফিয়া আহমেদ, মোসলেমা খাতুন, আমেনা আহমেদ, স্কুলছাত্রী জুলেখা, আখতারী পারুলসহ জানা-অজানা অনেকে।

এ সময় পুলিশের লাঠি চার্জে আহত হন রওশন আরা বাচ্চু। গ্রেপ্তার হন ফরিদা বারী,কামরুনাহার শাইলী, ফিরোজা বেগম, জহরত আরা রাহেলা, জোহরা আরা, খুরাইয়া, নুরুন্নাহার,সালেহা খাতুন, সাজেদা আলী প্রমুখ।

একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলের গলিতে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম নুরজাহানমুরশেদ, দৌলতুন্নেসা খাতুন, সানজীদা খাতুন,সাজেদা খাতুন প্রমুখ। তারপর এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। নারায়ণগঞ্জে সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন সচেতন নারী সমাজের অনেকে- ভাষার প্রতি মমত্ববোধ ও জাতীয়তাবাদের এই সংক্রমণ বস্তুতপক্ষে নারী সমাজের রাজনৈতিক চেতনারই এক স্বতফূর্ত দিক-এবং অগ্রসরমানতার স্বাক্ষরও।

নারায়ণগঞ্জের বিক্ষোভ সভায় প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলে ক্ষিপ্ত জনতা কোর্ট হাউস ঘেরাও করে। তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ জনতা সংঘর্ষে আহত হয় অনেকে এবং শেষ পর্যন্ত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্‌সকে ডাকতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এক পর্যায়ে অন্যান্যদের সাথে গ্রেপ্তার হন ইলা বখসী ও ছাত্রী রেনু। পরবর্তী সময়ে মমতাজ বেগমকে মুক্তি দেয়ার প্রশ্নে সরকার পক্ষ এক স্বীকারুক্তিতে সই করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। এ কারণে তার স্বামী তাকে তালাক দেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় ভাষা আন্দোলনে এ নারীর ত্যাগের কথা কতটুকু লেখা হয়েছে!

ভাষা আন্দোলনের এক পর্যায়ে মর্গান স্কুলেরই ছাত্রী মতিয়া চৌধুরী নিজের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ ব্যানার লিখেন।

একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রতিবাদে টাঙ্গাইলে সমাবেশের আয়োজন করেন নাজমা বেগম,নুরুন্নাহার শেলী, রওশন আরা ইউসুফ প্রমূখ ময়মনসিংহে ড. হালিমা খাতুন ও অন্যান্যরা।

খুলনায় সাজেদা আলীর নেতৃত্বে মেয়েরা মিছিল করে। রংপুর আবতাবুন খাতুনের নেতৃত্বে প্রতিবাদ সভা ও মিছিলের আয়োজনের কারণে গ্রেপ্তার করা হয় তার মেয়ে নিলুফার আহমেদকে। এর পরেও তিনি থেমে থাকেননি।

সিলেটে আয়োজিত ছাত্রী মিছিল শেষে সমাবেশে প্রতিবাদী বক্তব্য রাখেন হাজেরা মাহমুদ।

চট্টগ্রামে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে কবি মাহবুব আলম চৌধুরীকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে যুক্ত হন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রতিভা মুৎসুদ্দী। ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন সৈয়দা হালিমা রহমান, চিনা বিশ্বাস, প্রতিভা মুৎসুদ্দী, শেলী দস্তিদার, প্রণতি দস্তিদার, মীরা, সুলেখা,মিনতিসহ আরো অনেকে। পরবর্তীতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলের উপর গুলি বর্ষণে ছাত্র হত্যার খবর পেয়ে বিকেল তিনটায় আবারো রাজপথে নেমে আসে ছাত্রছাত্রীরা। প্রতিভা মুৎসুদ্দীও তালেয়া রহমান মিছিল নিয়ে আসেন ডা. খাস্তগীর স্কুলের সামনে। ওখান থেকে গাড়িতে চড়ে “মন্ত্রী সভার পদত্যাগ চাই” “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”-এ সব স্লোগানে সারা শহরে প্রদক্ষিণে নেতৃত্বে ছিলেন দশম শ্রেণীর ছাত্রী হালিমা খাতুন-জওশন আরা রহমানসহ আরো অনেকে।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনের যে সব নারীরা জীবন কে বাজী রেখে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে এনেছেন, ইতিহাসের যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁদের আজ আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।সকল ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়