অলোক আচার্য ।।
বড়লোক যদি তুমি হতে চাও ভাই/ভালো ছেলে তাহা হলে আগে হওয়া চাই/মন দিয়ে পড় লেখো/সুজন হহইতে শেখ/খেলার সময় রেখ, তাতে ড়্গতি নাই/ পিতামাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি/যতনে মানিয়া চল তাহাদের বাণী- কবিতার এই লাইগুলো দেড়শ বছরেরও পূর্বে ২৮ আগষ্ট ১৮৫৫ সালে কলকাতায় এক খ্যাতমান জন্ম নেওয়া কবি স্বর্ণকুমারী দেবীর ’উপদেশ কবিতা অংশবিশেষ। আজও আমরা যে উপদেশবাণী আমাদের নতুন প্রজন্মকে শোনাতে চাই, বোঝাতে চাই তা সেই সময়েই স্বর্ণকুমারী দেবীর রচনায় প্রকাশ পেয়েছে নিখুঁতভাবে। এ ছাড়াও প্রেম ও আবেগ নিয়েও স্বর্ণকুমারী দেবী চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তার কবিতায়। কবির ’বিরহ কারে কয় কবিতায় লিখেছেন- ’ বিরহ কারে কয়?/ আমি ত দিবানিশি/তোমাতে আছি মিশি/জগৎ সদা হেরি তুমিময়/ বিরহ কারে কয়? অথবা তার শ্রাবণ কবিতায় ঘোর বর্ষার বর্ণনায় পাওয়া যায়-সখি, নব শ্রাবণ মাস/জলদ ঘনঘটা/দিবসে সাঁঝছটা/ঝুপঝুপ ঝরিছে আকাশ। কবিতার প্রকাশ ছাড়া স্বর্ণকুমারী দেবী একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন লেখক ছিলেন। লেখালেখির পাশপাশি যে দেশ নিয়ে ভেবেছেন, দেশের নারী শিড়্গার কথা ভেবেছেন এবং তাদের সংগঠিত করতে, উদ্বুত্ত করতে কাজ করেছেন। ঊনবিংশ শতক থেকেই বাংলা সাহিত্যকে যে গুটিকতক নারী সাহিত্য চর্চা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন বা করার প্রয়াস করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো স্বর্ণকুমারী দেবী। এত বছর পূর্বে নারীদের সাহিত্য চর্চার সুযোগ কমই ছিল। অধিকাংশ পরিবারে তা কল্পনাতীত ছিল। ফলে এমন একটা সময়ে সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন হয়। পরিবারের সমর্থন প্রয়োজন হয়।
স্বর্ণকুমারী দেবী এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যে পরিবারে সাহিত্য ধারা ছিল প্রবাহমান। সাহিত্যমনস্ক পরিবারে সেই কাজটি আরও সহজ করে দিয়েছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর ক্ষেত্রে। বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার যা সাহিত্যের পরিমন্ডলে স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্য সাধনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তার সাহিত্যকর্ম চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছিলেন তার পরিবারে। আবার তার স্বামীর বাড়িতেও তিনি সাহিত্য চর্চা এবং সমাজ সেবায় পেয়েছেন উৎসাহ এবং স্বামীর সহযোগীতা যা তাকে পরিপূর্ণ স্বর্ণকুমারী দেবী হয়ে উঠতে সর্বোপকারে সাহায্য করেছিল। সেই কথা তিনি নিজে বলেছেনও। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। তার ছোটবেলার নাম ছিল বর্ণকুমারী। ঠাকুর পরিবারে যে সৃষ্টিশীল পরিবেশ বিদ্যমান ছিল, সাহিত্য চর্চা ও শিক্ষার যে উপযুক্ত পরিবেশ ছিল তা স্বর্ণকুমারী দেবীকেও স্পর্শ করেছিল এবং তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা অগ্রদূতদের মধ্যে অন্যতম একজন স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম ওপন্যাসিক। তার কলমের বহুমুখী প্রতিভার ধারায় বিকশিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্য। তিনি একাধারে কবি,নাট্যকার,সমাজকর্মী ছিলেন। পাশপাশি তিনি অসংখ্য গানও রচনা করেছেন। বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখিতেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় তিনি স্বচ্ছন্দে পদচারণা করেছেন। সেসময় মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ প্রায় ছিল না। তিনি শিক্ষালাভ করেছিলেন বাড়িতেই। পরবর্তীতে তাদের জন্য বাড়িতে একজন শিক্ষাক নিয়োগ করা হয়। তার বাড়িতেই শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল। অর্থাৎ পরিবেশটা ছিল অনুকূলে। সেসময় মেয়েদের প্রতিভা বিকাশের এসব সুযোগের চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল উৎকৃষ্ট কোনো পাত্র দেখে বিয়ে দেওয়া। এই রীতির বাইরে ছিলেন না স্বর্ণকুমারী দেবীও। তার বারো বছর বয়সে ১৮৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর তার বিয়ে হয়ে যায়। তার স্বামী জানকীরাম ঘোষাল ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এসব ড়্গেত্রে যা ঘটে তা হলো স্বামীর সাহচর্য পেলে প্রতিভা বিকাশের কাজটি তরাণ্বিত হয়। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বেলায়ও তার স্বামীর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ছিলেন প্রগতিশীল। কুসংস্কারে আছন্ন সমাজে তখন নারীদের সাহিত্য চর্চার বাধা ছিল। তিনি তার স্ত্রীকে তার লেখালেখি এবং সমাজকর্মে উৎসাহ দেন। তার উৎসাহে কবি তার রচনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তার প্রতিভা এবং উপযুক্ত পরিবেশে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টি করতে থাকেন অসামান্য সব লেখা। স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। এটি একটি ইতিহাস ভিত্তিক রচনা। ইতিহাসের একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে। এরপর তিনি সামাজিক ও পারিবারিক উপন্যাসও লেখেন। যেমন ছিন্নমুকুল। তার আগে ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস তার ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ওপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তার দীপনির্বাণ উপন্যাস প্রকাশে পরের বছর অর্থাৎ ১৮৭৭ সালে জ্যোতিন্দ্রিনাথ ভারতী পত্রিকা চালু করেন। এটি ছিল তাদের পারিবারিক পত্রিকা। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর পত্রিকার দায়িত্ব আসে স্বর্ণকুমারী দেবীর ওপর। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই পত্রিকা পরিচালনা করেন। এসময় তিনি লেখক ও সম্পাদক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। লেখালেখি ছাড়াও স্বর্ণকুমারী দেবী নিজেকে রাজনীতি এবং সমাজ সেবায় নিযুক্ত করেন। তার স্বামী জানকীরাম ঘোষাল ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারী। স্বর্ণকুমারী দেবী জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ গ্রহণ করেন ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে। ১২৯০ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী সখিসমিতি নামে মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মূলত- মেয়েতে মেয়তে আলাপ পরিচয়, দেখাশোনা,মেলামেশা স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার ও উন্নতির চেষ্টা,বিধবা রমণীকে সাহায্য করা, অনাথকে আশ্রয়দান করা ইত্যাদি। লেখালেখির সাথে তার বহুমুখী সামাজিক কর্মকান্ডও ব্যাপক প্রশংসিত হয়। তার উপন্যাসগুলো হলো দীপনির্বাণ (১৮৭৬), মিবার-রাজ (১৮৭৭), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯),মালতী(১৮৭৯), হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭),বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), কাহাকে (১৮৯৮), ফুলের মালা (১৮৯৫),বিচিত্রা (১৯২০),স্বপ্নবাণী(১৯২১),মিলনরাতি (১৯২৫),সাব্বিরের দিনরাত(১৯১২)। তার রচিত ছোটগল্প নবকাহিনী ও গল্পস্বল্প। নাটক ও প্রহসনের মধ্যে রয়েছে বসনত্ম উৎসব, বিবাহ উৎসব এবং রাজকন্যার দিব্যকমল, কৌতুকনাট্য ও বিবিধ কথা, দেবকৌতুক,কনে বদল,পাকচক্র, নিবেদতা,যুগানত্ম। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ হলো পৃথিবী (১৮৮২) এছাড়াও লিখেছেন সচিত্র বর্ণবোধ, বাল্যবিনোদ, আদর্শনীতি, প্রথম পাঠ্য ব্যাকরণ, বিদায় গ্রহণ ইত্যাদি।
১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে ’জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করে।