পারভীন শীলা ।।
অনেকদিন পর একটি চিঠি পেলো মৌমি। সেই চিঠিতে শুধু লেখা, কেমন আছো তুমি?
মৌমি চিঠিটা কোলের উপর রেখে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে। ফোঁটায়-ফোঁটায় অভিমানের জল গড়িয়ে পড়ছে। মৌমি কাঁদছে! আজ ওর খুব কান্না পাচ্ছে! আজ ও কেঁদে মনটাকে হালকা করতে চায়। তাই চোখের জল না মুছে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে আর আকাশ দেখছে। দূর থেকে একটি গান ভেসে আসছে—
” পৃথিবী আমারে চায়, রেখোনা বেঁধে আমায়”
মৌমি প্রতিজ্ঞা করেছিল কখনো কাউকে আর বন্ধু বলে মনে করবে না। যে বন্ধু কথা দিয়ে কথা রাখে না সে কখনো বন্ধুই হতে পারে না। হ্যাঁ, বাঁধন মৌমিকে কথা দিয়েছিল সারাজীবন ভালো বন্ধু হয়ে থাকবে। বাঁধন কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তাই মৌমি আর কাউকে বন্ধুত্বের জায়গাটা দিবে না এ বিষয়ে বদ্ধপরিকর।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মৌমি ভাবে, আমার বন্ধু এই আকাশ, আমার বন্ধু এই প্রকৃতি, আমার বন্ধু আমার নিয়তি। মানুষ বন্ধু কথা না রাখলেও, ছেড়ে গেলেও এরা কখনো ছেড়ে যায় না।
সংসারে প্রতিটা সম্পর্ক শুরু হয় আকর্ষণীয়ভাবে। সময়ের সাথে সাথে সে সম্পর্কগুলো একসময় গাঢ় কুয়াশার রঙের মতো হয়ে যায়। খুব কাছ থেকেও সেই সম্পর্কগুলো চেনা যায় না।
এই পৃথিবীতে মানুষের অনেক চাওয়া। কেউ প্রেম চায়, কেউ অর্থ চায়,কেউ প্রতিষ্ঠা চায়। মৌমি শুধু কথা বলার জন্য একজন ভালো বন্ধু চেয়েছিল।
পাশে থাকা মোবাইলটা অনেক্ক্ষণ ধরে বেজেই চলেছে। মৌমি বারবার দেখছে কিন্তু রিসিভ করছে না।
মানুষের জীবন, মন চলে অদ্ভুত এক খেয়ালের বশে। কখন কার ছোঁয়ায় জীবনের মোড় কোনদিকে ঘুরে যায় আগের থেকে বোঝার উপায় নেই। মৌমিতার বেলায়ও অন্যথায় হয়নি। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে ও যখন ব্যস্ত তখন পাশে পায় শান্তকে। শান্ত নিজে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে মৌমিতা ফেরাতে পারেনি, কারণ একা একা ও হাঁপিয়ে উঠেছিল।
শান্তকে পেয়ে মৌমিতার জীবনের মোড় সত্যি ঘুরে গেল। দু’জনের স্টাডি, সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বেশ চলছিল কিন্তু ভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সাথে সাথে দূরত্ব তৈরি হলো। দুজনেরই তখন দুই জেলায় পোস্টিং।
সারাদিনে দু একবার কথা হয়, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত কথা কেউ বলে না।
এক সকালে হঠাৎ একটি ফোন পেয়ে মৌমিতা স্তব্ধ হয়ে যায়। ওপাশ থেকে শান্তর ড্রাইভার কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, দিদিমনি শান্ত স্যার আর নেই!
-কি হয়েছে?
-রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। নিজে ড্রাইভ করে আপনার কাছে যাচ্ছিল। রাস্তায় ট্রাক চাপায় — আর বলতে পারে না কালিদাস।
সেদিন মৌমিতা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি! একাকী ঘরে চিৎকার করে কেঁদেছিল। শান্তকে হারানোর পর বুঝেছিল, ও শান্তকে অনেক ভালোবাসে।
মৌমিতার মেসেজ চেক করার খুব একটা অভ্যাস নেই। একদিন মেসেজগুলো চেক করতে গিয়ে দেখে সে রাতে শান্তর অনেকগুলো মেসেজ জমা হয়ে আছে। প্রতিটা লেখায় মৌমিতার প্রতি ওর ভালোলাগা ভালোবাসা জড়িয়েছিল।
মেসেজের উত্তর না পেয়ে লিখেছিল, কেমন আছ তুমি?
এরপর আরো একটি মেসেজ চোখে পড়ল। বাঁধনের লেখা, কেমন আছ?
মৌমিতা আজ কাঁদছে। অনেক কাঁদছে। সে কান্না বাঁধনের জন্য নয়, শান্তর জন্য।
যে একদিন অকারণে ছেড়ে চলে গিয়েছিল মৌমিতা আজ তাকে চায় না। আজ যাকে মৌমিতা চিরদিনের জন্য হারাল তাকে আর কোনোদিন পাবে না ভেবেই কাঁদছে। আর ওপাশে ফোনটা বেজেই চলেছে। ফোনটা ছিল বাধনের। মৌমিতার সেদিকে খেয়ালও নেই।
সমাপ্ত