মৃত্যুঞ্জয়/শাহীন সুলতানা

১৫-ই আগস্ট ১৯৭৫…যেদিন রক্ত প্লাবন আর ভরা শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। যেদিন পিতা হত্যার উল্লাসে একদল নরপিশাচ আনন্দে আত্মহারা হয়ে মাতাল বনেছিল।
ভোর পাঁচটা বেজে ত্রিশ মিনিট … চারদিকে সুনশান নিরবতা… ৩২ নম্বরের বাড়িটিকে আটাশটি গোলাবিহীন ট্যাঙ্ক আর আঠারো টি মেশিনগান দিয়ে ঘিরে রেখেছে হায়েনার দল। জাতির পিতা হয়েছেন অবরুদ্ধ!
সমস্ত লাইন ছিন্ন করার পাঁয়তারা চলছে…গ্যাস,পানি এবং বিদ্যুতের। একপাল শকুন নির্বিগ্নে অস্ত্র উঁচিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে- মুখে তাদের কুমিরের দাঁত, চোখে শকুনের শ্যেন-দৃষ্টি। লক্ষ একটাই – জাতির মহীরুহ কে
নির্বংশ করতে হবে!
দয়ামায়াহীন হিংস্র লোলুপ পাষণ্ডের দল আগাতে থাকে সামনে… তারপর ফায়ার, বুলেট বৃষ্টি… একে একে বত্রিশটি গুলি… আকাশ ফাটানো চিৎকার…পিতার ঝাঁঝরা বুক!
আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে কেঁদে উঠলো বত্রিশ নম্বর।
রক্ত স্নাত বৃক্ষের শরীর। হায়েনার অট্টহাসিতে খসে পড়ছে দেওয়ালের চুনসুরকি।
একটি বাড়ি, একটি জনপদ, একটি দেশ ভেসে গেল রক্তের স্রোতে। প্রেতাত্মার তাণ্ডবে বাকরুদ্ধ আর অশ্রুসিক্ত হলো সাড়ে সাত কোটি জনতা!
ভেঙে চুরমার হলো বুকের বল,স্বপ্ন আর স্বাধীনতার স্বাধ।
পঁচিশ বছর ধরে যে স্বপ্ন লালিত হয়েছিল বাঙালির বুকের পাঁজরে – সেই স্বপ্ন আর আকাঙ্খাকে এক নিমিষে ধূলিসাৎ করে দিল ঘাতকের কাল থাবা। মৃত্যু পুরীতে পরিনত হলো বত্রিশ নম্বর। বুক পুড়ে কয়লায় পরিনত হলো মুক্তিকামী মানুষ। এমন অপকর্মের কেচ্ছা দেখে সেদিন আৎকে উঠিছিল তাবৎ পৃথিবী!

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে যেমন করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় পনেরো আগস্ট জাতীর পিতাকেও নির্বংশ করেছিল মীরজাফরি গোষ্ঠী।
কে বলেছে- এজিদ ধ্বংস হয়েছে? কে বলেছে- আবু জেহেল নিশ্চিহ্ন হয়েছে? মীরজাফর, ঘসেটি বেগম, মীরন, মোহাম্মাদী বেগ, মীর কাশিম, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ—ওদের কিচ্ছু হয়নি, ওদের নাতী-নাতনীতে ভরে গেছে দেশ-কাল-বিশ্ব। ওরা আছে… ওরা থাকবেই। একটি ভয়ঙ্কর কালো অধ্যায়,একটি ট্রাজেডি সৃষ্টি করার জন্য ওরা মুখিয়ে থাকে!
যে পিতা ছিনিয়ে এনেছিল ভাতের অধিকার, যে পিতা নিশ্চিত করেছিল বেঁচে থাকার ভিটে-মাটি, যে পিতা দিয়েছিল অর্থনৈতিক মুক্তির শুভবার্তা, একটি স্বাধীন দেশ,একটি স্বাধীন ঝাণ্ডা,একখণ্ড মুক্তভূমি, যিনি সাতকোটি সন্তানের জীবন নিরাপদ করতে বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন হায়েনার সামনে- সেই মানুষটিকে নির্লজ্জের মতো আঠারোটি গুলি দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে একবারও মায়া হয়নি
খুনি বাহিনীর! ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল ওরা।

হে মহাবীর! ষোলো কোটি বাঙালির পিতা,
আমাদের শোক দগ্ধ হৃদয়ে তোমাকে অভিবাদন জানাই।
তুমি শুধু রাষ্ট্র নায়কই ছিলে না, তুমি ছিলে বাঙালির ভাগ্যাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক আকাঙ্খিত ধূমকেতু।
তোমাকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তোমার নয় কোটি সন্তানের। কিন্তু তোমার আদর্শ তারা ধারণ করেছে বুকের অন্দরে। তোমার তর্জনী তাদেরকে উদ্বেলিত করেছে বারংবার। তোমার অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা আমরা বুকে চেপে স্বপ্ন দেখি আকাশ ছোঁয়ার!
তোমার অর্জিত সার্বভৌম আমরা খুঁজে পাই বিশ্বমানচিত্রে!
মাতৃভূমির প্রতি তোমার ভালোবাসা আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়।

হে বীর… হে মহানায়ক মৃত্যুঞ্জয়, তোমাকে প্রনাম অন্তরের অন্তস্থল থেকে।তোমার স্বপ্ন জাগরূক থাক ষোলো কোটি সন্তানের বুকে। তুমি ঘুমাও শান্তিতে- টুঙ্গিপাড়ার ছায়া সুনিবিড় মাটির বক্ষে।
আমরা জেগে আছি পিতা,লণ্ঠন জ্বালিয়ে… তোমার প্রদীপ শিখায়। একটি সোনার বাংলা গড়বো বলে…তোমার স্বপ্নকে সত্যি করবার আকাঙ্ক্ষায়।