প্রেসক্রিপশন ।। শাহনাজ পারভীন

বহুদিন পর বাড়িটা আজ ঈদের আনন্দে হেসে উঠেছে। দীর্ঘদিন পর রাশেদ, সোহা তাদের মেয়েদের নিয়ে আজ দেশের বাড়িতে আসবে। বাড়িটা হৈ-হুল্লোড়ে ভরে যাবে আগের মতোই। ভাবতেই মনটা আমার আনন্দে ভরে গেল।

অথচ কথা ছিল এই ঈদের আগেই সব কিছু চুকিয়ে ফেলা হবে। সেভাবেই মেয়েরা কথা বলেছিল চেনা উকিলের সাথে। সোহা-রাশেদ দম্পতির ত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরেছে প্রথম থেকেই। দিনকে দিন তার চিড় বেড়েই চলেছে। প্রলেপের কোনো অয়েন্টমেন্ট খুঁজে পাচ্ছে না দুজনের একজনও। অতঃপর মেয়েরাই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো-
— দরকার নেই, আমাদের কথা ভেবো না। তোমরা সুস্থ থাকো। আমরা দু বোন হোষ্টেলে উঠে যাবো। আমার তো আর পাঁচটা সেমিস্টার বাকি। ছোটোর দায়িত্ব আমিই পালন করবো। দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে যাবে ওর।
খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে সল্যুশনস দিয়ে যুদ্ধাহত পরিবেশটাকে শান্ত করে ঘরে ঢুকে যায় বড় মেয়ে রাইসা।
–এর কোনো মানে হয়? সেই জন্মাবধি একই ব্যাপার দেখছি। চলছে তো চলছেই। আর বাড়তে দেওয়া যায় না। এখানেই থামা উচিৎ। ব্যস।
–তুই ঠিকই বলেছিস আপি। আমাদের জীবনকে আমরাই গড়ে নেবো। তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদেরকেই ছাড় দিতে হবে।
— নইলে কে কখন, যখন তখন মাডার হয়ে যাবে। খেসারত দিতে হবে পুরো ফ্যামিলির। আজীবন আমাদের। তার চেয়ে বরং তারা একা থাকুক। যার যার সুখ খুঁজে নিক। ডিভোর্স নিয়ে নিক।
Ñতাই হোক, বিল ও মেলিÐা গেটসও তো তাদের বিয়ের সাতাশ বছর পর ডিভোর্সের ঘোষণা দিলো। তাদের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সিটিজেন যদি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তো?
–তাই তো। আগামীকালই দুই বোন উকিল আঙ্কেলের কাছে যাবো। পরামর্শ নিয়ে যেটা তিনি সিদ্ধান্ত দেন, যেভাবে করতে বলেন, সেভাবেই হবে। সেভাবেই করবো।
–কাউকে এ ব্যাপারে কিছুই বলার দরকার নেই।
— শুধু বড় চাচাকে জানিয়ে রাখতে হবে। আফটার অল তিনি বংশের সিনিয়র সিটিজেন। তার জানার অধিকার এবং ন্যায্যতা রয়েছে।
–বড় চাচীকেও বিষয়টি অবহিত করতে হবে।
–হ্যাঁ। ঠিক বলেছিস। তার সহযগিতার কারণেই কিন্তু আব্বু আম্মুর সংসারটা এতদিন স্থায়ী হলো। প্রথম থেকেই কিন্তু বড় চাচী সব সময় মাকেই সাপোর্ট করে।
Ñতা ঠিক। বিষয়টি চাচীকেও জানিয়ে রাখতে হবে।
এভাবেই তারা সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ডাইনিং টেবিল গোছায়। ডাইনিং টেবিল সাজাতে হয়, কিন্তু আজ আর তাদের কারোরই ডাইনিং টেবিল সাজানোর কথা মাথায় আসছে না, কোনমতে থালায় থালায় খাবার দিতে পারলেই হয়। জীবনটা বড় বেশি অতিষ্ঠ হয়ে গেছে আজ।
তাদের দুবোনের তাদের বুদ্ধি হওয়া অবধি আরও একটু খোলাসা করে বললে বলতে হয়, তাদের জন্মের পর থেকেই এই একই বিষয় তারা দেখে আসছে। এদের কি এতটুকু লজ্জ্বা শরম বলে কিছু নেই। তাদের তো বোঝা উচিৎ দুই দুটো সন্তান তাদের ঘরে আছে, তাদেরও প্রাইভেসি আছে। তাদের ও মান, সম্মান, লজ্জ্বা, শরম কিছুটা হলেও আছে? তোমাদের না হয় নাই থাকলো, কিন্তু তারা? তারা কি দেখে দেখে নিজেরা শিখবে? নিজেদের পার্সোনালিটি গড়ে তুলবে? তারা কি দেখে তাদের নিজেদের জীবন সাজাবে? শুধুই কি সেক্সুয়্যাল ভল্যুমে জীবনটা পরিপূর্ণ। সেখানে কি আর কোন ফাইল নেই, কোন ভিডিও নেই? নতুন করে আর কি কোন ভিডিও আপলোড করা যায় না? মানুষের এক জীবনে কত কিছু থাকে! জীবন, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি? এক জীবনে কতকিছু থাকে! আহা পরকীয়া! অ্যাডালট্রিই কি মানুষকে এতটা নীচে নামায়? অন্ধ করে দেয়? হা! ঘরের মধ্যে চলে ফিরে বেড়ানো , আস্ত, আস্ত, জ্যান্ত সন্তানকেও দেখা যায় না। মানুষ এতটা অন্ধ হয়ে যায়? না হলে কি করে বিবেকবান সুস্থ মানুষের পক্ষে এইগুলো সম্ভব?
এতদিন যাও এক সহনীয় পর্যায়ে ছিলো, মুখে মুখেই একজন আর একজনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে, প্রতিবাদ করেছে। প্রতিহত করেছে। তারা নিজেরাও বুঝতে পারতো না কি করে একটা সভ্য সমাজে দু’জন সর্Ÿোচ্চ শিক্ষিত মানুষ সর্Ÿোচ্চ পর্যায়ে চাকুরি থেকে অবসর নেবার পরও এতটুকু সংশোধিত হতে পারলো না। এতটুকু সংশোধন করলো না! এক পা কবরে, আর একপা ঠিকই ডাঙায়, কিন্তু সুস্থও তো নয়? তাহলে? এত বাড়াবাড়ি কোথা থেকে আসে। ভাগ্যিস, দুবোন আজ বাসায় ছিলো। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেছিলো বাবা মায়ের মাঝখানে। না হলে তো আজই বটির এক কোপে দুজনের একজন শেষ হয়ে যেতো। তখন? ছোট অবশ্য ৯৯৯ এ ফোন দিয়েই ফেলেছিলো। ভাগ্যিস, রাইসা সময় মতো ফোনটা ওর হাত থেকে কালেক্ট করতে পেরেছে। নইলে?
ক্রমাগত ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। কিন্তু রাইসা যেন জেগে জেগে ঘুমিয়ে আছে। অথবা স্বপ্নের ঘোরে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা চোখের সামনে আবারও বারবার রিলে হতে দেখে। ওর ডান হাতেও একটু আঁচড় লেগেছে। মায়ের হাতের নখ সব সময়ই একটু বেশিই বড় রাখে। এটা ঠিকই মায়ের নখের আঁচড় হতে পারে। না কি বাবার? নাকি মায়ের হাতের আংটি? রাইসা মেলাতে পারে না। এরই মধ্যে ঘোর থেকে জেগে উঠতে বাধ্য করে বার বার বেজে যাওয়া রিংটোন।
Ñ হ্যালো, চাচী।
Ñহ্যা মা, কেমন আছো?
আমাদের আর থাকা। আজও একই অবস্থা। এভাবে সুস্থভাবে বাঁচা যায় না চাচী।
Ñমানে?
Ñএই আর কি, প্রতিনিয়ত যা হয়। মা বাবা দুজনই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। কে কখন মাডার হয়ে যাবে তা তো বুঝতে পারছি না চাচী।
Ñ হুম, তোমার বড় চাচা বললো তাই। মা শোনো এক কাজ করো, তুমি তো এখন একটু বড় হইছো। তাদের গার্ডিয়ান এখন তোমাকেই হতে হবে।
Ñ হ্যা চাচাী, আমরা উকিল আঙ্কেলের সাথে ফোনে কথা বলেছি, কাল দেখা করবো দু বোন। আঙ্কেলের পরামর্শ মতো তাদের দুজনকে ডিভিার্স রেডি করে দেবো। তারা পরষ্পর পরষ্পরের কাছে থেকে সেপারেট থাকুক। আমরা দু বোন ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবো। আমরা আমাদের জীবনকে ঠিক ঠিক গুছিয়ে নিতে পারবো। পারতে আমাদেরকে হবেই।
Ñশোন, মা একটু শান্ত হও। এক কাজ করো। তোমারা দু‘বোন মিলে ওদের দুজনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।
Ñডাক্তার কেন? কোন ডাক্তার।
Ñমনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড, সামসুদ্দিন আহমেদ। স্কয়ারের পাশের বিল্ডিংয়ে বসেন। তোমার আম্মুর ফোন দেখছি সুইস অফ। আম্মু কই? আম্মুকে দাও।
Ñদিচ্ছি।
Ñবুবু। বলো।
Ñকি হলো আজ আবার? একটু শান্ত হও তোমরা।
Ñআমি তো শান্তই আছি। আমাকে তো বাঁচতে দিচ্ছে না বুবু। এত সন্দেহ, এত গালাগালি এত নীচতা, এত অত্যাচারে মানুষ বাঁচে কি করে? আমারও তো জীবন, আমিও তো মানুষ না কি? একটা কুকুর বিড়ালের যে অধিকার আছে, যে স্বাধীনতা আছে, আমার তাও নাই? আমি একটু একা হাঁটতে যেতে পারবো না, বাসা থেকে বের হতে পারবো না। এটা কেমন জীবন? ছোট মেয়েটাকে নিয়ে বের হলেও দোষ। ওকে নিয়ে একটু কেনাকাটা করতে বের হইছিলাম, আর সে কিনা মেয়েকেও সন্দেহ করে? মেয়ে নাকি আমাকে নিয়ে তার সাথে চেকিং করাতে গেছে! তুমি চিন্তা করতে পারো?
–তুমি শান্ত হও। আসলে ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। নইলে এইসব কেউ মুখে বলে?
— মাথা নষ্ট না ছাই। একদম ভÐামি। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। সে আমাকে প্রস্টিটিউট বলতেও ছাড়ে না। আমি নাকি বেশ্যারও অধিক। কোনকিছু বলতে তার মুখে আটকায় না, বলতেও ছাড়ে না। এখন আমার দায়িত্ব শেষ, তাই না? যখন সে চাকরিতে ছিল, তখন তার চাকরি বাঁচাতে, প্রমোশন করাতে, ট্রান্সফার ঠেকাতে আমার প্রয়োজন ছিল, তার বসদের খুশি করাতে আমাকে নিজে থেকেই তো তাদের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। একবার নয়, বার বার, বহুবার। এক জায়গায় নয়, বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন অফিসে। আর এখন? আমার কাজ শেষ। এখন আমি বেশ্যা? আল্লাহও সর্হ্য করবে না।
–ধৈর্য ধরো। তুমি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো?
— না বুবু, আমার আমার ধৈর্য ধরার ধৈর্য নেই। মানুষের ধৈর্যের একটা সীমা আছে। আমি আগেও তোমাকে বলেছি, এসব কথা।এখনও বলছি, তাকে সাবধান করো। নইলে কিন্তু খুনাখুনি হয়ে যাবে।
–ঠিক আছে, তারপরও ধৈর্য ধরতে হবে। রাশেদ ও তো তোমার ভাইকে অনেক কিছু বলেছে। উর্ধতন কর্মকর্তার সহযোগিতার তোমার ফোনের কললিষ্ট তুলেছে। সে তার একান্ত বন্ধু। তোমার একাউন্টের ব্যাংক এস্টেটমেন্ট নিয়েছে। ব্যাংক ম্যানেজার তার স্কুল ফ্রেÐ। সেখানে একই নম্বরেই ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছো। তোমার একাউন্টে প্রায়ই একটি একাউন্ট থেকে টাকা রিপ্লেসমেন্ট হয়েছে। সেই বিশেষ একাউন্টটি কার, সেই বিশেষ ফোন নম্বরটি কার, সবই কিন্তু সে জেনেছে। অতএব তুমিও সাবধান হও।
— কি বললে, সে কি করে এত নীচে নামতে পারে? কি করে আমার ব্যক্তিগত তথ্য সে হাতিয়ে নিতে পারে? আমি বিশ্বাস করি না। এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। একজনের ব্যক্তিগত তথ্য সে কিভাবে জব্দ করবে?
–খুবই সম্ভব। সেই সব রেকর্ড পত্রের স্কিন শর্টও তোমার ভাইকে পাঠিয়েছে। আমি তো অবাক! কি আশ্চর্য। তুমি তো আর চাকরি করো না, তাহলে তোমার এত টাকার উৎস কোথায়? কোথা থেকে আসে, কে দেয়, কেন দেয়? অতএব, তুমি শান্ত হও। চুপ থাকো।
নিজেদের জীবন তো শেষ। এক জীবনে কতোই বা সময় আমাদের? এবার তোমার মেয়েদের কথা চিন্তা করো। সাবধান হও। তাদের জীবনটা তোমাদেরকেই গড়ে দিতে হবে। এটা তোমাদের দায়িত্ব।
–কিন্তু ও তো আমাকে খুব আজেবাজে কথা বলে। সন্দেহ করে।
— শোনো, বাদ দাও। পাস্ট ইজ পাস্ট। ডাক্তারের কাছে যাও। দুজনেই। এটা একটা অসুখ। সন্দেহ বাতিক অসুখ। আমি সব বুঝেছি।ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েকেও সব বলেছি। ডাক্তারের সিরিয়াল দাও। ভালো থাকো।
এরপরও অনেকবার আমাদের ফোনে কথা হয়েছে। এক পর্যায়ে না পেরে সরাসরি বলেই ফেললাম
–তুমি কি তোমার সেই বিশেষ লোকটাকে বিয়ে করতে চাও, সে কি তোমাকে বিয়ে করবে?
–নাহ।
Ñতাহলে?
Ñ আমি এটা চাই না।
–গুড। তাহলে নিজেকে শুধরে ফেলো। ভুল হতেই পারে। তুমিও তো মানুষ। যা করেছো, একদম ভুলে যাও। ওদিকে আর পা বাড়িও না। শান্ত হও। সংসারের কাছে নত হও।
আরও কয়েকদিন পর কথা প্রসঙ্গে সোহা হঠাৎই আমাকে বললোÑ
–বুবু, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, আমি আর কখনো রাশেদের গায়ে হাত তুলবো না।
–এই টা কি বলছো তুমি? আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কি হলো? তুমি নিজে নিজের কাছে ক্ষমা চাও। মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিজেকে শুধরে নাও।
— সে আমি বলেছি। সে আমি চেয়েছি।
–ঠিক আছে, সেটাই বড় চাওয়া। ভালো থাকো।

ঠিক এক সপ্তাহ পর সোহার ফোন।
–বুবু। আমি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলাম। ডাক্তার সব শুনে বলেছে, এটা একটা কঠিন অসুখ। ঠিক মতো ওষুধ না খেলে যখন তখন একটা মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তুমি তোমার রাশেদ ভাইকে বোঝাও। বড় ভাইকে বলতে বলো। তোমরা বললে, তুমি বললে সে ঠিক শুনবে।
–ডাক্তার তোমাকে কি বলেছেন?
–ঔষধ দিয়েছে। একটা ঔষধ। রাতে খেতে হবে।
–ঠিক আছে, আমি ওকে বলবো। তোমার ভাইকেও বলতে বলবো। তুমি ভালো থেকো। তোমরা ভালো থেকো।
তারপর রাশেদকেও ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছে, দুজন একসাথে গেছে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধ খেয়ে, নিয়ম মেনে তারা এখন ভালো আছে।

এটাই আমার একান্ত ভালোলাগা।
একবার ভেবেছিলাম, সোহাকে তার এই লজ্জাজনক অধ্যায়ের সব কথা বলবো না। কিন্তু নিরুপায় হয়ে আমাকে বলতেই হলো। নইলে ওকে কিছুতেই কন্ট্রোল করা যাচ্ছিলো না, বাগে আনা যাচ্ছিলো না।
সেদিনের পর থেকে সে কিছুটা পাল্টেছে বলে মনে হয়। কিছুটা শুধরে নেবার চেষ্টা করছে। আমার নিজের কাছে একটু ভালো লাগা কাজ করে। একটি ভাঙা সংসার তো জোড়া দিতে চেষ্টা করলাম, পারলাম। এই প্রেসক্রিপশনটাই বা কম কি?